নীরব ও ধীর আত্মহত্যার দিকে চলেছি আমরা

দেশের মানুষ ভালো নেই মোটেই। এ কথা ঠিক, এখন মঙ্গা, দুর্ভিক্ষ আগের মাপে নেই। কিন্তু জ্বলেপুড়ে নিকেশ হচ্ছে যে মানুষের দেহখানাই। রোগশোক আদি ব্যাধির কূলকিনারা নেই। যেমন তেমন অসুখ নয়, একেবারে রাজব্যাধি। ক্যানসার এখন হামেশাই ধরা পড়ছে। লিভার অচল, কিডনি বিগড়ে যাচ্ছে অনেকেরই। ফুসফুসে ইনফেকশন, হৃৎপিণ্ড যখন-তখন থেমে যাচ্ছে। মেরুদণ্ড নুয়ে পড়ছে। বদহজম নিত্যসঙ্গী। রোজগারপাতি সব ডাক্তার আর ওষুধের দোকানে ঢেলেও নিস্তার নেই। আট আনার বড়ি আট টাকায়ও মিলছে না। ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই, ওসব চলে গেছে ক্লিনিক আর বেসরকারি হাসপাতালের বাণিজ্যের গারদে। এত রোগী যে কোথাও তাদের ঠাঁই নেই অবস্থা। তাতে বণিকদের পোয়াবারো।

রোগের এমন বিস্তার নাকি প্রকৃতির প্রতিশোধ। তামাম দুনিয়া বিষাক্ত। মাটি, পানি, বাতাস—সবকিছুই বিষে বিষে জ্বলছে। সে বিষে খালবিল, নদীনালা, সাগর একাকার। গাছ বিষাক্ত, ফল বিষাক্ত। পানি বিষাক্ত, মাছ বিষাক্ত। বিষাক্ত তাবৎ খাদ্যশস্য। মানুষের পেটে ঢুকছে বিষ। অহরহ। সাগরের পানিতে মিশছে বিষ, তা গিয়ে জমা হচ্ছে মেরু বরফে। প্লাস্টিকে সয়লাব সাগর। মাছের পেটে সে প্লাস্টিক। সেখান থেকে মানুষের পেটেও। প্লাস্টিক হজম হয় না, প্লাস্টিক মারাত্মক বিষ। প্লাস্টিক বিষে প্রাণিকুল নীলকণ্ঠ।

পরিবেশ বিপর্যয়ের তালিকায় বাংলাদেশের নাম প্রথম ছয়ের মধ্যে। একে তো ছোট্ট ভূখণ্ড, তার ওপর জনঘনত্বের চাপ দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি এই বাংলাদেশে। উন্নত দেশের তুলনায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান আর আর্থিক সামর্থ্যে সে বহু পিছিয়ে। পিছিয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তিচর্চায় এবং কর্মদক্ষতায়ও। দুদিন আগে বিশ্বের সর্বোচ্চ বায়ুদূষিত, সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর এক দিন গেল ঢাকা শহরে। এদিকে বাংলাদেশে আগামী ২০৩১ সাল নাগাদ চালু হতে পারে ৩০টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর একবার তা চালু হলে বাংলাদেশে আঘাত হানতে পারে এর নিজস্ব সৃষ্টি এসব কার্বনবোমা। কী বিপুল দূষণ, কী বিপুল অপচয়!

আকাশ ছুঁয়ে উঠছে ইমারত। কংক্রিটের জঙ্গল। সে জঙ্গল বানাতে তৈরি হচ্ছে বিষ। ঠাসাঠাসি মানুষ। তাদের নিশ্বাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের বমি সারা দিন। ঘরের মধ্যে উনুন, ঘরের মধ্যে বিষ বানানোর কারখানা। গ্যাসের চুলো, ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিংমেশিন, এয়ারকন আরও কতশত গ্যাজেট। এসব চলে বিদ্যুতে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দূষিত হয় পরিবেশ, ব্যবহারেও। যত বেশি বিদ্যুতের ব্যবহার, তত বেশি দূষণ। অথচ গ্যাজেট আর বিদ্যুৎ ছাড়া একালের জীবন অচল। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বিপজ্জনক দুটি পথই অনুসরণ করা হচ্ছে—কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ। দুটিই মারাত্মক ঝুঁকির প্রযুক্তি। তা ছাড়া বাংলাদেশে বসতবাড়ি আর কারখানা একাকার। আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প এলাকার মধ্যে তফাত নেই কোনো।

তেল পোড়ানো কৃষিযন্ত্র এ দেশে আসতে শুরু করে ১৯৬০-এর দশকে। ইরি চাষের জন্য নদী-বাঁওড়ের পানি তুলতে লো-লিফট পাম্প দিয়ে শুরু। তারপর আসে শ্যালো আর ডিপ টিউবওয়েল। মাটির নিচের পানি তুলে চাষ। তাতে মাটির তলার লোহা আর আর্সেনিক উঠে আসছে। ফসলের খেতে কারখানার সার, কারখানার বিষ। সার গাছের খাদ্য জোগাবে, বিষ মারবে পোকামাকড়। তাতে হবে সবুজবিপ্লব, না-খেয়ে মরবে না মানুষ। সাম্রাজ্যবাদী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তা খুব কাজে দিয়েছিল। নইলে, কত কোটি মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় মরত, তার হিসাব করা যেত না। সবকিছুই পরিমিত হলে ভালো। কিন্তু শিল্পবিপ্লব পরিমিতি মানে না। শিল্পের চাকা চালু রাখতে চাই বিপুল প্রাকৃতিক কাঁচামাল ও জ্বালানি। প্রকৃতি নিধন করে আসে কাঁচামাল, জ্বালানির সিংহভাগ মাটির তলার কয়লা, তেল, গ্যাস।

একশ্রেণির মানুষের লোভ সীমাহীন। তারা খাদ্য–বাণিজ্যে পেয়ে গেল মহাধনশালী হওয়ার সূত্র। খাদ্য তৈরি হবে বটে, কিন্তু তা হবে বিষাক্ত। তাদের বিত্ত অঢেল। তা দিয়ে দুনিয়ার সেরা বিজ্ঞানীদের কিনে নিতে কোনো অসুবিধা নেই। খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি আর রোগবৃদ্ধির এক নতুন ফর্মুলা নিয়ে তাদের বাণিজ্য। রোগ বাড়লে নিরাময়ের দাওয়াই নিয়ে হাজির তাদের অনেকেই। নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার জন্য এবার জমজমাট ওষুধের ব্যবসা। সোজা বাংলায়, ‘সর্প হইয়া দংশন করে, ওঝা হইয়া ঝাড়ে’।

দুনিয়ার ভুখানাঙ্গা মানুষ সংখ্যায় অধিক। তারাই এদের সহজ শিকার। তাতে লাভের মওকা বেশিই। খাদ্য তো নয়, বিষ। মানুষের লোভের কারখানায় বানানো বিষ। এ এক নয়া ফাঁদ, নয়া ছাদ। এ ছাদে সব ভোগই নারকীয় ধ্বংস ডেকে আনে।

এই খাবার আর বিষের মালিকদের বড়ই পেয়ার করে দুনিয়ার সাফাই গাওয়া মুরুব্বিরা। মনভোলানো বাহারি নাম তাদের। সনদ জারির একচেটিয়া মালিক-মোক্তার তারাই। দুভাবে তারাই সিলমোহর এঁকে দেয় দুবারে। উৎপাদন উল্লম্ফনে বেজায় খুশি তারা। সবুজবিপ্লবের নামে তার মুক্তি ঘটে দুনিয়াজুড়ে। তারপর শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এবার উলটো বয়ান। নির্বিচার সার, কীটনাশক ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তত দিনে তা চালান হয়ে যায় গরিব দুনিয়ায়। সেখানেই খাবারের সংকট বেশি। সেসব বিষে গুদাম ভরা হয় গরিব দেশের। তখন উন্নত দেশ থেকে এনে বসানো হয় আস্ত কারখানাটাই। পুরোনো কারখানার ডাম্পিং স্টেশন গরিব দেশগুলো। তাতে খরচ কমে, বাড়ে লাভের অঙ্ক।

বাংলাদেশে এমন কত বিষ বিক্রি হয়? ‘ডার্টি ডজন’ কথাগুলো খুব পরিচিত এ যুগে। এক ডজন জীবনঘাতী বিষের তালিকা সেটি। অল্ড্রিন, ক্লোরোডেন, ডিডিটি, ডাইএল্ড্রিন, এন্ড্রিন, হেপ্টাক্লোর, হেক্সাক্লোরোবেনজিন (এইচসিবি), মাইরেক্স, টোক্সাফেন, পিসিবি, পিডিডি, পিসিডিএফ। এ সবই উন্নত দেশে নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে নানা ব্র্যান্ডের নামে তা চলছেই। এ দেশের দুর্বল শাসনের সুযোগে লোভী ব্যবসায়ীরা তা দেদার বিক্রি করেন, পাহাড়সম মুনাফা লোটেন।

সরকারই এসব বাজারে বিক্রি আর কৃষক ব্যবসায়ীদের মধ্যে জনিপ্রিয় করেছে বিভিন্ন সময়ে। কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানো বা ফরমালিন দিয়ে পচন ঠেকানোর প্রযুক্তি এরাই জনগণকে শিখিয়েছিল। এখন বাজারে গেলেই বিষাক্ত ফল, বিষাক্ত সবজি, বিষাক্ত মাছ-মাংস। তাতে মেশানো হয় কার্বাইড, নয়তো ফরমালিন। খাদ্যে বিষাক্ত রং। গবাদিপশু-পাখি মোটাতাজা করতে নানা স্টেরয়েড, ইউরিয়া খাওয়ানো চলছেই। মোরগ-মুরগির খাবার, কিংবা মাছের খাবার তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত উপাদানে। আর সেসব বিষ মানুষের পেটে গিয়ে সৃষ্টি করছে নানা রকম জটিল রোগব্যাধি।

মানুষের খাবার নিয়ে, রোগব্যাধি নিয়ে দুনিয়াজুড়ে চলছে জঘন্য ব্যবসা। জনস্বাস্থ্যের জন্য এ হুমকি মোকাবিলায় জোর তৎপর না হলে মহাবিপদ আসন্ন। সন্তানদের দুধে–ভাতে রাখার স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠলেও কিছুই যেন করার নেই। আমাদের লোভ আর অক্ষমতার কাছে বন্দী আমাদের ভবিষ্যৎ। এক ধীর আত্মহত্যার দিকে চলেছে পৃথিবী।

আমিরুল আলম খান: যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]