চীনের 'ঋণফাঁদ' গোতাভায়ার বড় চ্যালেঞ্জ

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী গোতাভায়া রাজাপক্ষে। ছবি: রয়টার্স
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী গোতাভায়া রাজাপক্ষে। ছবি: রয়টার্স

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী গোতাভায়া রাজাপক্ষে একসময় দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। তখন তিনি তামিলদের দমন করতে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে। তবে বরাবরই তিনি কট্টর জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে সিংহলিদের কাছে জনপ্রিয়। দেশটিতে এ বছর ইস্টার সানডেতে সন্ত্রাসবাদীদের বোমা হামলার পর নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা দেখা দেয় এবং সিংহলি জাতীয়তাবাদভিত্তিক চেতনা জেগে ওঠে। সেটার ওপর ভর করেই মূলত গোতাভায়া জয়ী হতে পেরেছেন।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে যে অনুদার গণতন্ত্রের ধারায় যুক্ত হচ্ছে, গোতাভায়ার বিজয় শ্রীলঙ্কাকে সেই ধারায় জোরালোভাবে যুক্ত করল। অভ্যন্তরীণ ও ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে তাঁর কাছ থেকে কী কী পদক্ষেপ আশা করা যেতে পারে তা রাজনৈতিক ভাষ্যকার সুধা রামচন্দ্রন দ্য ডিপ্লোম্যাট পত্রিকায় এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন। এর উপসংহারে তিনি বলেছেন, গোতাভায়ার কাছে কী প্রত্যাশা করা যেতে পারে তার অনেকখানিই নির্ভর করছে নতুন সরকারের সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক কেমন হবে তার ওপর।

নির্বাচনের আগে বেশির ভাগ ভাষ্যকার বলেছিলেন, গোতাভায়ার ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বেইজিংয়ের সঙ্গে কলম্বোর যে উষ্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল গোতাভায়া প্রেসিডেন্ট হলে সেই সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হবে। মাহিন্দা প্রতিবেশী ভারতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছিলেন। চীনের সঙ্গে তিনি এমন কয়েকটি চুক্তি করেছিলেন যা কলম্বোকে বেইজিংয়ের কাছে মারাত্মকভাবে ঋণগ্রস্ত করে ফেলেছিল। চুক্তি অনুযায়ী, ঋণ শোধ করতে না পারলে শ্রীলঙ্কাকে তার হামবানটোটা বন্দর চীনের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। বিষয়টি চীনের ‘ঋণের ফাঁদে ফেলার কূটনীতি’ হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছে। বলা হচ্ছে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) কথা মাথায় রেখে বেইজিং পরিকল্পিতভাবে শ্রীলঙ্কাকে ঋণের ফাঁদে ফেলেছে। বিআরআই বাস্তবায়নের জন্য হামবানটোটা বন্দরটির ‘মালিকানা’ চীনের জন্য জরুরি বলেই তারা এই ফাঁদ পেতেছিল।

সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা যে অবস্থায় সরকারকে রেখে গেছেন, তাতে বেইজিংয়ের ঋণ শোধ করার সামর্থ্য নেই। ফলে ভূরাজনৈতিকভাবে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে ইজারা দেওয়া ছাড়া শ্রীলঙ্কার সামনে কোনো পথ খোলা নেই।

গোতাভায়ার চীন নীতি এখনো একেবারেই অনিশ্চিত ও অনির্ণীত। দিল্লি ও প্রতিবেশী অন্য শক্তিগুলো চায় কলম্বো তাদের সাবেক চীন নীতি পর্যালোচনা করুক। এটি নিশ্চিত যে তাঁর পূর্বসূরি সিরিসেনা চীনের সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো যৌক্তিক দূরত্ব তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। গোতাভায়ার রাজনৈতিক দল শ্রীলঙ্কা পদুজনা পেরামনার (এসএলপিপি) এবারের নির্বাচনী ইশতেহারের হামবানটোটা বন্দরের নিয়তি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ইশতেহারের ৫৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘হামবানটোটা বন্দর একটি জাতীয় সম্পদ এবং অনেক আগে থেকেই এটি কৌশলগত ভূসম্পদ হিসেবে আমাদের কাছে গৃহীত। এই বন্দরকে বিক্রি করা বা ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়ায় আমাদের কোনো দিন সায় ছিল না। ভবিষ্যতেও থাকবে না।’ এই ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘চীনের সঙ্গে এই বন্দর নিয়ে যে চুক্তি করা আছে তা পুনর্বিবেচনা করা এবং তাদের হাতে বন্দর তুলে না দিয়ে বিকল্প এমন কোনো উপায় অবলম্বন করা যায় কি না, যাতে উভয় পক্ষেরই স্বার্থ সংরক্ষিত হয়, তা খুঁজে বের করাকেই আমরা প্রাধান্য দেব।’

এই ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, গোতাভায়া নির্বাচিত হলে তাঁর সরকার হামবানটোটা বন্দরকে এমন একটি আন্তর্জাতিক বন্দরে রূপান্তর করার চেষ্টা করবে, যেখানে শিল্প ও পরিবহনসেবা থাকবে। সেখানে জাহাজ তৈরি ও মেরামতশিল্পের মতো ভারী শিল্প গড়ে উঠতে পারে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই নির্বাচনে গোতাভায়া তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সাজিথ প্রেমাদাসাকে এই হামবানটোটা জেলায় হারিয়ে দিয়েছেন।

রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহার সব সময় বাস্তবায়ন করে না এবং গোতাভায়া হয়তো তাঁর প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসতেও পারেন। তবে সেটি হলে তাঁর মূল্য হয়তো তাঁকে দিতে হতেও পারে। কারণ, আমরা মনে করতে পারি, ২০১৭ সালে এই বন্দর চীনের হাতে তুলে দেওয়ার ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল।

এসব কারণে গোতাভায়ার মতো জাতীয়তাবাদী নেতার চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা নিয়ে সংকটে পড়াই স্বাভাবিক। তিনি যদি চীনের ইচ্ছামাফিক এবং চুক্তিমাফিক হামবানটোটা বন্দরকে বেইজিংয়ের কাছে হস্তান্তর করেন তাহলে তাঁর জাতীয়তাবাদী নীতি মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আর যদি এই চুক্তিকে পুনঃ পর্যালোচনার বিষয়ে নিজের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকেন, তাহলে তাঁর চীনের বিরাগভাজন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

এ অবস্থায় তিনি কি চীনের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে মালদ্বীপের ইব্রাহিম সোলিহ কিংবা মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ কিংবা পাকিস্তানের ইমরান খানদের দলে নাম লেখাবেন এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে এর আগে করা চুক্তি পুনরায় খতিয়ে দেখার সাহস দেখাবেন? আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে শিগগিরই আমরা তা দেখতে পাব।

দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

অঙ্কিত পান্ডা : দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের একজন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক এবং ডিপ্লোম্যাট রিস্ক ইন্টেলিজেন্সের গবেষণা বিভাগের পরিচালক