মারাঠা সিকান্দারের মগজাস্ত্র

শারদ পাওয়ার। ছবি: রয়টার্স
শারদ পাওয়ার। ছবি: রয়টার্স

মহারাষ্ট্রের মহানাটকের শেষ দৃশ্যে কার চওড়া হাসি কান ছুঁয়ে গেল, চোখে আঙুল দিয়ে আজ আর তা কাউকে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ভারতীয় ধ্রুপদি রাজনীতির শেষ যে কজন এখনো বর্তমান, ৭৯ বছরে পা দিতে যাওয়া অদম্য মারাঠা শারদ পাওয়ার সেই ‘দ্য লাস্ট অব দ্য মোহিকান্স’। বারবার অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে কীভাবে প্রাসঙ্গিক থাকতে হয়, তিনি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। মহারাষ্ট্র কুনাট্যের ‘পোস্টমর্টেম’ করতে গিয়ে বিজেপির এক প্রবীণ নেতা তাই স্বীকার করেছেন, ‘ঘুমন্ত সিংহকে খোঁচা দিয়ে জাগানোর মাশুল আমাদের গুনতে হলো।’

এই স্বীকারোক্তিই বুঝিয়ে দিচ্ছে, মহারাষ্ট্রের এই ‘মহা মিস অ্যাডভেঞ্চারে’ হার কাদের হলো। দিনের আলোর মতো আজ এটা স্পষ্ট, বিজেপির সর্বগ্রাসী ক্ষুধা কর্ণাটকের পর মহারাষ্ট্রেও তাদের অসম্মানের পাকে ঠেলে নামিয়েছে। গত এক মাস প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর ‘ম্যান ফ্রাইডে’ অমিত শাহ মহারাষ্ট্র নিয়ে একবারের জন্যও মুখ খোলেননি। অথচ তাঁরাই ছিলেন এই নাটকের পরিচালক। ৩০ বছরের জোটসঙ্গী শিবসেনাকে শিক্ষা দিতে শারদ পাওয়ারের উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভাইপো অজিতকে হাতিয়ার করে এনসিপি দলে যে অভ্যুত্থান তাঁরা ঘটাতে চেয়েছিলেন, তা ব্যর্থ হওয়ায় গত পাঁচ বছরের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাডনবিশকে আজ সহজেই তাঁরা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন। গোটা দেশ কিন্তু কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মোদি-শাহ জুটির ‘ঔদ্ধত্য ও সর্বগ্রাসী’ মনোভাবকে। স্পষ্ট করেই আজ সবাই বলছে, অত্যাশ্চর্যীয় এই দ্বৈরথ ছিল প্রকাশ্য শারদ পাওয়ারের সঙ্গে ‘মেঘনাদ’ অমিত শাহর। 

ভারতীয় গণতন্ত্রের মাধুর্য এটাই, শেষ বিচারে জয়ী সংবিধান ও বিচার বিভাগ। পরাজয় মেনে নিয়ে যেদিন দেবেন্দ্র ফাডনবিশ মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিলেন, সেদিনই ছিল ভারতীয় সংবিধানের ৭০তম বার্ষিকীর উদ্‌যাপন। ২৬ নভেম্বরের (মঙ্গলবার) সেই সকালেই সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেন, বুধবারের মধ্যে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে নতুন সরকারকে গরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে হবে। ঘুমন্ত সিংহ শারদ পাওয়ার ততক্ষণে খেলাটা শেষ করে এনেছেন। ক্ষমতা ও অধিকারের অপব্যবহার ঘটিয়ে মোদি-শাহ জুটি যাতে স্পিকার নিযুক্ত করে কাঁচা ঘুঁটি পাকা করতে না পারেন, সুপ্রিম কোর্ট সে জন্য প্রোটেম স্পিকার নির্বাচনের কথাও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন। সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ই ছিল বিজেপির কফিনের শেষ পেরেক। পরের ঘটনাবলি সবার জানা। 

মহারাষ্ট্রীয় মহানাটক মঙ্গলবার সকাল থেকে যখন অতি দ্রুত শেষ দৃশ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে, তখনই অত্যাশ্চর্য আরও একটা ঘটনা ঘটে যায়। সংবিধানের ৭০ বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন বয়কট করে দেশের প্রায় সব বিরোধী দল। সংসদ ভবনে সংবিধানপ্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকরের মূর্তির পাদদেশে হাজির হয়ে তাঁরা সংবিধান ‘অবমাননা ও নিরন্তর চৌপাট’ করে দেওয়ার অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করান খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। সোনিয়া গান্ধী, মনমোহন সিংরা সংবিধান পাঠ করে প্রতিবাদে শামিল হন। গোটা দেশ শুধু তা প্রত্যক্ষই করল না, সংবিধান অবমাননার মধ্য দিয়ে বিজেপি কীভাবে মহারাষ্ট্রে নতুন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর ডেপুটিকে শপথ গ্রহণ করিয়েছিল, তা–ও বুঝে গেল। যে প্রচারমাধ্যম এত দিন ধরে নিরন্তর ‘মোদি-নাম জপ’ করে এসেছে, তারাও সংবিধানের এই নির্লজ্জ অপব্যবহারের কথা সাতকাহন করে প্রচার করল। এই প্রথম এমন সমালোচনার কোনো গ্রহণযোগ্য জবাব বিজেপি নেতারা দিতে পারলেন না! এমন ঘটনাও বিরল। 

অথচ প্রশ্নগুলো যথার্থ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে শনিবার ভোর পাঁচটায় কেন সংবিধানের ১২ ধারা অনুযায়ী জরুরি ক্ষমতার প্রয়োগ করে মন্ত্রিসভার বৈঠক না ডেকেই মহারাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রপতির শাসন প্রত্যাহার করতে হলো? কেন ভোর সাড়ে পাঁচটায় রাষ্ট্রপতিকে জাগিয়ে সেই নির্দেশে সই করানো হলো? কেনই–বা রাজ্যপালকে সকাল পৌনে আটটায় তড়িঘড়ি দেবেন্দ্র ফাডনবিশ ও অজিত পাওয়ারকে শপথবাক্য পাঠ করানো হলো? দেশে তো অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করার মতো অবস্থা ছিল না? দেশ আক্রান্তও হয়নি? তাহলে? সংবিধান অবমাননার এই অভিযোগের কোনো জবাব এখনো মোদি-শাহ জুটির কাছে নেই। তাঁরা না চাইলে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নই উঠত না। এই অবিবেচনা এবং তাড়াহুড়ো স্রেফ এটাই প্রমাণ করে, বিজেপির কাছে মহারাষ্ট্র ছিল মহামূল্যবান। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য এবং অর্থনৈতিক রাজধানীকে পাঁকাল মাছের মতো আঙুল গলে চলে যেতে দিতে নিতান্তই নারাজ ছিলেন তাঁরা। সত্যকে অনুধাবনও তাঁরা করতে চাননি। অবমূল্যায়ন করেছিলেন আহত মারাঠা শারদ পাওয়ারের ক্ষমতাকেও। 

অথচ এই শারদ পাওয়ার অতীতে একাধিকবার বিজেপিকে সঙ্গ দিয়েছেন। কিন্তু এবারের ভোটে মোদি-শাহ জুটি তাঁকে ‘বিলো দ্য বেল্ট’ আঘাত দিতে ছাড়েনি। নির্বাচনী প্রচার চলাকালে তাঁর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক দুর্নীতির তদন্ত শুরু করানো হয়েছে। হাজিরা দেওয়ার জন্য সমন জারি হয়েছে। পাওয়ারের খাসতালুক বারামতী কেড়ে নিতে টাকার বন্যা বইয়েছে। তাঁর দলের ৩০ জন নেতাকে ভাঙিয়ে ভোটে টিকিট দেওয়া হয়েছে। বাধ্য হয়ে অসুস্থ ও অশক্ত এই মারাঠা নেতাকে বলতে হয়েছে, ‘মারাঠারা কোনো দিন দিল্লির কাছে মাথা নোয়ায়নি। এবারেও মাথা নত করবে না।’ নির্বাচনে অপমানের জবাব দেওয়ার পর ভাইপোকে ভাঙিয়ে ষড়যন্ত্রের জবাব দেওয়ার সময় শারদ পাওয়ার মোদি-শাহ জুটিকে মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি, ‘মহারাষ্ট্র মোটেই গোয়া বা মণিপুর নয়।’ 

নীতি ও রাজনীতির সংঘাত চিরকালের। মহারাষ্ট্রীয় এই কুনাট্য প্রধানমন্ত্রীর বড় মুখ করে বলা ‘না ম্যায় খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’-র অঙ্গীকারকেও শূন্য কলসের আওয়াজ প্রতিপন্ন করল। এ নিয়ে কদিন ধরে প্রচুর কৌতুকও চলছে। চলবেইবা না কেন? নির্বাচনী প্রচারে দেবেন্দ্র ফাডনবিশের বলা সেই কথাটা ভাইরাল হয়ে গেছে, যেখানে তিনি ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ অজিত পাওয়ারকে গালমন্দ করে বলছেন, এবার মুখ্যমন্ত্রী হলে আর্থার জেলে বসে ওঁকে ‘চাক্কি পিসিং পিসিং অ্যান্ড পিসিং’ করতে হবে। ক্ষমতা ধরে রাখার তীব্র বাসনায় সেই অজিত পাওয়ারকে উপমুখ্যমন্ত্রী করার প্রস্তাবে সায় দিয়ে মোদি-শাহ জুটিও তাঁদের হাস্যকর করে তুললেন। প্রমাণ করলেন, শুধু মাছরাঙাই নয়, সব পাখিই মাছ খায়। 

আরও দুটি সিদ্ধান্ত মোদির ‘সৎ ও স্বচ্ছ’ প্রশাসনের দাবিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। হরিয়ানায় সরকার গড়ার তাগিদে প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দুষ্মন্ত চৌটালার হাত ধরার পরের দিনেই দিল্লির তিহার জেলে থাকা তাঁর অপরাধী বাবা অভয় চৌটালা প্যারোলে মুক্তি পান। এবারও ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ অজিত পাওয়ারকে উপমুখ্যমন্ত্রী করার দিনেই তিনি মন্ত্রী থাকাকালে সেচসংক্রান্ত নয়টি দুর্নীতির মামলা রাজ্য সরকার প্রত্যাহার করে নিল! দুটি ঘটনাই কি নিছকই কাকতালীয়? কী জানি, হবেও বা। 

মহারাষ্ট্রে বিজেপির অসফল অভিযান কংগ্রেসকেও টেনে এনেছে আতশি কাচের তলায়। শিবসেনার বিদ্রোহ দেখা সত্ত্বেও এই দল তাদের কোনো পরিকল্পনাই আগে থেকে ছকে রাখতে পারেনি। এই বিলম্ব এবং সিদ্ধান্তহীনতা শারদ পাওয়ারকে নেতৃত্ব গ্রহণের বাড়তি সুযোগ এনে দেয়। প্রথম থেকেই সোনিয়া গান্ধী ‘প্রথম শত্রু ও প্রাথমিকতা’ ঠিক করে ফেলতে পারলে জোটের নেতৃত্বের রাশ প্রবীণ পাওয়ারের হাতে তুলে দিতে হতো না। তাঁর এই অদ্ভুত দোলাচল দিনের শেষে শারদ পাওয়ারকেই জয়ীর আসনে বসতে সাহায্য করেছে। 

আকর্ণবিস্তৃত হাসি হাসছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ শারদ পাওয়ার। আজ তাঁর হাসারই পালা। পরিবার সামলে, দল সামলে, জোট সামলে এখন তিনিই হয়ে দাঁড়িয়েছেন বিজেপিবিরোধিতার প্রতীক। মারাঠা এই ‘মুকাদ্দর কা সিকান্দারকে’ কেন্দ্র করে দেশের বিজেপিবিরোধী রাজনীতি এখন আবর্তিত হয় কি না, মহারাষ্ট্রীয় কুনাট্যের যবনিকা পতনের সঙ্গে সঙ্গে সেই আগ্রহ জন্ম নিল।  

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি