আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ: জামায়াত ও তার জঙ্গি নেটওয়ার্ক

‘আমি আজ আপনাদের কাছ এই চিঠি লিখছি এমন একটি বিষয়ে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের মিত্রদেশগুলো, বিশেষত ভারত ও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি লিখছি জামায়াতে ইসলামী ও তার আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বেনামি গ্রুপগুলো যে হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে সে বিষয়ে। আমাদের হাতে এখন পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে যে এই গ্রুপসমূহ জঙ্গি মতবাদের প্রচারে ও তার পক্ষে অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত রয়েছে।’

মার্কিন কংগ্রেসের তিনজন সদস্য—জিম ব্যাঙ্কস, চাক ফ্লাইশম্যান ও র‍্যান্ডি ওয়েবার মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাউন্টার টেররিজম বা সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধবিষয়ক বিভাগের সমন্বয়কারী রাষ্ট্রদূত নেথান সালেসের কাছে ১ নভেম্বর ২০১৯-এ লেখা এক যৌথ চিঠিতে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ কথা লিখেছেন। তাঁদের উদ্বেগের প্রধান কারণ, জামায়াতের কার্যকলাপ দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে সীমাবদ্ধ ভাবা হলেও বাস্তবে তাদের হাত এখন বহুদূর বিস্তৃত। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে এই দলের একাধিক প্রক্সি গ্রুপ তৎপর রয়েছে, যাদের লক্ষ্য একদিকে জামায়াতের ভয়াবহ রাজনৈতিক আদর্শের বিস্তার, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় জামায়াতের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের পক্ষে তহবিল সংগ্রহ।

যুক্তরাষ্ট্রে জামায়াতের পক্ষে প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে এমন দুটি সংস্থার কথা তিন কংগ্রেসম্যান উল্লেখ করেছেন। তারা হলো ‘হেল্পিং হ্যান্ডস ফর রিলিফ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ এবং ‘ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকা’ ( ইকনা)। কংগ্রেস সদস্যদের ভাষায়, নিজ দেশীয় মুসলিমদের পক্ষে কর্মরত সুশীল সমাজভুক্ত সংস্থা হিসেবে দাবি করলেও এরা আসলে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে জঙ্গিবাদী একটি নেটওয়ার্কের সদস্য’। (মূল চিঠিটি পড়া যাবে এই লিংকে: https://www.docdroid.net/ fc26Dof/icnasales-letter.pdf)

ইকনা নামের সংস্থাটির নিউইয়র্ক শাখার অনেক সদস্যই বাংলাদেশের, যাঁরা দীর্ঘদিন প্রবাসে রয়েছেন। কেউ কেউ সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এই সংস্থার সদস্যরা অনেক দিন থেকেই খোলামেলাভাবে বাংলাদেশে ঘাতক-দালালদের বিচারপ্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। ২০১৩ সালে টাইমস স্কয়ারে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশের প্রতিবাদে কয়েক হাজার মানুষের যে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়, তার অন্যতম সংগঠক ছিল ইকনা। ঢাকার দৈনিক সংগ্রাম সেই সমাবেশের এক প্রতিবেদনে লিখেছিল, এই সংস্থার আমির নাঈম বেগ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যদণ্ডাদেশের প্রতিবাদ করে বলেছেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে সারা বাংলাদেশে আগুন জ্বলে উঠেছে। সেই গণরোষ সামলাতে বাংলাদেশ সরকার ‘গণহত্যা’ শুরু করেছে। এই সমাবেশের আরেক আয়োজক ছিল ইকনার সহযোগী সংস্থা ‘মুসলিম উম্মাহ অব নর্থ আমেরিকা’ (মুনা)। এই সংস্থার ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট আবু আহম্মদ নুরুজ্জামান তাঁর বক্তব্যে বলেন, তৌহিদি জনতার রুদ্ররোষ সামাল দিতে বাংলাদেশ সরকার প্রায় এক লাখ নেতা-কর্মীকে কারাগারে প্রেরণ করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের দায়ভার এখনকার কারও ওপর চাপানো যাবে না। সব দায়দায়িত্ব তাঁদের, যাঁরা ১৯৭১-এ প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

বাংলাদেশে জামায়াত নেতাদের এই ভাষার সঙ্গে আমরা পরিচিত। বিদেশে বসে তাঁদের বন্ধুরাও সে ভাষাতেই যুক্তি দেখাচ্ছেন, একাত্তরের অপরাধের দায়ভার অন্যের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন।

কংগ্রেস সদস্যরা জানিয়েছেন, ইকনা ও হেল্পিং হ্যান্ড ফর রিলিফ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আসলে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামির অঙ্গসংগঠন ছাড়া আর কিছু নয়। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ ভালি নাসেরের কথা উল্লেখ করে তাঁরা জানিয়েছেন, এই দুটি সংস্থা বিশ্বে জামায়াতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এ কথার পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে যে তারা জঙ্গিবাদের পক্ষে তহবিল সংগ্রহে নিয়োজিত। সাম্প্রতিক সময়ে এদের বিশেষ মনোযোগ পড়েছে কাশ্মীরের ওপর। মানবিক সাহায্যের নামে গঠিত হলেও এরা সন্ত্রাসী হিসেবে নিষিদ্ধ একাধিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত।

কংগ্রেসম্যানরা তাঁদের চিঠিতে মানবিক সাহায্যের নামে তহবিল সংগ্রহ করছে এমন বেশ কয়েকটি সংস্থার নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন, ফালাহ-ই-ইনসানিয়াত ফাউন্ডেশন ও আল-খিদমত। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে কথিত হিজবুল মুজাহিদিনের সঙ্গেও এদের রয়েছে নিকট সম্পর্ক। কংগ্রেসম্যানরা কানেটিকাটের এক পাকিস্তানি-আমেরিকানের নাম উল্লেখ করেছেন। এফবিআইয়ের কাছে মিথ্যা বলার অভিযোগে তিনি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে ইকনার কোনো যোগাযোগ নেই বলে দাবি করলেও ফরিদ আহমদ খান নামের এই পাকিস্তানির সঙ্গে এই সংস্থার নিকট সম্পর্কের প্রমাণ এফবিআই পেয়েছে।

ইকনার নেতৃত্বে রয়েছেন এমন একজন হলেন আশরাফুজ্জামান খান। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। এই রায় ঘোষণার এক দিন আগ পর্যন্তও ইকনার নিউইয়র্ক শাখার নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান। একসময় তিনি এই শাখার সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেন। রায় ঘোষণার পর অবশ্য তাঁর নামটি তুলে ফেলা হয়।

ইকনাকে নিয়ে ভয়ের কারণ, ধর্ম প্রচার ও মানবিক সাহায্যের নামে এরা অভিবাসী বাংলাদেশি মুসলিমদের খুব গভীরে পৌঁছে গেছে। প্রধানত মসজিদভিত্তিক এদের কার্যকলাপ, নতুন অভিবাসীদের অনেকেই ধর্মীয় তাগিদে মসজিদের প্রচার-প্রচারণায় যুক্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই যাঁর যাঁর ছেলেমেয়েদের ধর্মশিক্ষার জন্য মসজিদে নিয়মিতভাবে পাঠিয়ে থাকেন। মার্কিন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই শিক্ষার প্রভাবে নবাগত অভিবাসীদের কেউ কেউ অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ জিহাদের জন্য বিদেশে পাড়ি দেয়। উল্লেখযোগ্য, নাশকতামূলক কাজের পরিকল্পনার অভিযোগে এফবিআইয়ের হাতে চারজন বাংলাদেশি-আমেরিকান ধরা পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ইকনা ও মুনার মতো সংগঠনের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট। দক্ষিণ এশিয়ায় জন্ম হলেও এসব সংগঠন এখন তাদের শিকড় দেশের মাটি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে আমেরিকা-ইউরোপেও ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটি তাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এরা শুধু যে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের আশ্রয় দিচ্ছে তা–ই নয়, ধর্মের নামে হিংসাত্মক মতাদর্শেরও বিস্তার ঘটাচ্ছে। সাঈদীর ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে এদের উৎসাহে ও প্রচারণায় নিউইয়র্কে যে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন হয়, তার অধিকাংশ অংশগ্রহণকারীই ছিল বাংলাদেশের। জামায়াতের মুখপত্র সংগ্রাম সে সময় সোৎসাহে লিখেছিল, এটি ছিল প্রবাসীদের বৃহত্তম বিক্ষোভ সমাবেশ। জামায়াত ও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত একজন ব্যক্তির পক্ষে এত মানুষের সমাবেশ দেখে আমরা সত্যিই বিস্মিত হয়েছিলাম। এরা কারা, এত দিন কোথায় লুকিয়ে ছিল, আর কী কী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এদের যোগাযোগ রয়েছে?

তিন কংগ্রেসম্যানের চিঠি থেকে এসব প্রশ্নের কিছু কিছু উত্তর মিলেছে। বিদেশে থেকেও বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে এদের রয়েছে নাড়ির যোগাযোগ। দেশে যেমন, বিদেশেও ধর্মের লেবাসটি তারা ঠিকই গায়ে চড়িয়েছে, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য তাদের জঙ্গি মতবাদের প্রচার ও প্রসার। এই প্রচার ও প্রসারে একটি প্রধান অস্ত্র অর্থ, যা প্রধানত প্রবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা হিসেবে সংগৃহীত হয়ে থাকে। এসব সংগঠনের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে্য সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে।

জামায়াতের কার্যকলাপ এখন আন্তর্জাতিক, তাই সে কার্যকলাপের বিরুদ্ধে লড়াইও হতে হবে আন্তর্জাতিক। এই কাজে প্রতিবেশী ভারত আমাদের অংশীদার হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোকেও সহযোগী হিসেবে একটি অভিন্ন প্রতিরোধ কর্মসূচির ভেতরে আনা সম্ভব হলে এদের কার্যকলাপের ওপর নজরদারি সহজতর হবে।

তবে আসল লড়াই হতে হবে দেশের ভেতরেই। জামায়াত একটি মতবাদ, তার বিরুদ্ধে লড়াই শুধু একটি সংগঠন ও হাতে গোনা কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে হতে পারে না। এর জন্য দরকার এই মতবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। দরকার একটি পাল্টা মতবাদ, যা মানবিকতার শক্তিতে মৌলবাদের বিরুদ্ধে বর্ম হয়ে উঠবে। এই কাজ আমরা সম্ভবত যথাথভাবে করে উঠতে পারছি না। লেবাস বদলে জামায়াতের মতবাদে বিশ্বাস করে এমন অনেক ধর্মভিত্তিক দল এখন দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিসমূহের নিকট মিত্র হয়ে উঠেছে। এদের প্রভাবেই শিক্ষাসহ সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে মৌলবাদী ধ্যানধারণা প্রশ্রয় পাচ্ছে।

এই ‘ট্রয়ের ঘোড়াকে’ সামাল না দিতে পারলে একদিন আমাদের পস্তাতে হবে।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক