আমদানি-রপ্তানির সময়

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ব্যবসা সহজীকরণে বাংলাদেশের আট ধাপ অগ্রগতিতে যেটুকু আশা জেগেছিল, আমদানি ও রপ্তানি প্রক্রিয়ার ধীরগতিতে পিছিয়ে পড়ার খবর তার চেয়ে বেশি হতাশাব্যঞ্জক। অর্থনীতি ও মানবসম্পদ বিষয়ে সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ও জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, আমরা অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের চেয়েও।

‘এশিয়ান ইকোনমিক ইন্টিগ্রেশন রিপোর্ট ২০১৯-২০২০, ডেমোগ্রাফিক চেঞ্জ, প্রডাক্টিভিটি অ্যান্ড দ্য রুল অব টেকনোলজি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সব প্রক্রিয়া সম্পাদনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে বাংলাদেশে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) প্রতিবেদনে দেখা যায়, পণ্য রপ্তানিতে ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় গড় সময় লেগেছে ৯১ ঘণ্টা, ভারতে ৮১ ঘণ্টা; আর বাংলাদেশে ৩১৫ ঘণ্টা। পণ্য আমদানিতে শ্রীলঙ্কায় গড় সময় ব্যয় হয়েছে ১২০ ঘণ্টা, ভারতে ১২৬ ঘণ্টা, আর বাংলাদেশের ৩৬০ ঘণ্টা।

এডিবির তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে আমদানি-রপ্তানির সময় অনেক কমে এলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি উন্নতি হয়নি। ২০১৭ সালে রপ্তানি ও আমদানি কার্যক্রমে আফগানিস্তানে সময় ব্যয় হতো যথাক্রমে ২৭৬ ও ৪২০ ঘণ্টা, ২০১৮ সালেও তা-ই ছিল। ২০১৭ সালে রপ্তানিতে ৩১৫ ও আমদানিতে ৩৬০ ঘণ্টা সময় ব্যয় হতো বাংলাদেশের; ২০১৮ সালে তা একই রকম ছিল। ভারতে রপ্তানিতে ২০১৭ সালে সময় ব্যয় হতো ১৪৫ ঘণ্টা আর আমদানিতে ব্যয় হতো ৩২৬ ঘণ্টা। ২০১৮ সালে সময় অনেক কমিয়ে এনেছে দেশটি।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় রপ্তানিতে ২০১৭ সালে সময় ব্যয় হতো যথাক্রমে ৯০, ৯৯, ১৩০ ও ৯১ ঘণ্টা। ২০১৮ সালেও দেশগুলো একই সময় ব্যয় করেছে রপ্তানিতে। এডিবির ওই প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে সমুদ্রপথে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে কী পরিমাণ সময় লাগে, তা নির্ধারণের জন্য লেনদেন সম্পন্ন করতে কী পরিমাণ নথি প্রয়োজন হয়, তা–ও বিবেচনায় নেওয়া হয়।

ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশে সময় সবচেয়ে বেশি লাগার বড় কারণ গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকা। গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন নিয়ে অনেক দেনদরবার হলেও শেষ পর্যন্ত ফলাফল শূন্য। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির টানাপোড়েনে পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়ে থাকি, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। স্বাধীন দেশ হিসেবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের মুখাপেক্ষী হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশের জন্য যেটি মঙ্গলজনক হবে সেটিই করা উচিত। বর্তমানে দেশে তিনটি সমুদ্রবন্দর থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই ৯০ শতাংশ পণ্য আমদানি–রপ্তানি হয়। বাকি দুটোর মধ্যে পায়রা এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। আর ভৌগোলিক কারণেই মোংলা থেকে আমদানি ও রপ্তানি পণ্য খালাসের পরিমাণ কম।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমদানি–রপ্তানি প্রক্রিয়া প্রলম্বিত হলে ব্যয়ও বেড়ে যায়, যার দায় শেষ পর্যন্ত ক্রেতার ওপরই পড়ে। এ কারণেই উন্নত দেশগুলো আমদানি–রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজতর করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। কিন্তু আমরা মুখে ডিজিটালাইজেশনের কথা বললেও আমদানি–রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজতর করতে পারিনি। বাংলাদেশে আমদানির ২৫ শতাংশ হয় ভারত থেকে; যার বড় অংশ আসে স্থলবন্দর দিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামো অত্যন্ত নড়বড়ে। আছে লোকবলের সমস্যাও। অনেক স্থলবন্দরে পণ্য রাখার প্রয়োজনীয় গুদামও নেই।

আমদানি–রপ্তানি সহজ ও স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করতে না পারলে প্রতিযোগিতার বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্যে আমরা আরও পিছিয়ে পড়ব। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেবেন আশা করি।