জরুরি অবস্থায় গ্রহ, বাংলাদেশে আরও বেশি

বাস্তুসংস্থানের পতন রোধে এই গ্রহের প্রাকৃতিক উৎসগুলোর সক্ষমতার সীমাকে আরও গভীরভাবে বোঝা জরুরি হয়ে পড়েছে। ছবি: রয়টার্স
বাস্তুসংস্থানের পতন রোধে এই গ্রহের প্রাকৃতিক উৎসগুলোর সক্ষমতার সীমাকে আরও গভীরভাবে বোঝা জরুরি হয়ে পড়েছে। ছবি: রয়টার্স

১৩ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সবার সম্মতিতে প্লানেটরি ইমার্জেন্সি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু পুরো গ্রহের ক্ষেত্রেই বা এর কী অর্থ, আবার বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই জরুরি অবস্থার অর্থ কী?

গ্রহের জরুরি অবস্থা আসলে কী?
জলবায়ু পরিবর্তন আর গ্রহের জরুরি অবস্থা—এই দুটো বিষয় এক নয়। বরং জলবায়ু পরিবর্তন গ্রহের এই জরুরি অবস্থার একটা বড় অংশ। প্লানেটরি বা পৃথিবী নামের এই গ্রহের জরুরি অবস্থা হচ্ছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ এবং তার সীমাহীন চাহিদা মেটাতে গিয়ে বাস্তুসংস্থান ভেঙে পড়ছে। ফলে পুরো বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন সেখানে একটি বড় নিয়ামক। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি জলবায়ু এবং পরিবেশের ওপর যে প্রভাব ফেলছে, তার ফলে প্রকৃতি থেকে আমরা যেসব সেবা পাই, তা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে। যুক্তরাজ্য সরকারের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা প্রফেসর জন বেডিংটন বলেছেন, একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত বর্ধমান পানি ও বিদ্যুতের চাহিদার জটিল সম্পর্ক আছে। অতিরিক্ত মানুষের চাপ ও তাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা প্রকৃতির সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এটা বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে যাচ্ছে।

পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা ৭৭০ কোটি। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালে এই সংখ্যা ৮৫০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে এবং কমতে শুরু করার জন্য এই শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এদিকে মানুষ যত বাড়ছে, ততই বাস্তুসংস্থানের ওপর চাপ বাড়ছে। পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। প্রকৃতি বসবাসের উপযোগিতা হারাচ্ছে। পাশাপাশি এই সময়ের ভেতর অনেক উন্নয়নশীল দেশ মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হবে। ফলে তাঁদের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে স্থল, সমুদ্র তথা সমগ্র প্রকৃতির ওপর চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে।

পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থের সিইও ক্রেগ বেনেট অনেকের মতামত এবং তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন, বিপুল এই জনসংখ্যার খাদ্য, বিদ্যুৎ ও জলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই গ্রহের বাস্তুসংস্থানের যে সক্ষমতা দরকার এবং আমাদের প্রযুক্তিগত যে দক্ষতা রয়েছে, তা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়।

৮৫০ কোটি মানুষের জন্য ২০৩০ সালের দিকে আমাদের খাদ্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫০ শতাংশ বাড়াতে হবে। বাস্তুসংস্থানের ওপর চাপ না বাড়িয়ে এই খাদ্য ও বিদ্যুতের জোগান নিশ্চিত করা খুবই কঠিন। সেই সঙ্গে বর্তমানের চেয়ে আরও ৩০ শতাংশ ব্যবহারযোগ্য পানির ব্যবস্থা করতে হবে। অথচ বর্তমানেই ব্যবহারযোগ্য পানির জন্য এই গ্রহের অনেক স্থানে হাহাকার শুরু হয়েছে। বাড়তি এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন এই সক্ষমতাকে আরও দমিয়ে দিচ্ছে।

পৃথিবীর বিজ্ঞানীসমাজ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জাতিসংঘ—সবাই এই গ্রহের ব্যবস্থাপনায় আসন্ন বিশৃঙ্খলতার ঝুঁকির বিষয়ে কমবেশি একমত। পরিবেশবাদী সংগঠন যেমন ডব্লিউডব্লিউএফ, অক্সফাম, ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ এবং সাম্প্রতিককালে এক্সটিংশন রেবেলিয়ন ক্রমবর্ধমান সচেতন সমাজকে সঙ্গে নিয়ে এ ঝুঁকি কেমন করে কমানো যায়, কেমন করে জীববৈচিত্র্যের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে গবেষণা এবং প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব পরিবেশবাদী গোষ্ঠী অনেক দিন ধরেই নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিবেশবিধ্বংসী শিল্পে বিনিয়োগ বন্ধ করতে চাপ প্রয়োগ করে আসছে। গড় কার্বন নির্গমন কমিয়ে সাম্য কার্বন অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করে আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।

পৃথিবী ও প্রকৃতির সক্ষমতার একটা সীমা আছে। সুইডেনে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে জোহান রকস্টর্মের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী একে প্লানেটরি বাউন্ডারিজ বলছেন। তাঁদের কথার সারমর্ম হচ্ছে, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ এবং এদের সীমাহীন চাহিদা প্রকৃতির সক্ষমতার সীমাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। তাঁরা প্লানেটারি বাউন্ডারিজকে ৯টি ভাগে ভাগ করেছেন। এর ভেতর জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং নাইট্রোজেন চক্র তাদের নিরাপদ সীমা ইতিমধ্যেই অতিক্রম করে গেছে। বাস্তুসংস্থানের শুরু হওয়া পতন রোধ করতে গেলে এই গ্রহের প্রাকৃতিক উৎসগুলোর সক্ষমতার সীমাকে আরও গভীরভাবে বোঝা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।

২. বাংলাদেশে জরুরি অবস্থার রূপটি কেমন?
বাংলাদেশের মতো এত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ পৃথিবীতে কমই আছে। ক্রমবর্ধমান এ দেশের জনসংখ্যা ২০৩০ সাল নাগাদ ১৮.৫ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। অথচ ইতিমধ্যেই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এ দেশের মানুষের খাদ্য, বিদ্যুৎ, ব্যবহারযোগ্য পানির চাহিদা হু হু করে বাড়ছে। ফলে চাপ পড়ছে কৃষি জমির ওপর। শুধু ঢাকা বা জেলা শহরগুলো নয়, উপজেলা এমনকি গ্রামের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো শহরে রূপান্তরিত হচ্ছে। এর আশপাশের কৃষিজমিতে রাতারাতি দালানকোঠা, দোকানপাট উঠে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। উপরিভাগের জলাধারগুলো হয় শুকিয়ে যাচ্ছে বা যেগুলো এখনো কোনোরকমে টিকে আছে সেগুলো দূষিত হয়ে পড়েছে।

হু হু করে খাদ্য, জ্বালানি তেল, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আবহমান ষড়ঋতুর দেশটিতে এখন মোটামুটি তিনটি ঋতু। ঋতুর এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে এই অঞ্চলের উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবসমাজ হিমশিম খাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষিসহ অন্যান্য উৎপাদন ব্যবস্থায়। এর ফলে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার নতুন ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এসব সমস্যা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

২০৩০ সাল নাগাদ এই সমস্যাগুলো আরও প্রকট আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। বর্তমান দেশে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। ২০৩০ সালে এ দেশের দরকার হবে ৩৪,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। নিরাপদ পরিবেশবান্ধব উৎস থেকে এই বিদ্যুতের জোগান দেওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবি করলেও, ২০৩০ সাল নাগাদ ক্রমবর্ধমান প্রোটিনের চাহিদা এবং তা ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশে আগামী ১০ বছরে গ্রীষ্মকালে গরমের মাত্রা ও স্থায়িত্ব আরও বাড়বে। ১৮.৫ কোটি মানুষ লোডশেডিংয়ের দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাইবে না, শাকপাতা দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমোতে যেতে চাইবে না। আগামী দশকের শেষে এ অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা ১.২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের উচ্চতাও বৃদ্ধি পাবে, তা নিশ্চিত। তা ছাড়া বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, ভাঙন বৃদ্ধি পাবে। মাটির উৎপাদন ক্ষমতাও হ্রাস পাবে। তার ফলে বহু কষ্টে অর্জিত বর্তমান খাদ্যনিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। আর এভাবেই পৃথিবীর এ অঞ্চলে বাস্তুসংস্থানের পতন ঘনিয়ে আসছে।

৩. বলা সহজ, করা কঠিন
এ পরিস্থিতিতে সংসদে প্লানেটরি ইমার্জেন্সি ঘোষণার প্রস্তাব সময়োপযোগী এবং যুক্তিসংগত। কিন্তু জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং নতুন বাস্তবতা তৈরি করা খুবই কঠিন। যেমন: বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে তার প্রভাবে উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব এবং প্রকৃতির অন্যান্য উপাদান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো ঠিক নিশ্চিত নন, জলবায়ু পরিবর্তনের টিপিং পয়েন্টর চেহারাটি আসলে কেমন। অর্থাৎ কতখানি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বাস্তুসংস্থান এমনভাবে ভেঙে পড়বে, যা আর পুনরুদ্ধার করা যাবে না—এটা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারা কঠিন।

উষ্ণায়নের বিপরীতে কোন প্রজাতির অভিযোজন ক্ষমতার সীমা কতটুকু, তা নিয়েও আছে বিস্তর অনিশ্চয়তা। যেমন: সমুদ্রের উদ্ভিদ ও প্রাণী জলের তাপমাত্রা, অম্লত্ব এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধি কত দিন মানিয়ে নিতে পারছে বা পারবে, সেটা বের করা দরকার। তা ছাড়া ভগ্ন বাস্তুসংস্থানের ভেতরে মানুষের জীবিকা, স্বাস্থ্য কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে, সেটা জানাও সহজ নয়। কৃষি ও দৈনন্দিন কাজে ক্রমবর্ধমান ব্যবহারযোগ্য জল পরিবেশবান্ধব উপায়ে জোগান দেওয়া সম্ভব, সেটাও অনিশ্চিত। এ রকম ভগ্ন বাস্তুসংস্থানের ভেতরে নানাবিধ অনিশ্চয়তার মুখে মানুষ কেমন করে তার প্রাত্যহিক সিদ্ধান্তগুলো নেয়? এ রকম অসংখ্য বিষয় আমাদের আজও যথেষ্ট জানতে বাকি আছে। এমতাবস্থায় বাস্তুসংস্থান পতনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবতাটি পাঠ করা খুব জটিল কাজ।

এ অবস্থায় আমাদের আতঙ্কিত হলে চলবে না। মানুষই এই দুরবস্থার জন্য দায়ী। মানুষকেই তার বুদ্ধিমত্তা, সচেতন চিন্তা এবং বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণা এই দুর্জয় অভিযাত্রার প্রথম পদক্ষেপ। এখন আমাদের খুঁজতে হবে আদর্শসংখ্যক মানুষের টেকসই জীবিকার জন্য প্রাকৃতিক উৎসগুলোর টেকসই ব্যবহার কেমন করে করা যায়। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রথমেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর পলিসি তৈরি করতে হবে। বর্তমান ধ্বংসাত্মক উৎপাদন ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে দ্রুত বদলে ফেলতে সৃজনশীল উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাস্তুসংস্থানের সদস্যদের সক্ষমতা বুঝে সেই নির্ধারিত সীমার ভেতরে কীভাবে বসবাস করতে পারা যায়, তা খুঁজতে হবে। যেহেতু বাস্তুসংস্থানের পরিধি বিশ্বব্যাপী, সেহেতু উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এর পুনরুদ্ধার কাজে এগোতে হবে। আশা করি বাংলাদেশের সরকার সংসদে বিলটি পাস করবে। এবং আসন্ন সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো মোকাবিলার জন্য গবেষণা এবং সমন্বিত কাঠামো তৈরিতে দ্রুত বিনিয়োগ করবে।

লেখক: যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক এবং এক্সটিংশন রেবেলিয়ন ইয়র্কের সদস্য।
[email protected]