'ওই মানুষগুলানই শকুন হয়া গেছে'

পেঁয়াজের দাম যখন ঘড়িঘড়ি বাড়ছিল, তখন সামাজিক মাধ্যম তড়িঘড়ি পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার বিভিন্ন তরিকা শেখানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রতিবাদী ঘরানার কিছু চিহ্নিত কলমচি পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার এসব ‘চক্রান্তের’ বিরুদ্ধে মুখ খুললে পেঁয়াজি বিনোদন আরও জমে ওঠে। মুখে মুখে মশকরা চলতে থাকে, চালের দাম বাড়লে কি চাল ছাড়া ভাত রান্নার বুদ্ধি দেবেন কেউ? এর মধ্যে রসিক খাদ্যমন্ত্রী এলান করে দেন, পেঁয়াজ ছাড়া ২২ পদের রান্নার এলেম তাঁর আছে। তিনি জানেন কীভাবে কী পাকাতে (ঘোঁট পাকানোর কথা বলছি না) হয়।

মন্ত্রী চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসেছিলেন চালের দামের তাল সামলাতে। চালের সভাতেও পেঁয়াজি বিনোদন ঢুকে পড়ে। চাল আমাদের প্রধান খাদ্য। সুতরাং খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে চালমন্ত্রীও বলা যায়। তিনি একজন নামকরা চাল ব্যবসায়ী। সেই হিসাবে চাল ব্যবসায়ীদের সবাই কমবেশি তাঁর চেনা বন্ধু। চেনামুখ নিয়ে হলেও খাদ্যমন্ত্রী আলোচনায় যথেষ্ট সিরিয়াস। বিষয়টি মোটেও ইয়ার দোস্তদের হাসিঠাট্টা ছিল না। আলোচনার একপর্যায়ে মন্ত্রী পেঁয়াজের মতো চালের দাম নিয়ে যাতে কোনো কেলেঙ্কারি না হয়, সে জন্য চালকল মালিকদের সতর্ক করেন। চালের দাম কমাতেও নির্দেশ দেন। তখন ব্যবসায়ীদের একজন সাহস করে পেঁয়াজের দাম কমাতে খাদ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী শুনিয়ে দেন, ‘পেঁয়াজ না খেলে কী হয়?’ মালিকেরা জবাব দেন, ‘পেঁয়াজ দিলে রান্নায় খুব স্বাদ হয়। খেতেও মজা লাগে।’ তখন খাদ্যমন্ত্রী সগর্বে এলান করেন, ‘পেঁয়াজ ছাড়া ২২ পদের রান্না আমি জানি। আপনাদের খাওয়াতেও পারব।’ (দেখুন যুগান্তর অনলাইন সংস্করণ ১৭ নভেম্বর ২০১৯)


খাদ্যমন্ত্রী চালের দর সহনীয় (কার জন্য সহনীয়?) মাত্রায় রাখার জন্য দুইটি মহান ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। বাণী এক: চালের দাম আর বাড়বে না। কিন্তু বাণী-পরবর্তী রাত না পোহাতেই সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘট শুরু হলে তিনি জাতির কাছে দুই নম্বর বাণী পেশ করেন, ‘১০ দিন পরিবহন ধর্মঘটেও চালের বাজারে প্রভাব পড়বে না।’ ১১ দিনের মাথায় কী হবে, সেটা কি মন্ত্রীর জানা ছিল? তবে সেই দুর্ভোগ দেখার সুযোগ আপাতত থাকছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ধর্মঘটিদের সঙ্গে সমঝোতায় এসেছেন বুধবার (২০ নভেম্বর গভীর রাতে)।

কিন্তু এর মধ্যে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। কেন এক সপ্তাহ আগে যে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ২৮ থেকে ৪০ টাকায়; সেই চাল অর্থাৎ স্বর্ণা/চায়না/ইরি কেমন করে বর্তমানে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় উঠে গেল? যে চাল ছিল ৪৫ থেকে ৫৬ টাকার মধ্যে, তা রাতের মধ্যে বিক্রি হতে থাকে ৪৮ থেকে ৬০ টাকায়?

গত বছর নভেম্বরের এই সময়ে চালের দাম হুট করে বেড়ে গিয়েছিল। তারও আগে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরেও চালের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে তুমুল শোরগোল শুরু হলে তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী দুজন চালকল নেতার বিরুদ্ধে মজুতদারির অভিযোগ এনে তাঁদের গ্রেপ্তারের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।

এই দফায় চালের দাম বাড়া কিন্তু শুরু হয় নওগাঁ থেকে—সেখানেই খাদ্যমন্ত্রীর মূল ব্যবসা। তবু মন্ত্রী দুষেছেন পাবলিকের খাদ্যাভ্যাসে। তাঁর মতে, ‘সবাই সরু চালের ভাত খাওয়ায় সরু চালের ওপর চাপ বেড়ে গেছে। বলা বাহুল্য, শহরে এদের সংখ্যা বেশি এবং তারা চিকন চালের ক্রেতা।’ এ তথ্য জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এ কারণেই ধানের দাম বেড়েছে। আমরা তো চাচ্ছিলামও ধানের দামটা বাড়ুক। ধানের দাম বাড়ায় দামটা কৃষক পাচ্ছে। আমাদের এখন সরু ধান উৎপাদন করতে হবে। সর্বত্র যদি সরু করতে পারি, তবে তা দেশের জন্য লাভবান হবে। আমাদের রুচি পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু চাষ ব্যবস্থা পরিবর্তন হয়নি। সেটা পরিবর্তন করার জন্য সুপারিশ করেছি, বিভিন্ন জায়গায় আমরা মিটিং করে বলেছি। এখন আমন কাটা শুরু হয়েছে। ধান উঠে যাবে, তাই ম্যাসিভ রকম দাম বাড়ার অবস্থা আর নেই।’

মন্ত্রীর এই দাবি কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। উক্ত ইউনিটের পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী, গত ১০ বছরে দেশের প্রতিজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ভাত খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। তারা এখন গড়ে প্রায় ১০০ গ্রামের কম ভাত খায়।

খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম এক বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে বেশ জোরের সঙ্গেই জানিয়েছেন, ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই যে এক টাকাও দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। আমাদের উৎপাদন সর্বোচ্চ। মজুতও যথেষ্ট।’

কিন্তু দাম যে বেড়েছে, দাম যে আগের জায়গায় ফিরছে না, সেটা তো সত্য।

কার্তিক মাসে ধান-চালের দাম বাড়ে কিন্তু সেটা তো তখনকার কথা, যখন মঙ্গা ছিল দেশে। ‘এখন তো মঙ্গা নাই তাহলে মরা কার্তিক আসে কেমনে বাহে’ কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর হরি দাসীর এ প্রশ্নের জবাব আমাদের জানা নাই। ১৫ নভেম্বর তাঁর বাড়ির দাওয়ায় বসে কথা হচ্ছিল। দূরে বসা হরির বিধবা জার উক্তি কানে বাড়ি খায়, ‘দ্যাশে শকুন নাই, মানুষগুলান শকুন হয়া গেছে।’

কথাটা বোঝা যায় কিন্তু বলা কি যায়?

সংবাদমাধ্যমের প্রচারগুণে নওগাঁর বিশিষ্ট চাল ব্যবসায়ী চাকদারের নাম (ফরহাদ হোসেন চাকদার, সাধারণ সম্পাদক, নওগাঁ জেলা চালকল মালিক সমিতি) আমরা কমবেশি সবাই জানি। হঠাৎ করে চালের দাম বাড়ার কারণ কী, তা জানতে চাইলে তিনি একটু বিরক্ত হয়েই বলেছিলেন, ‘চালের দাম একটু বাড়লেই আপনারা নিউজ করেন। কৃষক-মিলারদের (চালকলের মালিক) কী অবস্থা, আপনারা খবর রাখেন?’ এ পর্যন্ত বলার পর হঠাৎ তিনি চাষিবন্ধু হয়ে গিয়ে বলেন, ‘বোরো মৌসুমজুড়ে কৃষকদের লোকসান গুনতে হয়েছে। শেষ সময়ে একটু দাম বাড়ায় কৃষকেরা স্বস্তি পেয়েছেন। বাজারে ধানের সরবরাহ কম থাকার কারণে স্বাভাবিক কারণে চালের দাম একটু বেড়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আমন ধান পুরোদমে উঠতে শুরু করলে দাম আবার কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

পাঠক নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, নওগাঁর আলুপট্টির ব্যবসায়ী চাকদার আর ঢাকার আব্দুল গনি রোডের মন্ত্রীর কথা এক সূত্রে গাঁথা। একই কথা বলেছেন দুজনে। দোহাই দিচ্ছেন কৃষকের। আমরা কৃষকের সন্তানেরা সবাই জানি এটা কতবড় ধাপ্পা। কৃষকের ঘরে এখন ধান নেই। কলমালিক আর ধান ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের টাকায় মৌসুমের সব ধান সস্তায় কিনে নিয়েছেন অনেক আগেই। ধানের বাড়তি দামের রস এখন তাঁরাই খাবেন। বরং নতুন ধান না ওঠা পর্যন্ত মূল উৎপাদক চাষিকে বেশি দামে চাল কিনে খেতে হবে। মৌসুমে দাম কম থাকায় ঋণগ্রস্ত ভাগচাষিদের অনেকেই এবার খোরাকির সবটুকু ধান ঘরে রাখতে পারেননি।

যে কেউ ভাবতেই পারেন, ৩০ টাকার পেঁয়াজ যদি ৩০০ টাকায় সহ্য হয়, সবই যদি ফেসবুকের রং-রসিকতার খোরাক হয়, তাহলে চাল-লবণ নিয়েও চেষ্টা করতে অসুবিধা কি? যাঁরা বাজারে যান, তাঁরা লক্ষ করেছেন, শুধু পেঁয়াজের দাম নয়, অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দামও মৃদু ও মাঝারি মাপে লাফাচ্ছে। সেগুলোর দামও বাড়ছে। মধ্য ও নিম্নবিত্তের কোমরের বেল্ট ও ফিতা টাইট করতে হচ্ছে। তবুও কি আমরা ভানুর ‘দেখি না কী হয়’ কৌতুকের কুশীলব হয়ে থাকব?

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও দুর্যোগব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ।