এমন তো হওয়ার কথা ছিল না

২০১৬ সালে রংপুর মেডিকেলের লাশ কাটা ঘরের রাস্তায় মেয়েটির সঙ্গে প্রথম দেখা। সেদিন ছিল ২২ কার্তিক, নভেম্বরের ৮ কি ৯ তারিখ। চাঁদ তখনো পূর্ণিমা পায়নি। তবে প্রায় ভরা চাঁদ যেন আগুন মেখে তার জোসনার পিতাকে দেখতে এসেছিল। চাঁদের এমন চমকে দেওয়া রূপ আগে চোখে পড়েনি। পুলিশের গুলিতে নিহত রমেশ টুডুর লাশ তখনো লাশ কাটা ঘরে। চারদিকে গিজগিজ করছে পুলিশ—কেউ পোশাকে কেউ বা সাদায়। কে যেন দেখিয়ে দিল এটা রমেশের বেটি। বাপের লাশের জন্য লাশ কাটা ঘরের সামনে দুদিনের না খাওয়া মেয়ের মুখ আরও কতবার দেখতে হবে কে জানে? তবে জোসনার সে মুখ ভোলার নয়। তাই গত বছর (২০১৮) বগুড়ার কাহালুর ইটভাটায় জোসনা টুডুকে একঝলক দেখে চিনতে কোনো কষ্ট হয়নি। 

গত বছর (এপ্রিল ২০১৮) দেশের কয়েকটি দৈনিকে এ রকম একটা খবর ছাপা হয়েছিল যে ‘বগুড়ার দুপচাঁচিয়া, কাহালু, নন্দীগ্রাম, আদমদীঘি ও শিবগঞ্জের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নাগর নদের বিভিন্ন স্থান থেকে রোজ খননযন্ত্র দিয়ে নদীর পাড় কেটে ট্রাকে মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়।’ সেই খবরের সূত্র ধরেই কাহালু যাওয়া।

জোসনা টুডু বলে, ‘ইমন তো হবার লয়’
ইটভাটায় গিয়ে সরেজমিন মালিকের সঙ্গে কথা বলার বাইরে আর কোনো কাজ ছিল না। ভুলে যাওয়া জোসনা আর গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের মার খাওয়ার ঘটনার এখন আর কোনো সংবাদমূল্য নেই। জোসনা এখন আমাদের ‘সাবজেকট’ নয়—সে এখন দূরের কোনো ঝাপসা ছবি। তবুও জোসনা টুডুকে পাশ কাটিয়ে শুধু ইটভাটার স্টোরি করা গেল না। জোসনার মুখেই শুনলাম শহীদ মঙ্গল মার্ডির স্ত্রী সান্তিনা টুডু এখন একাই থাকেন। ভিক্ষা করেন পথে পথে। আরেক শহীদ শ্যামল হেমব্রমের স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এখন বাস করেন রাজশাহীতে, কোনো এক আত্মীয়ের দয়ায়।

‘ইমন তো হবার লয়’ বলে জোসনা। তাকে মনে করিয়ে দিই সরকারের প্রতিশ্রুতির কথা, নিহত মঙ্গল মার্ডির পরিবারকে সাবেক এক বিচারপতির টাকা দেওয়ার কথা। জোসনা জানায়, বিচারপতির দেওয়া টাকা চলে যায় মঙ্গল মার্ডির জামাতার পকেটে। বিধবা সান্তিনার কাছে আসেনি সে টাকা।

কী ঘটেছিল সেদিন?
পাকিস্তান আমলে (১৯৬২) গোবিন্দগঞ্জের রংপুর চিনিকলের নামে হুকুমদখল জমির ফসল কাটা নিয়ে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, বহিরাগত সন্ত্রাসী ও পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। সাঁওতালদের অভিযোগ, পুলিশ–প্রশাসনসহ স্থানীয় সন্ত্রাসীরা সাঁওতালদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের জন্যই ওই হামলা চালায়। সেদিন সাঁওতালদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে আটজন পুলিশ সদস্য ছিলেন বলে পুলিশের দাবি। চারজন সাঁওতাল গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু মারা যান। এই সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে সাঁওতালদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হলে গৃহহারা সাঁওতালরা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়। এমনকি সাঁওতাল শিশুদের স্কুলও পুড়িয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। এসব অন্যায়–অত্যাচারের প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠেন সারা দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

মানুষ কেন ফুঁসল হঠাৎ?
দেশ স্বাধীন হলেও এ দেশের গরিব ক্ষমতাশূন্য মানুষ আদিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এখনো ব্রিটিশ পুলিশ, পাকিস্তানি সেনা–আমলা আর রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে যেমন ব্যবহার পেত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও খারাপ আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পাহাড়ে, সমতলে, চরে, হাওড়ে এবং বস্তিতে, মহল্লায় তাদের গায়ে হাত তোলা, তাদের নারীদের যৌন নির্যাতন করা, সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে উল্টো মামলা দিয়ে পথে বসিয়ে দেওয়া বা মামলা–হামলায় জেরবার করা তো নিত্যদিনের ঘটনা। তাহলে তখন কেন বড় প্রতিবাদ হলো? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ছোট্ট এক জানালা দিয়ে মানুষ দেখে ফেলে সাঁওতালদের বাড়িঘরের পাশে দাঁড়িয়ে একদল পুলিশ কাঁদানে গ্যাস আর গুলি ছুড়ছে।

দেশের মানুষের রক্ত ঘাম করা করের পয়সায় কেনা হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটে পরে একদল পুলিশ সাঁওতালদের বাঁশ ও ছনের তৈরি ঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। সে দৃশ্য ফটোশপের কারসাজি ছিল না। বিদেশি একটা টিভি চ্যানেলের দাক্ষিণ্যে সেসব অবিশ্বাস্য দৃশ্য সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলে। ঢি ঢি আর ছি ছি–তে কান পাতা দায় হয়ে যায়। সেসব কারণেই কম্বলে নাক–মুখ ঢেকে শুয়ে থাকারা একটু নড়েচড়ে বসেন দেশে-বিদেশে, তুমুল সমালোচনার ঝড়ে তাঁরাও বুদ্‌বুদ তোলেন, শামিল হন। সেই ঝড়ের নানামুখী চাপে ঘটনার মাস চারেক পর পুলিশের মহাপরিদর্শকের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালের মার্চে একটি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়। তাতে সরাসরি অগ্নিসংযোগে যুক্ত পুলিশের দুই সদস্যকে চিহ্নিত করে সাময়িক বরখাস্ত করা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। পাশাপাশি ঘটনার দিন সেখানে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৫৮ সদস্যকে প্রত্যাহার করার কথাও লেখা ছিল সেই প্রতিবেদনে।

ইতিহাস কী বলে
গত শতকের ষাটের দশকে উন্নয়নের যোশে মাতোয়ারা তখন পাকিস্তান। নিজেকে মার্কিন সাহায্যপুষ্ট এক শক্তিশালী রোল মডেল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বুঁদ তার রাষ্ট্রনেতা আইয়ুব খান। গণতন্ত্রের ঝুট–ঝামেলাকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের চৌবাচ্চায় কীভাবে দেশের মানুষকে নাকানিচুবানি খাওয়ানো যায়, তার ফর্মুলা তখন খোঁজা হচ্ছিল। বড় বড় প্রজেক্ট—আজকের উন্নয়নের ভাষায় যাকে মেগা প্রজেক্ট বলে, সেটা তখন পাকিস্তানের ওপর ভর করেছিল। বড় বড় কারখানার জন্য বড় বড় টুকরার জমি দরকার। এসব জমির ক্ষুধা মেটানোর সহজ টার্গেট হয় প্রান্তিক মানুষ—আদিবাসী। তারপরও বলতে হবে পূর্ববঙ্গের মানুষের জ্বলে ওঠার ইতিহাসের ভয়ে ভীত হয়েই হোক বা জননেতাদের হাতে রাখার চেষ্টায় হোক পাকিস্তানিদের নেই নেই করেও কিছু চক্ষুলজ্জা ছিল।

জমি অধিগ্রহণের চুক্তিপত্রে তারা নীলকর সাহেবদের দেখানো পথ অনুসরণ করে। বলে, যে কাজের জন্য জমি নেওয়া হচ্ছে সেই কাজ না হলে জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র (মেমোরেন্ডাম) ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই লিখিত এবং পঠিত হয়। ওই চুক্তিপত্রে উল্লেখ আছে যে ১৮৪২.৩০ একর সম্পত্তি রংপুর সুগার মিলের আখ চাষ করার জন্য নেওয়া হলো। ওই জমিতে আখ চাষের পরিবর্তে অন্য ফসল চাষ করা হলে অধিগ্রহণকৃত জমি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন সরকারের হাতে তুলে দেবে এবং সরকার তা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে পারবে।

রংপুর সুগার মিল অনেক দিন আগে থেকে চুক্তিভঙ্গ করে স্থানীয় জোতদার ব্যবসায়ীদের কাছে জমি বন্ধক (লিজ) দেয় এবং তারা তাদের খেয়ালখুশি মতো জমি ব্যবহার করতে থাকে। ফলে সাঁওতাল এবং ভূমিহীন বাঙালি পরিবার, যাদের বাপ–দাদারা এই জমি সরকারকে নামমাত্র মূল্যে দিয়েছিলেন, তাঁরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বিষয়টি তদন্ত করে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ফেরত পাওয়ার আবেদন করেন। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন বিষয়টি তদন্ত করে এবং সাঁওতালদের দাবির সত্যতা খুঁজে পায় এবং আলেয়া খাতুন (উপসচিব) অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) গাইবান্ধা স্বাক্ষরিত তদন্ত প্রতিবেদনের ফলাফল সরকারের কাছে প্রেরণ করেন। যার স্মারক নং- ০৫.৫৫.৩২০০.০৩০.০০.০০১.১৫-৪১। কিন্তু সরকার সেই জমি আর আবেদনকারীদের ফেরত দেয়নি। ফলে আন্দোলন ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না।

আন্দোলনের ঢোলে বাড়ি দেন সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদেরা। আন্দোলন বেগবান হয়। কিন্তু নিজেদের অজান্তেই সাঁওতাল আর ভূমিহীন বাঙালিরা আরেকবার পাতা ফাঁদে আটকে যায়। প্রথমে সংসদ আবুল কালাম আজাদ এবং সাপমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল সাঁওতালদের এই বলে স্বপ্ন দেখান যে যেহেতু রংপুর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ ভূমি অধিগ্রহণের চুক্তি ভঙ্গ করেছে এবং আখের সঙ্গে অন্য ফসল চাষ করার জন্য সুগার মিলের জমি অন্যায়ভাবে স্থানীয় জোতদার ব্যবসায়ীদের কাছে লিজ দিয়েছে, সেহেতু তাঁরা মিছিল–মিটিং করলে আর নেতাদের নির্বাচিত হতে সাহায্য করলে তাঁরা তাঁদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি ফিরে পাবেন। কিন্তু এই দুজনকে নির্বাচনের পর সাঁওতালদের পাশে পাওয়া যায়নি। বরং এই দুই জনের ক্যাডার বাহিনী সাঁওতালদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে বলে অভিযোগ আছে। একপর্যায়ে প্রশাসন তাঁদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেন।

কী হয়েছিল তারপর
স্কুল পুড়িয়ে, ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে, গুলি করে, মানুষ মেরেও কোন কাফফারা দিতে হয়নি কাউকে। ফুঁসে ওঠা জনমত আর সোচ্চার গণমাধ্যমের কারণেই হয়তোবা ২০১৭ সালের শুরুর দিকে দুটি তদন্তের খবর প্রকাশিত হয়, একটা বিচার বিভাগীয় আরেকটা পুলিশের তদন্ত। হাইকোর্টের নির্দেশে (রিট পিটিশন নম্বর -১৪৪০২/২০১৬ এর ১৪/১২/ তারিখ) এই আগুন লাগানোর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দায়িত্ব পান গাইবান্ধার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহিদুল্লাহ। এক মাস অনুসন্ধান করে ১০৬ জন সাক্ষীর জবানবন্দি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং আগুন লাগানোর ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে (২৯.০১.১৭) তদন্ত প্রতিবেদনে তিনি কিছুসংখ্যক স্থানীয় বাসিন্দা এবং তিনজন পুলিশ সদস্যের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পান। এর মধ্যে সেই পুলিশ সদস্য, যাঁকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত পরে পঞ্চগড় জেলায় সংযুক্ত করা হয় তিনিও ছিলেন। অন্যদিকে পুলিশের তদন্তের ভিত্তিতে গাইবান্ধার দুজন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং অন্য জেলায় সংযুক্ত করা হয়।

ঘটনার ২০ দিন পর ২৬ নভেম্বর থোমাস হেমরম বাদী হয়ে সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, সাপমারা ইউপি চেয়ারম্যান বুলবুল আহম্মেদসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫০০–৬০০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে একটি মামলা করেন। অপর দিকে পুলিশি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে গোবিন্দগঞ্জ থানার তৎকালীন এসআই কল্যাণ চন্দ বাদী হয়ে ৪২ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ৩০০-৪০০ জনকে আসামি করে গোবিন্দগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন।

এখন কী হচ্ছে
রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘা জমি কবিতার অন্তিম পঙ্‌ক্তি যেন লিখেছেন আমাদের পুলিশের কর্মকর্তারা। দীর্ঘদিন পর যে চার্জশিট তাঁরা দিয়েছেন, তা পড়ে ভুক্তভোগী সাঁওতালদের একজন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে বলেছেন, ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আমি আজ চোর বটে।’ যারা সাঁওতালদের ওপরে গুলি করেছিল এবং বাড়িঘরে আগুন দিয়েছিল, তাঁরা বাদ পড়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অভিযোগপত্রে। আসামি হয়েছেন ৩৯ জন ভুক্তভোগী। যাঁদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, গুলিতে যাঁরা নিহত-আহত হয়েছেন, এবার তাঁরা আসামি!

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের যাঁরা কথা বলেছেন, তাঁরা জানেন, এঁরা কেউ সরকারের সাহায্য চান না, চান সরকার তাঁদের স্বজন হত্যার বিচার করবে এবং পূর্বপুরুষের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবে।
nayeem5508 @gmail.com