সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রভাব

শ্রীলঙ্কার অষ্টম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষে উৎসবমুখর জনগণ
শ্রীলঙ্কার অষ্টম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষে উৎসবমুখর জনগণ

১৬ নভেম্বর ২০১৯-এ শ্রীলঙ্কার অষ্টম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হয়েছে। বিভিন্ন দলের মোট ৩৮ জন প্রার্থীর মধ্যে ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন এসএলপিপির প্রার্থী নান্দাসেনা গোতাবায়া রাজাপক্ষে, সংক্ষেপে গোতাবায়া রাজাপক্ষে। তিনি তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রয়াত  প্রেসিডেন্ট প্রেমাদাসার পুত্র ইউএনপির প্রার্থী সাজিথ প্রেমাদাসাকে খুব অল্প ভোটে হারিয়েছেন। সাজিথ পেয়েছিলেন ৪১ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছেন অনূঢ়া কুমার। তিনি পেয়েছেন ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট। শ্রীলঙ্কা প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টশাসিত দেশ। পার্লামেন্টের নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে ২০২০ সালে। বর্তমানে পার্লামেন্টে রয়েছে বিরোধী ইউএনপির প্রাধান্য এবং প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন আছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। 

শ্রীলঙ্কার এবারের নির্বাচন আগের যেকোনো নির্বাচন থেকে অধিকতর স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে ইতিমধ্যেই স্বীকৃত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাজিথ নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলের পরপরই নিজের পরাজয় স্বীকার করে গোতাবায়াকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, শ্রীলঙ্কার তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। অপর দিকে স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে দেওয়ার জন্য সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। প্রসঙ্গত, শ্রীলঙ্কার সংবিধানে ২০১১ সালে কিছু পরিবর্তন আনার পর নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও বেশ শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে পারছে। শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ধারা ১০৩ মোতাবেক তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিয়োজিত হলেও একমাত্র পার্লামেন্টে অভিশংসন ছাড়া অথবা অন্যান্য আইনের ধারায় উল্লিখিত কারণ ছাড়া তাঁদের পদচ্যুত করা যায় না। কাজেই নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগে কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি এবং হওয়ার আশঙ্কা নেই।

শ্রীলঙ্কার দুই জাতীয় প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের নির্বাচন দুই পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ‘সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট’-এর (এসটিভি) মাধ্যমে দুই দফায় হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে ভোটারদের পছন্দের ক্রম অনুযায়ী তিনজন প্রার্থীকে (দুইয়ের অধিক হলে) ভোট দিতে হয়। তাঁদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী যদি ৫০ শতাংশের ওপরে ভোট পান, তবে তিনিই নির্বাচিত হয়ে থাকেন। অন্যথায় প্রথম দুজনের মধ্যে দ্বিতীয়বার ভোট নেওয়া হয় এবং সে ক্ষেত্রে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তাঁকেই নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। এ নির্বাচনে প্রথম দফাতেই ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে গোতাবায়া রাজাপক্ষে নির্বাচিত হয়ে ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। কাজেই এবারের নির্বাচনে প্রথম দফায় ভোটের ফলাফল নিশ্চিত হয়েছে।

অপরদিকে পার্লামেন্টের নির্বাচন আনুপাতিক হারে ইলেকশন ডিস্ট্রিক্টের জনসংখ্যার ভিত্তিতে দলের প্রতীকে হয়ে থাকে। এই দুই ধরনের নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে দুই ধরনের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা করতে হয়। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার ২ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার (২০১৮-এর অনুপাতে) জনসংখ্যার মধ্যে ১ কোটি ৬৭ লাখ ৪০৩ ভোটার (২০১৮) নিবন্ধিত রয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৭৪ দশমিক ৩২ শতাংশ।

ছোটখাটো সমস্যা হলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ওপর তা তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি বলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতামত প্রকাশিত হয়েছে। তবে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শ্রীলঙ্কায় প্রথমবারের মতো সাম্প্রদায়িক প্রভাব যেমন পড়েছে, তেমনি নির্বাচনের প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। এই বিভাজন এবং নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে আসার কারণ, গত ১২ এপ্রিল কথিত ইসলামিক জঙ্গি হামলায় সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানসহ ২৬৯ জনের প্রাণহানির ঘটনা। এলটিটিইর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং চূড়ান্ত বিজয়ের নায়ক হিসেবে পরিচিত গোতাবায়া রাজাপক্ষে সিংহলি জনগোষ্ঠী, যাদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশের সিংহভাগের সমর্থন পেয়েছেন বলে ধারণা করা হয় এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন নির্বাচনের প্রচারণাকালে চোখে পড়েছে। অপরদিকে সাজিথ শ্রীলঙ্কার সর্বসাধারণের সমর্থন চেয়েছিলেন। অবশ্য গোতাবায়া রাজাপক্ষে নির্বাচনের পর দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন যে তিনি শ্রীলঙ্কার সর্বসাধারণের প্রেসিডেন্ট। তাঁর এই বক্তব্য কতখানি কার্যকর হয়, তা দেখার বিষয় হবে। শ্রীলঙ্কার মতো দেশ যদি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিভক্ত থাকে, তা দেশটির জন্য সুখকর হবে না। প্রায় ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের ক্ষত নিয়ে শ্রীলঙ্কা এখনো বিভাজিত অবস্থায় রয়েছে। আবার অন্যদিকে ভারত মহাসাগরে বিশ্ব ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সম্পর্কের যে টানাপোড়েন রয়েছে শ্রীলঙ্কার ওপর, তার প্রভাব রয়েছে।

শ্রীলঙ্কার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তাঁর অগ্রজ ভ্রাতা মাহিন্দা রাজাপক্ষের প্রশাসনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি হিসেবে উত্তরের তামিল বিদ্রোহীদের পরাজিত করার নায়ক। এই সাবেক সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বেই ২০০৯ সালে এলটিটিইর প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের হত্যার মধ্য দিয়ে তামিলদের বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটেছিল। যুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগে আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে এবং তাঁর অনুজ গোতাবায়া রাজাপক্ষে। সে বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি। দেখার বিষয় হবে যে তিনি ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্বের তামিল অঞ্চলকে সুশাসন এবং উন্নয়নের আওতায় এনে নিজেকে কতখানি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেন।

শ্রীলঙ্কায় শুধু উত্তর-পূর্বের শ্রীলঙ্কান তামিলই নয়, মধ্য শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত তামিল জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের ব্রিটিশ শাসনের শেষের শতকে চা-বাগানের জন্য শ্রমিক হিসেবে ব্রিটিশ ভারত থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এর মধ্যে গত শতকের ষাটের দশকে প্রায় ২০ হাজার তামিলকে নাগরিকত্ব না দিয়ে শ্রীলঙ্কা সরকার ভারতে ফেরত পাঠিয়েছিল। তাঁরা ভারতে নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তবে এখনো প্রায় ১০ হাজার তামিল নাগরিকত্বহীন অবস্থায় ভারতে ফেরত যাওয়ার আশায় রয়েছেন। কথিত এই ভারতীয় তামিলরা প্রায় রাষ্ট্রহীন অবস্থায় রয়েছে। গোতাবায়ার নির্বাচিত হওয়ার পর অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বিষয়টি নিয়ে শ্রীলঙ্কা-ভারতের মধ্যে টানাপোড়েন পুনরায় মাথাচাড়া দিতে পারে।

শ্রীলঙ্কার ২০১৫ সালের নির্বাচনে গোতাবায়া রাজাপক্ষের বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষের সরকারের পতন হয়েছিল রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থা এবং চরম দুর্নীতির অভিযোগে। যদিও এলটিটিইর বিরুদ্ধে দারুণ বিজয়ের আবেশ ছিল সিংহভাগ শ্রীলঙ্কানের মধ্যে। অথচ তারপরও রাজাপক্ষের সরকারের পতন হয়েছিল। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই এসএসএলপির এই ফিরে আসার বিষয়টি অনেককেই হতবাক করেছে। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে চরম টানাপোড়েনের কারণে শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ভেঙে পড়াও গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিজয়ের একটি বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

ভারত মহাসাগরের মাঝামাঝি প্রায় উত্তরের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতার আগে থেকেই এ অঞ্চল তথা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত অঙ্কে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং রয়েছে। বিগত শতকের শীতল যুদ্ধের সময়ও শ্রীলঙ্কা ভূরাজনীতিতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বিশেষ করে দেশটিতে ভারত মহাসাগরীয় বন্দর ত্রিনকোমালি, কলম্বো ও দক্ষিণের হাম্বানটোটার অবস্থানের কারণে। ভারত থেকে মাত্র ২৮ মাইল দূরে পক প্রণালি দ্বারা বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপরাষ্ট্রকে নিজেদের নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে রাখতে ভারতের সরকারগুলো সব সময়ই সচেষ্ট। এ কারণে শ্রীলঙ্কার নির্বাচন ও সরকার গঠন ভারতের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। শ্রীলঙ্কার বিগত সরকার চীনের তৈরি করা দক্ষিণের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হাম্বানটোটাকে ৯৯ বছরের জন্য চীনের হাতে তুলে দেওয়ার পর দেশটি ভারত মহাসাগরে চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছে। 

বর্তমান নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অনেক বিশ্লেষক চীনঘেঁষা হিসেবে বিবেচনা করেন। তা ছাড়া, শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার পেছনে চীনের ঋণের চাপ রয়েছে বলে মনে করা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর ভূকৌশলগত প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত। কাজেই নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের সামনে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার চ্যালেঞ্জ যেমন থাকবে, তেমনি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-চীনের ভূরাজনৈতিক ভূকৌশলগত টানাপোড়েন সামাল দেওয়াও এক বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে গোতাবায়া রাজাপক্ষের সামনে ২০২০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে আরেকটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। পার্লামেন্টে এসএলপিপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় কি না, সেটা হবে দেখার বিষয়।

যা-ই হোক, শ্রীলঙ্কা আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ। কাজেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত নতুন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানানো ছাড়াও আমরা আশা করি যে ভারত মহাসাগরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে পরিচালিত হবে। অপরদিকে শ্রীলঙ্কা ভারত মহাসাগরের বৃহৎ শক্তিগুলোর টানাপোড়েনে উদ্ভূত ঘূর্ণিবায়ু থেকে দূরে থাকবে। তবে এ অঞ্চলে যে ভূকৌশল ও ভূরাজনীতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে, তাতে সন্দেহ নেই। 

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে অনারারি ফেলো এসআইপিজিএনএসইউ
[email protected]