হোলি আর্টিজান হামলা: বিচার, রায় ও টুপি-সমাচার

রায় শেষে বের হওয়ার সময় মাথায় ‘আইএসের টুপি’ পরে ছিলেন রাকিবুল হাসান। গত বুধবার আদালত প্রাঙ্গণে। ছবি: প্রথম আলো
রায় শেষে বের হওয়ার সময় মাথায় ‘আইএসের টুপি’ পরে ছিলেন রাকিবুল হাসান। গত বুধবার আদালত প্রাঙ্গণে। ছবি: প্রথম আলো

তিন বছরের বেশি সময় আগে হোলি আর্টিজান বেকারিতে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ ও নৃশংস কথিত জঙ্গি হামলার ঘটনার বিচার এক বছরে শেষ হয়েছে। বিচারে অভিযুক্ত আটজনের মধ্যে সাতজনকে ওই হামলার সঙ্গে সরাসরি অথবা নেপথ্যে যুক্ত থাকার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং একজনকে (বড় মিজান বলে পরিচিত) খালাস দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের বিচার অবশ্য এটাই প্রথম নয়। ২০০৭ সালে জেএমবির শীর্ষ চার নেতার ফাঁসি হয়েছিল। তবে হোলি আর্টিজানে প্রত্যক্ষ হামলাকারীদের সবাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছেন। পরে এই হামলার পরিকল্পনা ও অন্যান্য বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত এবং নব্য জেএমবি বলে কথিত বেশ কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে মারা গেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন এর শীর্ষ নেতা ও হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত তামিম চৌধুরী। এদের সঙ্গে আইএসের (ইসলামিক স্টেট) সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রমাণিত, তবে সরকার হয়তো নানা বিবেচনায় বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করছে না।

হোলি আর্টিজানে যে ধরনের হামলা হয়েছে তা সামলানোর অভিজ্ঞতা বা প্রস্তুতি পুলিশ বা বেসামরিক বাহিনীর ছিল না। এ কারণেই সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানের প্রয়োজন হয়েছিল। বাংলাদেশ তো বটেই, সমগ্র বিশ্বই এ ঘটনায় আলোড়িত হয়। আইএসের সরাসরি যুক্ততা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না যে হত্যাকারীরা আইএসের আদর্শকে ধারণ করেই এ হামলা চালিয়েছিল। আইএসের কালো পতাকা ও মাথায় কালো স্কার্ফ ব্যবহার করে সমগ্র বিশ্বকে তারা তার জানান দিয়েছিল।

তিন বছরে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা অনেক বেড়েছে সন্দেহ নেই, তবে এখন পর্যন্ত আইএসের উদ্বুদ্ধকরণের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে কতটা ওয়াকিবহাল হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে। রায় ঘোষণার দিন এর কিছুটা প্রমাণ মিলেছে। আমরা দেখলাম বিচারে ফাঁসির দণ্ড হয়েছে, এমন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে তা নিয়ে কোনো বিকার নেই। ধর্মীয় উন্মাদনাকে ব্যবহার করে তাদের কোন পর্যায়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে তা টের পাওয়া যায়। তারা এমন প্রশিক্ষণ পায় যাতে এ ধরনের পরিণতির জন্য তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে। হোলি আর্টিজানে হামলার সময়ও দেখা গেছে, জঙ্গিরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ঠান্ডা মাথায় সাহ্রি খেয়ে রোজা রেখে সকালে মৃত্যুর অপেক্ষায় ছিল। কাজেই ফাঁসি এদের বিশ্বাস অনুযায়ী সহজে শহীদ হওয়ার পথ। আর বিচার–প্রক্রিয়ায় যুক্তদের জঙ্গিরা ‘তাগুতি’ শক্তি মনে করে। যে কারণে কোর্টের ভেতরে হইচই এবং বাইরে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে তারা পিছপা হয় না।

২৭ নভেম্বর দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণে সাজাপ্রাপ্ত সবাইকে যে পোশাক আর যে শারীরিক ভঙ্গিতে দেখা গেছে, তাতে তারা তাদের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে হাসিল করেছে বলা যায়। সন্ত্রাস, বিশেষ করে ধর্মীয় সন্ত্রাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা ও পড়াশোনা করেন, তাঁরা জানেন যে এদের সব ধরনের কর্মকাণ্ডের অন্যতম লক্ষ্য হলো প্রচারণা এবং প্রচারণার মাধ্যমে তাদের অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করা। এই প্রচারণায় তারা শতভাগ সফল হয়েছে। আইএসের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে তারা আইএসের পতাকার সামঞ্জস্যপূর্ণ টুপিও মাথায় দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী এ প্রচারণা যে আইএসের অনুসারীদের আরও উদ্বুদ্ধ ও প্রেরণা দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশিত।

আইএস যেভাবে টুইটার, ফেসবুকসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তা শুরুতে বিশ্বের বহু সরকারও চিন্তা করেনি। স্কাইপেসহ ভিডিও, অডিও ব্যবহারে এরা পারদর্শী এবং সুযোগ খোঁজে প্রচারণার। আইএসের প্রচারণা স্লোগান হলো, ‘আমাদের সম্বন্ধে অন্যের কাছ থেকে শুনো না, আমাদের শোনো।’ এ বাস্তবতায় যেভাবে আমাদের সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রতিযোগিতা করে তাদের শারীরিক ও অন্যান্য আচরণ ও বক্তব্য দেখিয়েছে, জঙ্গিরা হয়তো সেই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। দেখা যাচ্ছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান ও পরে জাহাঙ্গীরের মাথায় আইএসের কালো পতাকা বা তা দিয়ে বানানো টুপি পরার বিষয়টিই এখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত নিরাপত্তা ও শক্ত জেল কোডের মধ্য দিয়ে এ ধরনের টুপি কীভাবে এল? এর তদন্ত হবে বলে ঘোষণা এসেছে, কাজেই অনুমাননির্ভর কথা বলা ঠিক হবে না। এই কালো টুপি, যা আইএসের প্রতীক—তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অক্ষমতা বা উদাসীনতার কারণেই তারা প্রদর্শন করতে পেরেছে বলে আমার বিশ্বাস।

এই টুপি ব্যবহার করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিরা বিশ্ববাসীর কাছে তাদের আদর্শ প্রচারে সার্থক হয়েছে। আফ্রিকার মালি, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া বা সিরিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া, যেখানে আইএস ভিন্ন নামে ভীষণ তৎপর, এসব দেখে তারা নিঃসন্দেহে উদ্বুদ্ধ হবে। এ বিষয় তুলে ধরার কারণ হচ্ছে এসব নিয়ে আমরা সম্ভবত এত গভীরভাবে কখনো চিন্তা করিনি বা এখনো করি না।

হোলি আর্টিজানের অনেক আগে থেকে, বিশেষ করে বাংলা ভাইসহ জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক এবং বিচারকার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশনের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল। তখনো আমাদের মতো অনেকেই এ ধরনের প্রচারণার সুযোগ বন্ধ করতে ‘সন্ত্রাস মোকাবিলায় গৃহীত নীতি’র মধ্যে সংবাদমাধ্যম–সংক্রান্ত নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করার কথা বহুবার আলোচনায় ও লেখায় তুলে ধরেছেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না, এ বিষয়কে নীতিনির্ধারকেরা গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছেন। ২৭ নভেম্বর হোলি আর্টিজানে হামলার রায় দেওয়ার পর সারা দিন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আইএসের টুপির বিষয়টি যেভাবে সচিত্র প্রচার পেল, তাতে শাস্তির চেয়ে কথিত আইএস সদস্যদের মানসিক শক্তি, শারীরিক ও প্রতীকী শক্তিই যেন গুরুত্ব পেল। এ ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশ্বের কোনো দেশ হামলাকারীদের এ ধরনের ছাড় দেয় না। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপে এ ধরনের হামলার ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কখনো এভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। নিউজিল্যান্ডে হামলাকারীর বিচারের পরও বিশদভাবে তাকে নিয়ে আলোচনাও হয়নি।

আমি এ আলোচনা শেষ করতে চাই দু-একটি পর্যবেক্ষণ ও আমার ব্যক্তিগত সুপারিশ দিয়ে। হলি আর্টিজান মামলার রায়-পরবর্তী ব্যবস্থাপনায় প্রচুর ত্রুটি চোখে পড়েছে। হাজার হাজার উৎসুক জনতাকে কোনোভাবেই আসামিদের এত কাছে আসতে দেওয়া উচিত হয়নি। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কোনো বিপদ ঘটেনি তার মানে এই নয় যে হতে পারে না। সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্যই নিরাপত্তা নিশ্চয়তার অন্যতম কৌশল। দ্বিতীয়ত, এতসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা আদৌ ছিল কি না। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অন্য অভিযুক্তদের মতো পোশাকে আদালতে নিয়ে আসা ও নিয়ে যাওয়া হয়নি। কেন, তার জবাব কর্তৃপক্ষই দিতে পারবে। তৃতীয়ত, আমার বিশ্বাস, আইএস তথা অন্যান্য সংগঠনের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৃণমূল পর্যায়ের সদস্যদের তেমন ধারণা দেওয়া হয়নি। দেওয়া হলে টুপি ও অন্যান্য বিষয়ে তাঁরা সাবধান হতেন।

আমাদের সমস্যা যে আমরা জটিল বিষয়কে যথেষ্ট সরলভাবে দেখি। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে গভীরে বিশ্লেষণ করার সামর্থ্য তৈরি হয় না।

বিশ্বব্যাপী এ ধরনের ধর্মীয়ভাবে উদ্বুদ্ধ যে সংগঠনগুলো রয়েছে, তার উত্থানের পেছনে রয়েছে শত শত বছরের আন্তধর্মীয় সংঘাতের ইতিহাস। যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্তমানে ক্রুসেড বনাম জিহাদ–তত্ত্ব। এর জের পড়েছে আমাদের মতো দেশে। তবে বাংলাদেশে এ ধরনের উত্থানকে জনগণ যেমন প্রশ্রয় দেয়নি, তেমনি সরকার এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এটা এক বড় স্বস্তির বিষয়। তবে সবকিছুর পর বলতে চাই, জঙ্গিদের মোকাবিলায় আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বিক সাফল্য প্রশংসনীয়। বিশেষ করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তবে আত্মতৃপ্তির কোনো জায়গা নেই। আশা করব আমাদের এবারের ব্যবস্থাপনাগত এই ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে সেগুলো শুধরে ফেলা হবে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে অনারারি ফেলো এসআইপিজিএনএসইউ
[email protected]