বাঙালির মনন ও বাংলা একাডেমি

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ

৩৩ বছর আগে আজকের দিনে ১৯৮৬ সালের ৩ ডিসেম্বর কথাশিল্পী শওকত ওসমান বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা দিবস ভাষণে বলেছিলেন ‘বাংলা একাডেমি কি প্রাতিষ্ঠানিক একটি নামমাত্র? না। এই নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দেশের ইতিহাস অতীতের অযুত নর–নারীর যৌথ কণ্ঠস্বররূপে দুদ্দাড় আমার কানে আছড়ে পড়ে। এই প্রতিষ্ঠান পৃথিবী অবলোকনের জানালা, জ্ঞানচর্চার বিশাল নিকেতনরূপে কালে কালে বিস্তার লাভ করুক। বাংলাদেশের ঠিকানা হোক বাংলা একাডেমি।’

১৯৫২ সালের মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪–এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর ফ্রন্টের ২১ দফার ষোড়শ দফার বাস্তবায়ন হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা-বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৫৫–এর ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির যাত্রা শুরু হয়। পৃথিবীর নানা দেশে ভাষা ও সাহিত্য গবেষণাকেন্দ্রিক বহু সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু বলতে গেলে তাদের কোনোটিরই ভাষা আন্দোলনের মতো এমন ঐতিহাসিক সংগ্রামী প্রেক্ষাপট নেই।

বাংলা একাডেমির জনপরিচিতির অনেকটাই আজ বিশ্বের দীর্ঘকালব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজক হিসেবে। যদিও গ্রন্থমেলার আয়োজন করাই একাডেমির মূল কাজ নয়। ৬৪ বছর ধরে বাংলা একাডেমি শিক্ষা-ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে অসাধারণ সব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে এসেছে।

১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় সাড়ে ছয় দশকের বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযাত্রায় বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে বাংলা একাডেমি। সাহিত্য-সংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠানের সমান্তরালে পরিচালনা করে আসছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের প্রায় এক শ টি কোর্স। আধুনিক বাংলা অভিধান–এর পাশাপাশি প্রকাশ করেছে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ঐতিহাসিক অভিধান–এর পাশাপাশি বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান, সংগীতসাধক অভিধান–এর পাশাপাশি বিজ্ঞান বিশ্বকোষ, প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ–এর পাশাপাশি উপভাষাবিষয়ক বই।

বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস–এর পাশাপাশি প্রকাশ করেছে ইউরোপ, আফ্রিকা ও আরব জাতির প্রামাণ্য ইতিহাসের অনুবাদ। আহমদ শরীফের সম্পাদিত লায়লী মজনু (১৯৫৭) বই প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রকাশনা ক্ষেত্রে যাত্রা শুরু করে প্রাচীন-মধ্য-আধুনিক যুগের ইতিহাস গ্রন্থাবলি, বিশ্বখ্যাত আত্মজীবনী, বিজ্ঞান, দর্শন, নাটক, পাঠ্যপুস্তক, শিশুসাহিত্য ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত প্রায় ছয় হাজার বইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলা একাডেমি ধ্রুপদি ও সমকালীন বিশ্বজ্ঞানসমুদ্রের বিচিত্র কল্লোলের সঙ্গে বাঙালি মননের যোগসূত্র স্থাপন করেছে।

গুরুভার বিষয়ের বইও যে সাধারণ পাঠকের কাছে বিপুলভাবে আদৃত হতে পারে, তা একাডেমির ভাষাশহীদ গ্রন্থমালার আওতায় প্রকাশিত ১০১টি বই ও জীবনীগ্রন্থের পাঠকপ্রিয়তার দিকে লক্ষ করলেই অনুধাবন করা যায়। এ কথা আজ জোর দিয়ে বলা যায়, বিগত দুই–আড়াই শ বছরের বঙ্গীয় মনীষার চিন্তাচর্চার পূর্ণায়ত ধারা বুঝতে হলে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত আলাওল রচনাবলি থেকে রণেশ দাশগুপ্ত রচনাবলির পরম্পরার কাছে আমাদের আসতেই হবে।

বাংলা একাডেমির নিয়মিত পত্রিকা উত্তরাধিকার, ধানশালিকের দেশ, বাংলা একাডেমি পত্রিকার পাশাপাশি সম্প্রতি দ্য বাংলা একাডেমি জার্নাল,
বাংলা একাডেমি বিজ্ঞান পত্রিকা, বাংলা একাডেমি বার্তা নতুন করে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাংলা একাডেমি ফোকলোর পত্রিকা নামে একটি নতুন সাময়িকপত্র প্রকাশের তৎপরতা শুরু হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে ফোকলোর বিষয়ে একাডেমির সুদীর্ঘকালের অঙ্গীকার একটি নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে।

বাংলা একাডেমি অতীত ও নতুনের মধ্যে পরম্পরা সৃষ্টিতে বিশ্বাসী। তাই আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনের পাশাপাশি অবস্থান করে কবি শামসুর রাহমান সেমিনারকক্ষ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ ভবনে অবস্থান করে শহীদ মুনীর চৌধুরী সভাকক্ষ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক ভবনের পাশেই অবস্থান করে কবি জসীমউদ্‌দীন ভবন কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সভাগৃহ। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের স্মৃতিবাহী। এই প্রতিষ্ঠান তাঁদের সৃষ্টির পথরেখাকে যেমন রবীন্দ্র চত্বর ও নজরুল মঞ্চ বা সম্প্রতি নব কলেবরে চালু করা নজরুল স্মৃতিকক্ষের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় করে রাখার প্রয়াস পেয়েছে, তেমনি বারো খণ্ডের নজরুল রচনাবলি ও পাঁচ খণ্ডের রবীন্দ্রজীবন–এর মধ্য দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে চাইছে তাঁদের অনশ্বর সৃষ্টির প্রভাবরেখা। মীর মশাররফ হোসেন ও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের রচনাকর্ম প্রকাশের পাশাপাশি দেশের দুই প্রত্যন্ত অঞ্চল রাজবাড়ীর পদমদী ও রংপুরের পায়রাবন্দে এই দুই মহৎ বঙ্গীয় মনীষার স্মৃতিবিজড়িত স্থানে প্রতিষ্ঠা করেছে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র ও বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। সংস্কৃতির কেন্দ্রচ্যুত প্রান্তিকায়নে দুটো কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

যে ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী মোহনায় বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা, সে আন্দোলনের শহীদ স্মরণে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছে ভাষা আন্দোলন জাদুঘর, প্রকাশ করেছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ভাষাশহীদ ও ভাষাসংগ্রামীদের জীবনী। শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দলিলপত্র থেকে শুরু করে খণ্ডে খণ্ডে একাত্তরের স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাস, বীরশ্রেষ্ঠদের জীবনী ও শহীদ বুদ্ধিজীবীর রচনাবলি প্রকাশের দায়িত্ব পালন করেছে একাডেমি।

বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একাত্তরের মার্চে গণ–আন্দোলনের শহীদদের পরিবারের সাহায্যার্থে খোলা তহবিলে নিজেদের এক দিনের বেতন তুলে দেন। একাডেমির প্রেসে গোপনে প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধের বুলেটিন জয় বাংলা। একাডেমি প্রাঙ্গণে মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলার কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীরা শপথ নিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। তাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ কালরাতে ঐতিহাসিক বর্ধমান হাউসকে লক্ষ্য করে শেল নিক্ষেপ করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সূতিকাগারকে ধ্বংস করা। কিন্তু বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের মতোই ধ্বংসের কালরাত পেরিয়ে স্বাধীনতার আভায় নতুন করে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে বাংলা একাডেমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারে, ১৯৭১ সালের একুশের অনুষ্ঠানমালায় একাডেমি কোনো সরকারি কর্তাব্যক্তির বদলে প্রধান অতিথি করে এনেছিল ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাংলার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমিতেই বঙ্গবন্ধু উদ্বোধন করেছিলেন স্বাধীন বাংলার প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন, যেখানে বাংলা ও বাঙালির কবি নজরুল থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বশীল কবি-লেখক অংশ নিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিশ্ব শিল্পসাহিত্যের অঙ্গনে উঠে দাঁড়িয়েছে। বাংলা একাডেমি বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা বইয়ের গর্বিত প্রকাশক। শিগগিরই একাডেমি থেকে প্রকাশ পাবে তাঁর চীন ভ্রমণের বৃত্তান্ত। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শতবর্ষ গ্রন্থমালার আওতায় তাঁর জীবন ও কৃতির নানা দিক নিয়ে ১০০টি বই প্রণয়ন ও প্রকাশের কাজ চলমান।

বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধবাহিত বাংলাদেশের মানুষের মনন ও স্বপ্নকে সফল করতে এভাবেই এগিয়ে চলেছে। শুভ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, বাংলা একাডেমি।

পিয়াস মজিদ: কবি, প্রাবন্ধিক