ক্ষমতার আয়নাভীতি ও একজন শিক্ষকের দোষ

উন্মুক্ত সিঁড়িতে ক্লাস নিচ্ছেন রুশাদ ফরিদী। ছবি: রুশাদ ফরিদীর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত
উন্মুক্ত সিঁড়িতে ক্লাস নিচ্ছেন রুশাদ ফরিদী। ছবি: রুশাদ ফরিদীর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত

অন্ধদের দেশে আয়না বিক্রি করতে এসে ভালোই বিপদে পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক। কথায় বলে উচিত কথার ভাত নেই। সঠিক কথা বলে চাকরি খোয়ানোর ব্যবস্থা করেছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুশাদ ফরিদী। তিনি ক্ষমতার সামনে আয়না তুলে ধরেছিলেন। আয়নায় আপন চেহারা দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা এমনই চটেছেন যে, ভদ্রলোককে এখন গাছতলায় না হলেও ভবনের সিঁড়িতে ক্লাস নিতে হচ্ছে। তাঁকে ক্লাসরুমে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না।

ক্ষমতাবানেরা বিরল প্রকৃতির মানুষ। তাঁদের অসুখ-বিসুখও তাই একটু বিরলই হয়। রহিমুদ্দি-সলিমুদ্দির যা হবে তা তো উজির-নাজিরের হলে মান থাকে না। তবে রোগটা বিরল হলেও উচ্চ পদাধিকারী অধিকাংশেরই এটা হয়। তাঁরা আয়না ভয় পান। ঠিক আয়না না, তাঁদের ভয় আয়নায় ফুটে ওঠা নিজেদের চেহারাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনুরূপ একটা রোগের কথা আছে। একে বলা হয় এইসোপট্রোফোবিয়া (eisoptrophobia)। এই রোগের রোগীরা আয়নায় নিজের চেহারা দেখে আতঙ্কে ভোগে—ভাবে এতে অমঙ্গল হবে। অথবা তাঁদের ভয় হয়, আয়নার মধ্যে দিয়ে ভীতিকর শক্তি তাদের ধরে ফেলবে। "Eisoptrophobia" শব্দটার জন্ম গ্রিক ভাষায়। "eis" মানে ‘মধ্যে বা ভেতরে’ এবং ‘optikos’ মানে ‘দৃষ্টি, চিত্র, দেখা) আর phobia মানে যে মানসিক আতঙ্ক তা তো অনেকেরই জানা।

রুশাদ ফরিদী যা করেছেন তা করে বিপদে পড়েছিলেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া। মাস দু-এক আগে তিনি তৎকালীন উপাচার্যকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?’ এতেই তাঁর কাল হয়েছিল। উপাচার্য মহোদয় তাঁকে বহিষ্কার করেন। পরে অবশ্য ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে উপাচার্যকেই বিদায় নিতে হয়। রুশাদ ফরিদীর বেলায় কী হবে তা এখনো দেখার অপেক্ষা। তাঁর দোষ যে তিনি একখানা স্বচ্ছ আয়না তুলে ধরেছিলেন। আয়নায় যদি ভালো চেহারা না ভাসে, সেই দোষ কি আয়নার?

রুশাদ ফরিদী প্রথম আলোয় একটা লেখা লিখে আসলে বলতে চেয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ কী? অতীতে এই বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্বের জোগান দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, শহীদ দিয়েছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রাচ্যের এই অক্সফোর্ড যে বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকার মধ্যে থাকার যোগ্য হলো না, তার বিহিত কী? দুই বছর আগে ঢাবির ৯৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পরপরই লিখেছিলেন,

‘পয়লা জুলাই হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আর চার বছর পরেই সেঞ্চুরি হাঁকাবে আমাদের সবার প্রিয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। এই দিনে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোকসজ্জা হয়, শোভাযাত্রা, বক্তৃতা, বিবৃতি ইত্যাদি চলে। আর প্রতিবছরই সেটি দেখে মনে হয়, এ সবই হচ্ছে মৃত্যুশয্যায় শায়িত একজন ব্যক্তির রোগযন্ত্রণা সব অগ্রাহ্য করে তাঁকে নিয়ে আনন্দ-উৎসবের এক প্রহসন। এগুলো বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে দ্রুত একাডেমিক শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। ডিন, উপাচার্য, সহ-উপাচার্য—এসব পদে নিয়োগ দিতে হবে সত্যিকারের মেধাবী ও যোগ্য অধ্যাপকদের। নয়তো আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মানের এই তলানির দিকে যাত্রা দিনে দিনে আরও ত্বরান্বিত হবে।’ এর পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহকর্মীদের সম্পর্কে ‘বাজে মন্তব্য’ করার অভিযোগে তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট বাধ্যতামূলক ছুটি মানে ওই সময়ে তিনি আংশিক বেতন পাবেন। এ জন্যই আগে বলা যে, উচিত কথার ভাত নেই। অধ্যাপক ফরিদী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেন। এ বছরের আগস্টে উচ্চ আদালত সিন্ডিকেটের সেই সিদ্ধান্তকে অবৈধ বলে রায় দেন। অন্যায় ব্যাপারটা এখানেই মিটে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এরপরও তাঁকে ক্লাসে ফিরতে দেওয়ার প্রশাসনিক ব্যবস্থা করা হয় না। তিনি হয়ে পড়েন অর্থনীতি বিভাগের বারান্দা-বিহারি শিক্ষক—বারান্দায় ঘোরাফেরা করতে পারেন কিন্তু ক্লাসে ঢুকতে পারেন না।

ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আকুতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়েছেন অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী। ছবি: রুশাদ ফরিদীর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত
ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আকুতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়েছেন অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী। ছবি: রুশাদ ফরিদীর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত

এ ঘটনার পর বিভাগের চেয়ারম্যানের কক্ষের বাইরে প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। একে একে তাঁর পাশে দাঁড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে তাঁর উন্মুক্ত পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়। দৃশ্যটা অভিনব হলেও সুন্দর। সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের চওড়া সিঁড়িতে একদল ছাত্রছাত্রী বসে আছে। তারা গভীর মনোযোগে একজন শিক্ষকের বক্তৃতা শুনছে, প্রশ্ন করছে। শিক্ষকের পাল্টা প্রশ্নে জমে উঠছে ক্লাস। অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও জ্ঞানের মজায় মেতে উঠছে। যাঁকে ঘিরে এসব তিনি সিঁড়ির তলার ধাপে, প্রায় রাস্তা ঘেঁষে বোর্ড টাঙিয়ে আনন্দে ক্লাস নিয়ে যাচ্ছেন।

কিন্তু এটাই কি হওয়ার কথা ছিল? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চোখের সামনে ধ্বংস হবে, সন্ত্রাসীদের বানানো খোঁয়াড় হবে, শিক্ষক রাজনীতি শিক্ষকতার দায়িত্বকে দলবাজি আর অর্থবাজির পদতলে সমর্পণ করবেন, কিন্তু কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না?

তাঁর প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, আদালতের রায়ের কপি পেলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন আইনে বলা আছে, একজন শিক্ষককে ৯০ দিনের বেশি বাধ্যতামূলক ছুটিতে রাখা যায়?

আমাদের দেশের লোকের অদ্ভুত সব আবেগ। তাঁরা কোনো ঘটনায় হয়তো লজ্জায় ভেসে গেলেন, কিন্তু একজন শিক্ষক দিনের পর দিন ‘আমি ক্লাসে ফিরে যেতে চাই’ প্ল্যাকার্ড লিখে দাঁড়িয়ে থাকছেন, ভবনের সিঁড়িতে ক্লাস নিচ্ছেন, পদ-পদবি না কেবল শিক্ষকতার মহিমাকে ভালোবেসে ক্লাসে ফিরতে চাইছেন—এ কি গোটা সমাজের জন্যই লজ্জার না? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পারিবারিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন হলো, কিন্তু দুর্নীতি বন্ধ হলো না বন্ধ করে দেওয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে আন্দোলনের আয়না তুলে ধরছে শিক্ষার্থীরা, কিন্তু শুধু সরকার নয় নাগরিক সমাজও যেন অন্ধ থাকাই আরামপ্রদ মনে করছেন। এই অবস্থায় রুশাদ ফরিদী শুধু সবার সামনে একটা আয়না তুলে ধরেছেন। নিজের অপরিষ্কার চেহারা যদি তাতে দেখা যায়, তাহলে আয়নাকে দোষ দিয়ে কী লাভ?

রুশাদ ফরিদী অন্তত একটা কাজ করেছেন, ক্ষমতার সমুখে আয়না তুলে ধরার জরুরতটা দেখিয়ে দিয়েছেন। আমরাও জানতে পারলাম, অসাধু ক্ষমতা হলো রূপকথার সেই ভূত যে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে ভয় পায়।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]