রবিউলের চলে যাওয়া ও নাগরিকের নাট্যোৎসব

দুই দিন ধরে বড় অস্থির হয়ে আছি। না, দেশের কোনো রাজনীতি নিয়ে নয়। আমার মনের এই অস্থিরতা একেবারে নেহাতই আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি। আমি নিজে ভালো নেই বেশ কিছুদিন ধরে। এই তো গতকালই ফিরলাম হাসপাতাল থেকে। তবু সেটাকে তুচ্ছ করে দেওয়া যায়, অবজ্ঞা করা যায়। জীবনকে রুখে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে বলা যায় এসো দেখি, কত বড় শক্তি তুমি! কিন্তু কিছু ঘটনা আমাদের হাতে থাকে না এবং সেগুলো ঘটে চলে। এই সব ঘটনা হৃদয়ের ভেতরটাকে নিংড়ে-মুচড়ে একেবারে লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। এরপর একটা বিধ্বস্ত অবস্থা বিরাজ করে। হয়তো কিছুদিন, নয়তো বছর বছর ধরে। এই রকমই হঠাৎ হয়ে গেল আমার জীবনে।

কবি, স্থপতি রবিউল হুসাইন চলে গেলেন। অথচ যাওয়ার তো কথা ছিল না। সেই যে দেখা হলেই কোনো আনুষ্ঠানিকতার ধার না ধেরে ‘ভাই’ বলে সুমিষ্ট সম্বোধনটি! তারপর সবই ভালো কথা, সবই আনন্দের কথা। চিত্রকলা, কবিতা, স্থাপত্য, জীবন, ধ্রুপদ, মুক্তিযুদ্ধ—কী নেই সেই আড্ডায়? এই সেদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি বলছিলেন, আমরা তো সবাই বুড়িয়ে গেলাম। এখন জাদুঘরটিকে ধরে রাখার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের থেকে একটা পরিচালনা পর্ষদ তৈরি করা প্রয়োজন। বুড়িয়ে গেলাম? একটা ধাক্কা খেয়ে নিজেদের চেহারাগুলো আয়নায় দেখতে শুরু করলাম। হ্যাঁ, বৃদ্ধ তো হয়েছি বটেই। স্থান ছেড়ে দিতে হবে। ভাবতে লাগলাম, কে আগে এবং কে পরে। রবিউলের চেহারাটা আয়নায় ভেসে উঠতেই মনে হয়েছিল, না, ওঁর মতো আনন্দ–ভালোবাসাপিয়াসী মানুষ সহজে যাওয়ার নয়। সেই রবিউলই আমাদের আগেই একেবারে চলে গেলেন।

মানুষকে বিভিন্ন মানসিকতার মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে হয়। কিন্তু রবিউলকে কখনো উষ্মা প্রকাশ করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সবাইকে বুকে টেনে নিতে জানতেন তিনি। অতি বড় বিপদের সময়েও মিষ্টি হাসিমাখা মুখ নিয়ে বলতে পারতেন, ‘দেখি কী করা যায়।’ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আমরা আটজন ট্রাস্টির মধ্যে একমাত্র নারী সারা যাকের। জাদুঘরের বাইরে সারার সঙ্গে রবিউলের দেখা হতো না হয়তো। প্রথম যেদিন দেখা হলো, সেদিন রবিউল ঈষৎ হেসে বললেন, ‘আমরা সাত ভাই চম্পা, আপনি আমাদের এক বোন পারুল।’ সেই সম্বোধনটাই রয়ে গিয়েছিল শেষ সাক্ষাৎ পর্যন্ত।

মুশকিল হলো, এই সব অমৃতের সন্তানেরা চলে যান। আমরা তাঁদের বেমালুম ভুলে যাই। ভুলে যাই, সমাজটা যে এখনো ইতিবাচক পথে চলছে, তা সম্ভব হয়েছে এই রকম কয়েকজন হাতে গোনা ভালো মানুষের জন্যই। রবিউল সর্বদা নিজের ওপরে সবাইকে রেখেছেন। নিজের দুঃখ-কষ্ট নিজের মধ্যেই মোড়কবদ্ধ রেখে অন্য সবাই ভালো আছে কি না, সেই চিন্তাতেই মগ্ন হয়ে থাকা! রবিউল চলে গেলেন। এই বিপুল বিশ্বে একটি ভালো মানুষ কমে গেল!

নাগরিকের নাট্যোৎসব চলে এল। এবারে একটু ভিন্ন চরিত্রের উৎসব হতে যাচ্ছে এটা। সিদ্ধান্ত ছিল ৪৫–৪৬ বছর ধরে নাটক এবং উৎসব তো করে আসছি, এখন বোধ হয় আমাদের ওপরে এটাই বর্তায় যে আমাদের পরবর্তী যে তরুণ নাট্যজনেরা প্রাণাতিপাত করছেন মঞ্চের আলো-আঁধারিতে, তাঁদের কাজগুলোকে আমাদের শিল্পবোদ্ধাদের সামনে তুলে ধরার। এই অভিপ্রায় নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে সাত দিনের একটি উৎসব হবে, যেখানে সাতটি নতুন নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হবে। এই সাতটির মধ্যে বাংলাদেশের তরুণ দলগুলোর মধ্য থেকে পাঁচটি নাটক এবং নাগরিকের দুটি নাটক মঞ্চায়নের জন্য নির্বাচিত হবে। এরপর আমরা মেধাবী তরুণদের আহ্বান করেছি আগ্রহী হলে তাঁদের পাণ্ডুলিপিগুলো আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের ডাকে তাঁরা সবাই সাড়া দিয়েছেন। যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পাঁচটি নাটক নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছে।

আজ অপরাহ্ণে একা বসে বসে ভাবছিলাম প্রায় পাঁচ দশকের কথা। কত লম্বা পথ হেঁটে চলেছি নাটকের পথে। নানা ধরনের নাট্যসুহৃদদের হাতে হাত ধরে। কত বিচিত্র নাটক বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা থেকে আহরণ করে আমাদের মঞ্চে ছড়িয়ে দিয়েছি। লক্ষ্য ছিল একটাই, বাংলাদেশিদের জীবনে নাটককে একটি চলমান, সৃজনশীল শিল্পমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমি বিনয় করে বলব না যে এই বিচারটি করবে ভবিষ্যতের নাট্যজনেরা। আমি বলব, এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে বিশ্বের যেকোনো জায়গার মতো এই আমার শহর ঢাকাতেও সন্ধ্যার একটি সময় ঘণ্টা বাজে, সংগীত শুরু হয়, সংলাপ বোনা আরম্ভ হয়ে যায়। এর পেছনে কৃতিত্ব আমাদের সবার এবং কৃতিত্ব এই কারণে যে আমরা নাটকের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করিনি। আমরা নাটককে ওপরে তোলার চেষ্টা করেছি। উদ্দেশ্য ছিল একটিই, ভালো নাটক ভালোভাবে করতে হবে এবং যেকোনো মহৎ কাজ ভালোভাবে করতে গেলে মানুষগুলোকে ভালো থাকতে হয়। না হলে সব উদ্দেশ্য পুঁতিগন্ধময় আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।

শিল্পকলার একটি শাখাকর্মী হিসেবে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি যে কাজ করার সময় প্রতি মুহূর্তে ভেবেছি সৎ কাজ করছি তো? জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে এসে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে মান যেমনই হোক, আমাদের কাজ সব সময়ই ছিল সৎ এবং সৎ কাজই হয় সুন্দর। আমি নিশ্চিত যে এবারের উৎসবে মঞ্চ থেকে আবার উৎসারিত হবে সেই আহ্বান, আসুন সৃজনশীলতার অঙ্গনে, আসুন সত্যের উদ্‌ঘাটনে, আসুন জীবনের জয়গানে।

আলী যাকের: অভিনেতা, ব্যবসায়ী ও কলামিস্ট