এইডস কেন বাড়ছে

৩৫ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি নাগরিক তিন বছর মালয়েশিয়ায় কাজ করার পর দেশে ফিরে আসেন। তার এক বছর পর তিনি তাঁর এক আত্মীয়কে রক্ত দিতে গিয়ে জানতে পারেন, তিনি এইচআইভিতে আক্রান্ত। তারপর চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁর স্ত্রীর রক্ত পরীক্ষা করে শনাক্ত হয় যে তাঁর স্ত্রীও একই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

এই পরিস্থিতিতে এ দেশে এইচআইভি আক্রান্ত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘের এইচআইভি/এইডসবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইডসের হিসাবে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট অনুমিত সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ হাজার। পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত হয়েছিল ৬ হাজার ৪৫৫ জন নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। বিশ্ব এইডস দিবস ২০১৯ উপলক্ষে গতকাল রোববার বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির পক্ষ থেকে যে হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরে আরও ৯১৯ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে আক্রান্তের মোট অনুমিত সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ১৪ হাজার।

বাংলাদেশে এইচআইভিতে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। তারপর থেকে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এইচআইভি (হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) এমন এক অণুজীব, যার সংক্রমণের ফলে মানুষ ‘অ্যাকোয়ার্ড ইমিউন ডিফিসিয়েন্সি সিনড্রোম’ বা ‘এইডস’ নামের এক প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগ মানুষের শরীরের জীবাণু-সংক্রমণ প্রতিরোধ করার প্রাকৃতিক ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। যদিও এই রোগের চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়েছে, তবু মৃত্যুর হার এখনো অনেক বেশি।

সমস্যা হলো, কোনো মানুষের শরীরে ভাইরাসটি প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে রোগলক্ষণ স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় না। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি জানতে পারে না যে তার শরীর এক প্রাণঘাতী ভাইরাস বহন করছে। ফলে তার শরীর থেকে এই ভাইরাস অন্যদের শরীরেও উভয়ের অজান্তেই সংক্রমিত হতে পারে। মালয়েশিয়াফেরত ওই ব্যক্তি ও তাঁর স্ত্রীর মতো অবস্থা অনেক মানুষের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, মোট আক্রান্তের প্রায় ৫০ শতাংশই জানে না যে তারা আক্রান্ত হয়েছে। আর আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যে ৫০ শতাংশ কোনো এক পর্যায়ে জানতে পারে যে, তাদের শরীরে এই ভাইরাস আছে, তাদের এক-তৃতীয়াংশ চিকিৎসা নেয় না। অর্থাৎ, চিকিৎসা ছাড়াই তাদের জীবনযাত্রা চলতে পারে, অন্তত কিছু সময়ের জন্য। এটাও একটা বড় সমস্যা; কারণ যে পর্যায়ে গিয়ে তারা অনুভব করে যে চিকিৎসা নেওয়া ছাড়া আর চলছে না, তত দিনে তাদের স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। আরও একটি সমস্যা হলো, যেসব আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা নেয়, তাদের শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো তথ্য সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে থাকে না।

আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর হার ক্রমান্বয়ে বাড়ার তথ্য থেকে অনুমান করা সম্ভব যে এইচআইভি/এইডসের রোগীদের চিকিৎসাব্যবস্থায় ঘাটতি আছে। ২০১৭ সালে মৃত্যু ঘটেছিল ১২৫ জনের, পরের বছর ১৪৮ জনের, আর চলতি বছরের ১১ মাসে মারা গেছেন ১৭০ জন। কর্তৃপক্ষের ভাষ্য হলো, মৃত ব্যক্তিদের একটা অংশ এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছিল, এটা শনাক্তই হয়নি এবং চিকিৎসা পায়নি। সুতরাং সংক্রমিত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা এবং যথাসময়ে চিকিৎসার আওতায় আনার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি। আর সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সুরক্ষাব্যবস্থা জোরালো করার অংশ হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অভিবাসী শ্রমিক, যৌনকর্মী, সমকামী ইত্যাদি ছাড়িয়ে এইচআইভি এখন সাধারণ মানুষদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে।

এইচআইভি সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়ার কারণগুলো শনাক্ত করা এবং সেসব কারণ দূর করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।