কেন ইরানিরা নিজেদের ব্যাংকেই আগুন দিচ্ছে

বিক্ষোভ এখন ইরানের শতাধিক শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। ছবি: এএফপি
বিক্ষোভ এখন ইরানের শতাধিক শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। ছবি: এএফপি

পেট্রলের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে গত শুক্রবার থেকে ইরানে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। এ বিক্ষোভ এখন ইরানের শতাধিক শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে আনুমানিক ১০০টি ব্যাংক ও ৫৭টি দোকান পোড়ানো হয়েছে। ইরানি নিরাপত্তা বাহিনী এক হাজারের বেশি লোককে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের হাতে কমপক্ষে ১২ জন নিহত হয়েছে, যদিও বিক্ষোভকারীরা বলছেন, নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ৪০–এর বেশি। বিক্ষোভকারীদের সোশ্যাল মিডিয়ায় সংগঠিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করেছে ইরান সরকার।

এ–জাতীয় অসন্তোষের জন্য ইরানের অর্থনৈতিক সংকটকে দায়ী করা হলেও বাস্তবতা আরও জটিল। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসার পর ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে এই অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার করিডরগুলোর মধ্যে একটি সূক্ষ্ম বিতর্ক চলছে। প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রবেশের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন, অন্যদিকে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ‘প্রতিরোধের অর্থনীতি’ চালু করার পক্ষে কথা বলছেন, যা কিনা অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল হবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ধারণাকে এড়িয়ে চলবে। এখন দেখা যাচ্ছে, কট্টরপন্থীরা বিতর্কটি জিতেছে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়ন করছে: তাঁর ‘প্রতিরোধের অর্থনীতি’র অংশ হিসেবে  আয়াতুল্লাহ খামেনি সরকারের ব্যয় কমানোর ব্যাপারে চাপ দিয়েছেন। যার ফলে সরকার গত সপ্তাহে পেট্রলের ওপর ভর্তুকি তুলে নিয়ে দাম ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করে, এর প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ হচ্ছে। অতীতে যেমন হয়েছে, ইরান সরকার হয়তো আবারও রাস্তাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে। তবে সর্বশেষ বিক্ষোভ এই শাসনব্যবস্থার জন্য একটি অস্বস্তিকর সত্য প্রকাশ করেছে যে ইসলামিক এই প্রজাতন্ত্রে সমর্থকবিহীন একটি সরকার গড়ে উঠেছে। চলমান বিক্ষোভগুলো ২০০৯ সালের ‘সবুজ বিপ্লব’–এর মতো বড় হয়ে ওঠেনি, যেখানে প্রধানত মধ্যবিত্ত ইরানিরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জালিয়াতির প্রতিবাদ করেছিল। চলমান বিক্ষোভে ইরানের শ্রমিকশ্রেণিকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে, যাদের দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতাসীনদের সহায়ক হিসেবে দেখা হয়েছিল। 

গত কয়েক বছরে ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কটি হয়েছে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণ নিয়ে। দুই অঙ্কের মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্বের হার বৃদ্ধি ইরানের পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের অনুমান, আগামী বছর ইরানে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির হার হবে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ।

২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে হাসান রুহানি সফলভাবে যুক্তি দিয়েছিলেন যে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথ হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা। তবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে এ ধরনের বাণিজ্যের প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে মনে করা হতো। তবে কাঠামোগত অর্থনৈতিক সংস্কারের মতো জটিল কাজ করার মতো ক্ষমতা রুহানির ছিল না এবং তিনি আশা করেছিলেন যে বিদেশ থেকে অর্থের একটি ‘ইনজেকশন’ ইরানের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির আলোচনায় সফল হন এবং তখন কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী ইরানে ফিরে আসেন। তবে এর সামগ্রিক প্রভাব ছিল নগণ্য। এমনকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইরান চুক্তি ত্যাগ এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনরায় আরোপ করার আগে অনেক ইরানি এ ধারণা বাদ দিয়েছিলেন যে বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য অর্থনৈতিক মুক্তির মূল চাবিকাঠি। খামেনি ও কট্টরপন্থীরা কখনো বিশ্বাস করেননি বিদেশিরা তাঁদের সমস্যার সমাধান করবে। ইরানের সর্বোচ্চ এই নেতা দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি ব্যবস্থার কথা বলে আসছেন, যা দেশীয় সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজারের উন্নয়ন, আঞ্চলিক রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সরকারি ভর্তুকির সংস্কার করা। খামেনি এবং তাঁর শিষ্যদের প্রধান লক্ষ্য হলো ইসলামি প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধ বজায় রাখা। তাঁদের আশঙ্কা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অবস্থান সংহত হলে পশ্চিমারা ইরানকে তাদের আর্থিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য করবে।

খামেনির ‘প্রতিরোধের অর্থনীতি’র এই দৃষ্টিভঙ্গি বিভ্রান্তিকর এবং অযৌক্তিক। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি দেশটিকে কেবল দারিদ্র্য ও বিশৃঙ্খলার দিকেই পরিচালিত করবে। কেননা, ইরান তেল–আয়ের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল একটি দেশ এবং তেল ছাড়া অন্যান্য দেশের কাছে বিক্রির জন্য প্রস্তাব করতে পারে—এমন কিছু কল্পনা করা কঠিন। অতএব বিদেশে তেল রপ্তানি না করে তাদের উপায় নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ইরানকে তেল রপ্তানি করতে বাধা দিচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশটি। এই সংকট নিরসনে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু এভাবে কি আসলেই সংকট দূর হবে? বরং দেখা যাচ্ছে, সংকট আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ইরানি জনগণ তাদের সমস্ত দুর্ভোগের জন্য সরকারের ভুল পদক্ষেপকেই দায়ী করছে। এখন ইরানের সরকার হয়তো কোনো না কোনোভাবে এই বিক্ষোভ দমাতে পারবে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট স্থায়ীভাবে নিরসনে দেশটিকে অন্য উপায় খুঁজে বের করতেই হবে।

পলিটিকো থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রে তাকেইয়েহ যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র ফেলো