এখন গণতন্ত্রের জরুরি অবস্থা

সম্প্রতি নেপালে গিয়ে এই অঞ্চলের গণতন্ত্রের ভঙ্গুরতার ব্যাপকতা ও গভীরতার দিকগুলো নতুন করে চোখে পড়ল। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিকীকরণ জোরালো হচ্ছে। নির্বাচন, তা সুষ্ঠু বা কারচুপিপূর্ণ যা-ই হোক, নির্বাচন মোটা দাগে তার কৌলীন্য হারিয়েছে। নির্বাচিতরা শাসক হিসেবে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ ও প্রয়োগে উদগ্র। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের সব নাগরিক এবং বিশেষ করে সংখ্যালঘু, নারী, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ও সংবেদনশীলতা বেশি বেশি পর্যুদস্ত হচ্ছে।

তিন দিন (১৫-১৭ নভেম্বর) ধরে সাত সার্ক দেশীয় (ভুটান বাদে) বক্তারা সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের এক সম্মেলনে নানা বিষয়ে দুঃখ-দুর্দশা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা গল্প তুলে ধরেন। উপমহাদেশ একটি, সমাজগুলো আলাদা। কিন্তু সাত দেশের দুই ডজনের বেশি বিশেষজ্ঞ আলোচনায় অংশ নিলেন। তাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিবরণ দেন। চরিত্রগুলো আলাদা, তবে শাসন অপকৌশল অভিন্ন। এ অঞ্চলে জাতীয়তাবাদ উগ্র হচ্ছে, কর্তৃত্ববাদ জেঁকে বসছে। দক্ষিণ এশিয়া দো-আঁশলা গণতন্ত্রের চারণভূমি হয়ে উঠেছে।

রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের ধারণা কীভাবে এই অঞ্চলে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেই বিষয়ে জোরালো বক্তব্য দেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের না-বলা কঠিন কথাগুলো সহজে বলেছেন তিনি। তিনি কোনো দেশের নাম নেননি কিন্তু কথাগুলো সব দেশের জন্যই প্রাসঙ্গিক। মাহ্ফুজ আনাম বললেন, ‘এই অঞ্চলে ক্ষমতার পৃথককরণ লুপ্ত। সবকিছুকে ছাপিয়ে নির্বাহী বিভাগের শ্রেষ্ঠত্বই আমাদের চোখ ঝলসায়। কিছু “নুয়ান্সেস” (সূক্ষ্ম তারতম্য) আছে। আইন ও বিচারের স্তম্ভ গ্রাস করেছে নির্বাহী বিভাগ।’ প্রশ্ন উঠল, কেন ‘ফোর্থ স্টেট’ আছে না? তিনি অপ্রিয় সত্যটা মুখের ওপরই বলে দিলেন। বললেন, এটা একটা মরীচিকা। বাক্‌স্বাধীনতার অতন্দ্রপ্রহরী হলো বিচার বিভাগ। সেই বিচার বিভাগ যখন চাপে থাকে, তখন চতুর্থ স্তম্ভ থাকে না।

এর বিরোধিতা কেউ করেননি। বিশেষ করে ভাবছিলাম, ৭২ বছরের গণতান্ত্রিক আলো-বাতাসে বিকশিত হওয়া ভারতীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা হয়তো বলবেন, ভারতে আর যা-ই হোক, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়াটি নির্বাহী বিভাগ ছিনতাই করতে পারেনি। তাই একটা ব্যতিক্রম, একটা গর্বের জায়গা আছে। কিন্তু তাঁরা তা বললেন না। তাঁরা কাশ্মীর ও অযোধ্যাসহ নানা বিষয়ে বিচার বিভাগের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট এবং তাঁরা প্রকাশও করেছেন। একজন বিশিষ্ট নারী আন্দোলনের নেত্রী একান্তে বললেনও, প্রধান বিচারপতিকে যৌন কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত রেখেই অযোধ্যার রায় এসেছে।

আই কে গুজরাল, আসমা জাহাঙ্গীর, কামাল হোসেনদের হাতে গড়া সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (সাহর) নামের সংগঠনটির বর্তমান চেয়ার সুলতানা কামাল। গত ১৯ বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের সূচকগুলো অনেক বেশি দুর্বল হয়েছে। ভারতের সুপ্রতিবেশী নীতি, যা গুজরাল ডকট্রিন হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল, সেটা ভারতের নীতি হিসেবে দাঁড়াতেই পারেনি।

২০০০ সালে রাজস্থানের নিমরানায় সাহরের প্রথম ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল যে এক দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রভাব অন্য দেশে পড়ে, যা শান্তির প্রতি হুমকি তৈরি করে। এবারের সম্মেলনে যোগ দিয়ে মনে হলো, নির্বাচন দূষণ, ডিজিটাল যুগে বাক্‌স্বাধীনতা দলন ও হরণে আন্তসীমান্ত প্রভাব শুধুই তীব্রতা পাচ্ছে। বক্তারা বলেছেন, হোয়াটসআপ, সিগন্যাল বা ইমোর মতো হাতিয়ারগুলো শাসকদের এক সুতোয় বাঁধবে। তাঁরা ভিন্নমত দমনের কালাকানুন পাস করার আগে পরস্পরের অভিজ্ঞতা ঝালাই করে নেবেন। মডেল বিনিময় করবেন। ধারণা করি, এভাবে আঞ্চলিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনগুলো ক্রমেই এক ও অভিন্ন হয়ে উঠবে। এর পরিণামে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও বেশি সংকুচিত হতে পারে।

সম্মেলনের শেষ দিনের শেষ অধিবেশনে আমার সভাপতির দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা ছিল প্রীতিকর। কারণ, এতে জেন্ডার নিয়ে কথা বলেন অশীতিপর ভারতীয় ঐতিহাসিক উমা চক্রবর্তী। শৈশবে নেহরুকে কাছ থেকে দেখেছেন। এই বয়সেও তিনি কাশ্মীরের ওপর একটি অসম্ভব ভালো প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে একজন কাশ্মীরি নারীর সাহসী সংগ্রামগাথা ফুটিয়ে তুলেছেন। সভায় পাকিস্তানি উর্দু কবি ও দেশটির মানবাধিকার কমিশনের মহাসচিব হারিস খালিক বলেছেন শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিয়ে। পাকিস্তানের নির্বাচিত গণতন্ত্র কী, সেটা বোঝা যায়, যখন বক্তারা সবাই একমত হন যে ইমরান খান সেনানিবাসের কলের পুতুল। পাকিস্তানের অবস্থা সব সময় এমনই। এখন সরাসরি সামরিক শাসন নেই, ভোটারদের রাবার স্ট্যাম্পের রঙের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

কনক মনি দীক্ষিত হিমাল সাউথ এশিয়া সাময়িকী খ্যাত নেপালের প্রবীণ সাংবাদিক। তিনি দক্ষিণ এশীয় গণতন্ত্রের নতুন মাত্রা নিয়ে আলোচনা করেন। শ্রীলঙ্কায় গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিজয়, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল, অযোধ্যাবিষয়ক রায় প্রসঙ্গ টেনে বলেন, দিল্লিতে তাঁর বন্ধুদের তিনি ইদানীং বিষাদগ্রস্ত দেখেন। তবে চেন্নাইতে প্রতিবাদী মানুষ দেখেন। সেখানে তাঁর বন্ধুরা বলেছেন, ভারতে যার আসর চলছে তা হিন্দুত্ববাদ নয়, গুজরাটত্ববাদ। কনকের বিশ্বাস, সুশীল সমাজ একটা ভুল ধারণা দীর্ঘদিন ধারণ ও তা জনপ্রিয় করে রাখতে পারে। ১৫ বছর ধরে কাঠমান্ডুর শিক্ষাবিদেরা একটা ভুল বকেছেন যে নেপাল অতিরিক্ত দরিদ্র, মুখ্যত সেই কারণে মাওবাদীরা এই উপত্যকায় জেঁকে বসেছে।

কনক মনির এই বক্তব্য শুনে ভাবি, তাহলে ঢাকায় কী ঘটছে? ১৯৯০ সালে নেপালে গণতন্ত্র আসার সময়টায় বাংলাদেশেও গণতন্ত্র ফিরে এসেছিল। কনক যখন বললেন, কাঠামোগত সংঘাত নেপালি সমাজে সব সময় ছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালের দিকে যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধস নামল, তখন থেকে মানুষ শারীরিকভাবে নির্যাতিত হতে শুরু করল, যেটা আগে ছিল না। হঠাৎ কান খাড়া হলো। কিছু একটা কি আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে গেল কি না। নেপালে দুটি গণপরিষদ দীর্ঘ সময় নিয়ে নতুন সংবিধান দিয়েছে। একে স্বাগত জানিয়ে আমরা লিখেছিলাম। তবে শুনলাম, এর বাস্তবায়নের গতি বেশি রকম মন্থর। তবে নতুন সংবিধান তৈরিতে বিশেষজ্ঞরা নন, রাজনীতিকেরাই অগ্রণী ছিলেন। তাঁদের চিন্তার ছাপটাই বেশি। কনক নেপালে দুই ধরনের বিদেশি হস্তক্ষেপ দেখেন, বিদেশি দাতা ও ভারতীয়দের হস্তক্ষেপ। পশ্চিমা দাতারা অধ্যাপকদের কনসালটেন্সিতে ব্যস্ত রাখে, সমাজ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে তাঁর দাবি, ভারতীয় গোয়েন্দারা নেপালি সমাজে ঢুকে পড়েছে ব্যাপকভাবে।

আমরা কনকের সঙ্গে একমত যে উগ্র জাতীয়তাবাদে ভাসছে দক্ষিণ এশিয়া, যার অন্তর্গত দর্শন সামরিকীকরণ। শ্রীলঙ্কায় সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে বিশ্বাসী গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিজয় তার সর্বশেষ উদাহরণ। কনক বলেন, উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ফেক নিউজ বা ভুয়া খবরের প্রণয় ঘটলে কী সর্বনাশ হতে পারে, তার উদাহরণ দক্ষিণ এশিয়া। তাঁর কথায়, সামরিকীকরণ প্রশ্নে পাকিস্তানকেই আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করি, অথচ ভারতের কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সামরিকীকরণ তীব্রতা পাচ্ছে। বাংলাদেশের নামটিও তিনি নিলেন। বললেন, বেসামরিক জীবনে সামরিকীকরণের ছাপ এখানেও স্পষ্ট। নেপালের সামরিক বাহিনীর দুর্নীতি নিয়ে কথা বললেন। সেনাসংখ্যা (এখন এক লাখের বেশি) অর্ধেকে নামানোয় গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। বলেন, এটা উদ্বেগজনক যে রাজনীতিবিদেরাই এখন তাঁদের বেসামরিক কাজগুলো করিয়ে নেওয়ার শেষ ভরসা হিসেবে সামরিক বাহিনীতেই ভরসা পান।

অধিবেশনের উপসংহারে বলি, গণতন্ত্রের সব থেকে বড় শত্রু উগ্র জাতীয়তাবাদ। উত্তম জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিয়েছে। বললাম, গান্ধীজির অনুসারী এক মার্কিন গবেষক বলেছেন, ‘জাতীয়তাবাদী চেতনা’ মানুষকে সহজে বিপদে ফেলে। যে পাপ সে এমনিতে করে না, সেটা তখন তাকে দিয়ে করানো যায়। গোটা অঞ্চলজুড়ে সেই পাপের বিস্তার দেখছি। তবে কনক মনি দীক্ষিতের সঙ্গে ভীষণ একমত হই যে দক্ষিণ এশিয়ায় সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়টি নির্ভর করছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কার্যকর স্বায়ত্তশাসনের ওপর। মূলত এর অভাবই গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় যে অবস্থা তৈরি করেছে, সাহরের ঘোষণাপত্রে এবার তাকে উল্লেখ করা হয়েছে ডেমোক্রেসি ইমার্জেন্সি বা গণতন্ত্রের জরুরি অবস্থা হিসেবে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]