বলিউডের জোয়ারে কি আর্থিক ভাটা কাটবে

অর্থনৈতিক সংকট বিভিন্ন খাতকে সংকুচিত করছে, বাড়াচ্ছে বেকারত্ব। ছবি: রয়টার্স
অর্থনৈতিক সংকট বিভিন্ন খাতকে সংকুচিত করছে, বাড়াচ্ছে বেকারত্ব। ছবি: রয়টার্স

ভারতে অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে শোরগোল শুরু মূলত অক্টোবরে। ওই মাসের দ্বিতীয় দিন ছিল ‘গান্ধীজয়ন্তী’। ছুটিতে ব্যবসা ভালো হবে ভেবে সেদিন হলগুলোতে তিনটি নতুন সিনেমা ছাড়া হয়। ইংরেজি ‘জোকার’, হিন্দি ‘ওয়ার’ এবং তেলেগু ‘সাই রা নরসিমা রেড্ডি’।

‘গান্ধীজয়ন্তী’ অহিংসার স্মারক। কিন্তু তিনটি সিনেমাই ছিল ভায়োলেন্স ও অ্যাকশনে ভরপুর। এক করুণ স্ববিরোধিতাই বলতে হয়—তিনটি মুভিই ব্যাপক দর্শক টেনেছে। নরসিমা রেড্ডি প্রথম দিন ৮০ কোটি রুপি ব্যবসা করে। ঋত্বিক ও টাইগার শ্রফের ‘ওয়ার’-এর প্রযোজক নবম দিন শেষে ২৩৮ কোটি রুপি আয়ের কথা জানান। বিদেশি ‘জোকার’ও দুই সপ্তাহে ৫০ কোটি রুপি আয় করে। অক্টোবর-নভেম্বরজুড়ে সমান তালে এই ব্যবসা চলেছে।

এর মাঝেই ছবি তিনটির বাণিজ্যিক সফলতা রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে আনেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ। জোকার, ওয়ার এবং নরসিমা রেড্ডি নিয়ে দর্শকদের মাতামাতি দেখিয়ে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করেন রবিশঙ্কর,Ñ‘আপনারা অর্থনৈতিক মন্দা দেখছেন কোথায়? বক্স অফিসের দিকে তাকান; অর্থনীতি শক্ত অবস্থানে আছে।’ রবিশঙ্কর প্রসাদের এই আত্মপ্রসাদ ভারতীয় প্রেসক্লাবগুলোতে বেশ চমক তৈরি করে।

দেশি-বিদেশি ওই তিন সিনেমাই ফ্যান্টাসিতে ভরা। গরিব মানুষ প্রতিদিনকার রূঢ়তা থেকে বাঁচতে এ রকম সিনেমাই দেখে। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা অর্থনীতির বাস্তবতা আড়াল করতেও যে এ রকম কল্পিত অ্যাকশন-থ্রিলার ব্যবসার আশ্রয় নেবেন, সংবাদমাধ্যমের জন্য এটা ছিল বড় বিস্ময়।

তবে পরদিনই বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন ছাপা শুরু হয়। সেসবে দেখা যায়, বিশ্বে এমন উদাহরণ বিস্তর যে, অর্থনৈতিক মন্দার সময় সিনেমা ব্যবসা চাঙা থাকে। ১৯২৯-এ ওয়াল স্ট্রিটে মহামন্দার বছর যুক্তরাষ্ট্রে সিনেমা দর্শক আগের চেয়ে ৫৮ ভাগ বেড়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ায়ও এ রকম নজির আছে। ভারতে সর্বশেষ মন্দা আসে ২০০৮ সালে। সে বছর বলিউড ১২ শতাংশ ভালো ব্যবসা করে আগের বছরের চেয়ে। পরের বছর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোমাত্র সিনেমা ব্যবসা ১৪ শতাংশ ছোট হয়ে যায়। এসব তথ্য তুলে ধরে অর্থনীতিবিদরা টুইটারে হাস্যরস শুরু করলে রবিশঙ্কর প্রসাদ ১৪ অক্টোবর তাঁর অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক বিশ্লেষণটি ‘প্রত্যাহার’ করে নেন। তাতে অবশ্য অর্থনীতি নিয়ে বিতর্ক আরও বেড়েছে।

জিডিপির বড় পতন: ভারতের স্বপ্নভঙ্গ
সর্বশেষ হিসাবে ভারতে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি দাঁড়াচ্ছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। বেশ বড় পতন এটা। ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতকে ‘পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশে’ পরিণত করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মোদি। সর্বশেষ জিডিপি তার সঙ্গে মেলে না। দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি ছিল বিজেপির আরেক অঙ্গীকার। সেটা থেকেও পিছিয়ে গেল ভারত। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে এক বছরের মধ্যে এক কোটি নতুন চাকরি সৃষ্টির ঘোষণা দিয়েছিলেন মোদি। সেটাও অর্জিত হয়নি তখন।

৪৫ বছরের মধ্যে ভারতে এখন বেকারের হার সর্বোচ্চ। শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাবে শহুরে তরুণদের ৮ শতাংশ বেকার। বেসরকারি হিসাবে এটা আরও বেশি। কেবল মোটরযান তৈরি শিল্পে গত তিন মাসে তিন লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অথচ দেশটিতে মাসে ১০ লাখ নতুন চাকরির দরকার। মারুতি-সুজুকি বলছে, আগস্টে তাদের বিক্রি আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ৩৬ ভাগ কমেছে। একই মাসে ‘হোন্ডা কার’ বিক্রি ৫০ ভাগ কমার কথা বলছে। মাহিন্দ্র বলছে, বিক্রি ৩২ ভাগ কমেছে।

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের দাবি, উবারের মতো ভাড়া গাড়ির বিকল্প আসায় মানুষ গাড়ি কিনতে চাইছে না। নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক ভাষ্যকাররা অবশ্য বলছেন, দেশটি আসলে মন্দার কবলে পড়েছে।

যেভাবে বিশ্বের বড় এক অর্থনীতি মন্দায় পড়ল
বিশ্বের প্রধান পাঁচ বড় অর্থনীতির একটা ভারত। বিশাল তার ভোক্তার আকার। উৎপাদক দুনিয়া এ রকম দেশের মন্দা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে পারে না। দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেটের সময় বলেছিল, জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটবে অন্তত ৭ শতাংশ হারে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, তারা ২ শতাংশের বেশি পিছিয়ে গেছে। দেশটির রুগ্‌ণ ব্যাংকিং খাত থেকে এই অঘটনের বড় ইন্ধন এসেছে। জিডিপি-বিনিয়োগ অনুপাতও কমেছে। জ্বালানি বাজার চড়ে যাওয়াও ভারতীয় পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমাচ্ছে। একই কারণে বৈশ্বিক বাজার চাহিদাও কম। ভারতের রপ্তানি খাতকে সেই মন্দার ভারও বইতে হচ্ছে। তবে ২০১৬ সালে মোদি সরকার ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোটগুলো নাটকীয়ভাবে নিষিদ্ধ করে গ্রামীণ অর্থনীতির যে ক্ষতি করেছে, সেটারই দীর্ঘমেয়াদি ফল আজকের মন্দা।

গ্রামীণ অর্থনীতি নগদ মুদ্রায় চলে। এটা মোটেই ব্যাংক, চেক, পে-অর্ডার, ক্রেডিট কার্ড-নির্ভর নয়। দুই ধরনের নোট নিষিদ্ধের পর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মানুষ যার হাতে যা আছে, সেটা আর খরচ করতে চায়নি। এভাবে নগদ মুদ্রার চলাচল সীমিত হয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কৃষিবাজারে কেনাকাটা নজিরবিহীনভাবে কমে যায়। ওই ঘটনায় সরকার এমনভাবে অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করে, যা রাজধানীর গুটিকয়েক মানুষের কুক্ষিগত সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের বিশ্বাসের সঙ্গে আস্থাও নষ্ট করে।

রুপির অব্যাহত দরপতন এবং ব্যাংক খাতে সংকট ভারতের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ছবি: রয়টার্স
রুপির অব্যাহত দরপতন এবং ব্যাংক খাতে সংকট ভারতের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ছবি: রয়টার্স

ভারতে ‘কালো অর্থনীতি’র পণ্ডিত অরুণ কুমারের মতে, নোটবন্দীর কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অনেক আগেই মন্দা শুরু হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শক্ত অবস্থার কারণে এত দিন সেটা বোঝা যায়নি। সেই সুনামি আস্তে আস্তে প্রাতিষ্ঠানিক খাতকে ছুঁয়েছে এখন।

পণ্য উৎপাদনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের হিস্যা ৪৫ ভাগ হলেও কর্মসংস্থানে তার ভাগ ৯০ শতাংশ। ভারতে বেকারত্ব বাড়ার মূল রহস্য এখানেই। একই কারণে অর্থনীতিতে চাহিদাও কমে গেছে। পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ হতে চাইলে বেশ কয় বছর ৮-১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধিতে পথ চলা জরুরি ছিল। আপাতত ভারতের সেটা হচ্ছে না। মনস্তাত্ত্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মনোভাবও ভারতীয়দের অনিচ্ছা সত্ত্বে হলেও ত্যাগ করতে হবে।

স্বভাবত ভারতজুড়ে এই অবস্থায় নীরব হতাশার তরঙ্গ বইছে। বিরোধী দলগুলোও তার সুযোগ নিতে চাইছে। গত ৩০ নভেম্বর টুইটারে সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরাম এক ভিডিও ভাষণে বলছিলেন: ‘অর্থনীতির অন্তত তিনটি চাকা ফুটো হয়ে গেছে।’

সাবেক এই অর্থমন্ত্রী কংগ্রেসের নেতা। বিজেপি তাঁকে জেলও খাটিয়েছে। আক্রোশবশত তিনি চাকার সংখ্যা বাড়িয়ে বলতে পারেন। কিন্তু ভারতের অর্থনীতির অন্তত একটা চাকায় ফুটো তৈরি হয়েছে, সন্দেহ নেই।

লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির সংকট
লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির বড় সংকট—এটা জনগণকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, অর্থনীতিকে সেভাবে পারে না। ভোটের রাজনীতিতে মোদি-অমিত শাহ জুটি অদম্য। কিন্তু প্রবৃদ্ধির পতন থামাতে তাঁদের উদ্যোগ ভালো কাজে দেয়নি। তবে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধরে রাখতে এই সরকার যে ‘বাজার’-এ আরও হস্তক্ষেপ করবে, তা অবধারিত। এ ক্ষেত্রে করপোরেটদের কর হার আরেক দফা কমানো হতে পারে। সুদের হার ইতিমধ্যে ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নিয়ে আসা হয়েছে। একদিকে প্রচার চলছে ‘ব্যবসাবান্ধব দেশ’ হিসেবে ভারত গত এক বছরে ৭৭ থেকে ১৪ ধাপ এগিয়ে ৬৩তম অবস্থানে চলে এসেছে। আবার একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের জনগণের অর্থ দিয়ে মদদ দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। কিন্তু এসব প্রণোদনা গ্রামীণ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে আদৌ চাঙা করতে পারবে কি না, তাতে সন্দেহ আছে। ভারতের অর্থনীতির সমস্যা চাহিদা কমে যাওয়া, সরবরাহ কমে যাওয়া নয়। ফলে করপোরেটদের প্রণোদনা দেওয়া নতুন করে সরকারি কোষাগার লুণ্ঠনের মতোই।

বাস্তবে ভারতে অর্থনৈতিক মন্দার মূলে আছে গুটিকয়েকের হাতে সম্পদের অসম পুঞ্জিভবন। ওপরতলার ১ ভাগ নাগরিক দেশটির সম্পদের ৭৭ ভাগের ‘মালিক’। প্রতিবছর দেশটিতে যে সম্পদ তৈরি হয় তার ৭০-৭৫ ভাগ ওই ১ শতাংশের দখলে চলে যাচ্ছে। ২০০০ সালে দেশটিতে বিলিয়নিয়ার ছিলেন ৯ জন। এখন সংখ্যাটা ১১৯। মোদি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন তাঁর ঘনিষ্ঠ মুকেশ আম্বানি ছিলেন বিশ্বের ৪০তম ধনী। পাঁচ বছর পর মুকেশ বিশ্ব ধনীদের তালিকায় নবম অবস্থানে চলে এসেছেন। ভারতীয় অর্থনীতির সংকটটি এখানেই। এটা একটা ‘জরুরি অবস্থা’। কিন্তু তা জরুরি মনোযোগ পাচ্ছে না।

ভারতের এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছু। আছে সতর্ক হওয়ার ব্যাপারও। ব্যাংক খাতের রোগবালাইকে আড়াল করে রাখার কী পরিণতি হয়, তার বড় সাক্ষ্য ভারত। পরিসংখ্যানের তথ্যগুলো রাজনৈতিক আলো-আঁধারিতে আটকে রেখে বাস্তবতাকে বেশি দিন ধামাচাপা দেওয়াও যে ঠিক নয়, মোদির ‘গুজরাট মডেল’ সেটাও বলছে। সরকারের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থাপনায় একবার জনগণের আস্থা টলে গেলে কী ঘটে, ভারতীয় মন্দার মতোই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক লবণগুজব তার বড় সতর্কবার্তা। পেঁয়াজ কেলেঙ্কারির সরাসরি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লবণগুজব। মানুষ কাউকে আর বিশ্বাস করছে না।

কিন্তু অর্থনীতি কেবল পণ্য উৎপাদন ও তার সরবরাহের ওপর নয়, বিশ্বাসের ওপরও দাঁড়িয়ে থাকে। বিশ্বাসের বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মন ফ্যান্টাসিতে আশ্রয় খোঁজে, সিনেমার ভায়েলেন্সে মুক্তি চায়। হয়তো এ কারণেই ঢাকায়ও ভালো চলেছে ‘জোকার’। সিনেপ্লেক্সের শাখাও বাড়ছে ক্রমাগত। তবে পেঁয়াজের দাম মোটেই কমেনি।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক