লন্ডন ব্রিজের হামলায় যা দেখলাম

এএফপি ফাইল ছবি।
এএফপি ফাইল ছবি।

লন্ডন ব্রিজের ওপর গত শুক্রবার দুপুরে যে নৃশংস সন্ত্রাসী হামলা হয়ে গেল, সেখান থেকে মানবচরিত্রের উৎকৃষ্টতম ও নিকৃষ্টতম দুটি দৃশ্যই চোখে পড়ল।

একদিকে আমরা দেখলাম, প্রতিদিনের মতো যাঁর যাঁর কাজে ছুটে চলা সাধারণ লন্ডনবাসীর ওপর হামলা চালানো সন্ত্রাসীকে পাকড়াও করতে আমাদের জরুরি সহায়তাকর্মীরা সাহসিকতার সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। অন্যদের জীবন বাঁচাতে নিজেদের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষও এগিয়ে এসেছে। আমি এই ভিডিও ক্লিপের দৃশ্য কখনো ভুলব না, যেখানে অস্ত্রধারী লোকটিকে প্রতিহত করার জন্য তিনজন লোক (যাঁদের মধ্যে একজন ইউরোপীয় নাগরিকও ছিলেন) এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা এবং পুলিশ কর্মীরা যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন, তা ভোলার নয়।

অন্যদিকে আমরা এমন একজন সন্ত্রাসীর জিঘাংসা দেখলাম, যিনি আগেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা খেটেছেন। জেল খেটে বের হওয়া সেই ব্যক্তি আমাদের প্রাত্যহিক জীবন ও সামাজিক বন্ধনকে বিভক্তির ছুরি দিয়ে ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছেন। এই কাপুরুষোচিত হামলায় হামলাকারীসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমি ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজনকে সহমর্মিতা জানাচ্ছি।

পেশাদারির পরিচয় দিয়ে ঠিক সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দায়িত্ব পালন করার জন্য আমি লন্ডনের ইমার্জেন্সি সার্ভিসের কর্মীদের বিশেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। পুরো লন্ডনবাসীর হয়ে আমি শুক্র ও শনিবার তাঁদের পাশে ছিলাম ও তাঁদের আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়েছি। এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা নীরবে নিভৃতে লন্ডনবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ঠিক একই ধরনের ঘটনা লন্ডনে যাতে আর না ঘটে, সে জন্য আমাদের পুলিশ বাহিনী যেভাবে তৎপর রয়েছে, তা আমাকে ভীষণভাবে উদ্বেলিত করছে।

আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে সন্ত্রাসীরা ইতিপূর্বেও এই শহরের শান্তিপ্রিয় মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। তারা আগেও তাতে সফল হতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। এ ধরনের কাপুরুষোচিত হামলায় লন্ডন কখনো ভীত হবে না। বরং এসব মন্দ শক্তিকে পরাভূত করতে আমরা আমাদের চেষ্টা, মনোবল ও সক্ষমতা দ্বিগুণ করব। লন্ডন মনে করে সন্ত্রাসবাদ সম্পূর্ণ কাপুরুষোচিত কাজ এবং এই কাজ যে বা যারা যেকোনো উপায়ে সমর্থন করবে, তাদের আমরা আইনের আওতায় এনে সাজা দেব।

এ ঘটনা আমাদের আবার মনে করিয়ে দিয়েছে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা ভীষণ জরুরি। সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যই হলো বিভক্তি সৃষ্টি করা। আমরা যদি ব্যক্তির আচরণকে গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের আচরণ বলে ধরে নিই, তাহলে তা সমাজকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেবে। মূলত সেটা করাই সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্য। আমরা সন্ত্রাসীদের সেই উদ্দেশ্য পূরণ হতে দিতে পারি না।

আমি মেয়র হওয়ার পর থেকেই বলে আসছি, সরকার পুলিশ বিভাগের জনবল কমানোর যে চিন্তাভাবনা করছে, তা ঠিক হচ্ছে না। এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। যুক্তরাজ্য সরকার গত ১০ বছরে পুলিশ বিভাগে জনবল ও বরাদ্দ কমানোয় কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা জরুরি ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা দরকার।

২০১২ সালের আগে অতর্কিত হামলাকারী ব্যক্তিকে বিচারকের তাৎক্ষণিকভাবে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সাজা’ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া ছিল, কিন্তু ২০১২ সালের পর বিচারকদের হাত থেকে সেই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমি তখনো সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলাম, এখনো করি। গুরুতর অপরাধে যাঁদের নির্দিষ্ট সময় জেল হয়, তাঁদের অনেককে ওই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই বিশেষ বিবেচনায় ও শর্ত সাপেক্ষে ছেড়ে দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর তাঁরা যখন আবার কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন, তখন বিশেষ বিবেচনায় মুক্তির যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এ কারণে প্রেষণে মুক্তি পাওয়া অপরাধীদের ওপর নজরদারি আরও জোরদার করা দরকার।

আমি লন্ডনের সব বাসিন্দাকে সন্দেহজনক কিছু দেখলেই নিরাপত্তা বিভাগকে খবর দিতে অনুরোধ জানিয়েছি। আমার এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, খুব শিগগির আমরা আবারও দেখাতে পারব যে লন্ডন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ শহর। আমরা কাউকেই আমাদের সমাজকে বিভক্ত করতে দেব না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে নেওয়া
সাদিক খান: লন্ডনের মেয়র