জাহাঙ্গীরনগরে অগ্রহায়ণ

জানি আমি তোমার দু চোখ আজ আমাকে খোঁজে না

আর পৃথিবীর ‘পরে’

বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশ্বত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে

শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া;- অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে 

জীবনানন্দ অগ্রহায়ণ সম্পর্কে এভাবেই লিখেছেন। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রহায়ণ খানিকটা ভিন্নতর। বহুসংখ্যক লাল সিরামিক ইটের সুদৃশ্য দালান, বালিহাঁস, আকাশমণি, রবীন্দ্র মহুয়াতলা, মুক্তমঞ্চ, মধুকূপী ঘাস, শাপলা শালুক, বাগাড় আর শোল মাছদের উল্লম্ফন, দোয়েল, কোকিল, সাপ-গুইসাপ, ভাঁটফুল, ঝিঁঝি, প্রজাপতি, ডাহুক, শ্যামা, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, কাঁঠাল বন, ঝাউগাছ, অজস্র বিদ্যার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, লেকের টলটলে কালো জল, শাল-সেগুন, মেহগনি, লাল মাটি, ঘাস, লতাগুল্ম, চৌরাস্তায় মোড় আর অগ্রহায়ণের আগে আগেই অতিথি পাখির আগমনের কলরব—এই আমাদের জাহাঙ্গীরনগর। এখানে তাই অগ্রহায়ণ আসে ভিন্নরূপে।

এখন জাহাঙ্গীরনগরে হালকা শীত অনুভূত হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শীতের অনুভূতি এখানকার মতো নয়। শীতের অনুভূতি বলতে আমরা যা বুঝি, তার সঙ্গে ঠান্ডার একটা যোগাযোগ থাকলেও ঠান্ডা আর শীত বোধ হয় এক নয়।

শীতের অনুরণন আসলে অনেক ধরনের আবেগের সংমিশ্রণ। এই মুহূর্তে দৃষ্টিধন্য হওয়ার মতো দৃষ্টি যাচ্ছে জানালা দিয়ে লেকের ওপর, যা এই অগ্রহায়ণের সঙ্গে মিশে এক ভিন্ন অনুভূতি তৈরি করছে। এই দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে শীত চলে এসেছে। একধরনের নরম লাজুক আবহে ছেয়ে আছে চারদিক। অগ্রহায়ণ এখানে খুব অল্প সময় অবস্থান করে। শীতের অতিথি পাখির মতোই অগ্রহায়ণও এখানে অতিথি। তবে অতিথির কদর যেমন বেশি, এই অগ্রহায়ণের কদরও ঠিক তেমনই। এ সময়টায় প্রতি বছর বিদ্যার্থীদের পদচারণে মুখর থাকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এবারের অগ্রহায়ণ অনেকটা বিদ্যার্থীশূন্য এবং বিষাদময়। নেই ভাপা পিঠার দোকান, নেই কলরব, নেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভাববিনিময়, নেই আড্ডা।

অগ্রহায়ণ আসলে খুব প্রিয় এক স্বজন বলে আমার মনে হয়, যা বিশেষভাবে এই ৭৩০ একরকে আত্মীয় করে নেয়। এখানেও আসে নতুন সবজি, খেজুরের রস এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা দর্শনার্থী। অগ্রহায়ণের আগমন উপলক্ষে এখানকার প্রকৃতির উপহার আমরা সাদরে গ্রহণ করে নিই বটতলার নানা রকম ভর্তা, শীতের সবজি, মাছ ইত্যাদি। যেন দিনরাত বিদ্যার্থীদের পরম মমতায় কাছে টানে। অর্থাৎ এ সময় সাধারণ ভোজও উৎসবের মতো মনে হয়।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঠিক প্রায় মাঝপথেই রাস্তার পাশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে রাতের যানবাহনের আওয়াজও যে এখানকার বাসিন্দাদের বাড়তি আবেগকে উসকে দেয় এবং মনের গহিনে থাকা অনেক স্মৃতি বেরিয়ে আসে। এমনভাবে বেরিয়ে আসে যে মনের মধ্যে এক পরম বেদনার জন্ম হয়। যেন শীতের মতোই প্রিয় স্মৃতিগুলো, স্মৃতির মানুষগুলো খুব কম সময়ের জন্য এখানে আসে। আবার এই সময়ে এই আঙিনা ছেড়ে যাওয়া বিদ্যার্থীদের কথা, তাদের সুখ-দুঃখের কথা মনে আসছে, ইচ্ছে করছে শীতের রাতে গরম চাদরের মতো স্মৃতিগুলোকে জাপটে ধরে রাখি। কখনো যেন হারিয়ে না যায়।

অগ্রহায়ণ এবার এমন হচ্ছে কেন? শিক্ষার্থীরা নেই, প্রাণহীন ক্যাম্পাস, দোকানপাট খোলা নেই, নেই সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিবিষয়ক চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া আড্ডা। ধূসরতা যেন জেঁকে বসেছে। জঙ্গলাকীর্ণ এই ক্যাম্পাস অগ্রহায়ণকে এবার এভাবেই বরণ করেছে।

নবান্ন উৎসব এখানকার অগ্রহায়ণের একটি বড় উৎসব, যা এবারের মতো আর পালন হলো না। সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ এক প্রাণহীন দিনযাপন করছে। অথচ এই সময়েই এটি সরব থাকার কথা ছিল। ধ্রুপদি সংগীতে মুখরিত হওয়ার কথা ছিল। আরও নানা রকম উৎসবে সজ্জিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল গ্রিক থিয়েটারের আদলে গড়া সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চটি।

হাজারো স্মৃতি এই অগ্রহায়ণে ভিড় করছে মনের ভেতর। শীতের কিছু বিশেষ গান শুনেই জীবনানন্দ দাশের ‘অঘ্রান এসেছে’ কবিতাটি বারবার পড়ে আর এই ক্যাম্পাসের দুঃখ দেখেই অগ্রহায়ণ বিদায় নিচ্ছে। জানি না এভাবেই চলতে থাকবে কি না পুরো অগ্রহায়ণ!

আজ ৯ অগ্রহায়ণ। এখনো প্রায় পুরো অগ্রহায়ণ পড়ে রয়েছে! অগ্রহায়ণের আগামী দিনগুলোও কি এভাবেই কাটবে! স্মৃতির মিষ্টি বেদনা হয়তো বয়ে বেড়াতে হবে পরবর্তী সময়ে। প্রত্যাশা, অতীতের ব্যাকুলতা আর সামনের আকুলতার সংমিশ্রণে মধুর হোক আমাদের জাহাঙ্গীরনগরের অগ্রহায়ণ।

আহসান ইমাম: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক