খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা বনাম মেগা প্রকল্প

বাংলাদেশ শুধু একটি জনবহুল দেশ নয়, অতিঘটনাবহুল দেশ। সমাজ বিশৃঙ্খল বলে এখানে ঘটে যত সব অস্বাভাবিক ঘটনা। একটি ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করার আগেই ঘটে আরেকটি ঘটনা, তাতে আগেরটি চাপা পড়ে যায়।

সমাজে নানা রকম সমস্যা থাকবেই। সেগুলো সমাধানেরও উপায় থাকবে। তবে মানুষের যত রকম সমস্যা রয়েছে, তার মধ্যে খাদ্যদ্রব্যের অপ্রতুলতার সমস্যা প্রধানতম। অন্য যেকোনো কিছুর অভাব কিছু সময় পর্যন্ত সহ্য করা যায়, কিন্তু খাদ্য ও পানির অভাব অসহনীয়। গত দেড় শ বছরে খাদ্যসংকটের কারণে বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশের যত সরকার বিপর্যস্ত হয়ে বিদায় নিয়েছে, অন্য কোনো কারণে তা হয়নি এবং বাস্তবতা হলো পরিস্থিতি সংকটাপন্ন না হওয়া পর্যন্ত কোনো সরকারেরই টনক নড়ে না। অনেক ক্ষেত্রে টনক যখন নড়ে, তখন আর কিছুই করার থাকে না। সেটা দেখা গেছে চল্লিশের দশকে দুর্ভিক্ষের সময়, পঞ্চাশের দশকে যুক্তফ্রন্টের সরকারের দুর্ভিক্ষাবস্থার মধ্যে এবং ১৯৭৪-এ।

সম্প্রতি পেঁয়াজ নিয়ে যা ঘটেছে, তা কোনো সামান্য ব্যাপার নয়। তবে সেটি এমন এক খাদ্যবস্তু, যা না খেলে মানুষ মরে না। এক ভোক্তা টেলিভিশনে বলেছেন, তাঁর বাড়িতে ১৮ দিন যাবৎ পেঁয়াজ ছাড়াই রান্নাবান্না চলছে। কিন্তু চাল, ডাল, আটা, লবণ ছাড়া ১৮ ঘণ্টার বেশি চলা কঠিন হতো।

মজুতদারি ও মুনাফাখুরির একটা মাত্রা আছে। প্রশাসনের প্রশ্রয় ছাড়া সেই মাত্রা অতিক্রম করার ক্ষমতা তাঁদের নেই। বাংলাদেশের পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা যেমন দুঃসাহসী, মজুতদারেরা তাঁদের চেয়ে কম দুঃসাহসী নন। পেঁয়াজ নিয়ে তাঁরা যে ড্রেসরিহার্সাল দিলেন এবং তাতে তাঁদের যে বিপুল সাফল্য, তাতে ভবিষ্যতে বড় রকমের বিয়োগান্ত নাটক মঞ্চায়নে তাঁদের জন্য কোনো সমস্যাই হবে না। প্রশাসন ও সরকারের দৌড় কতটা, তা তাঁরা বুঝে গেছেন।

পেঁয়াজের দাম যা বাড়ার, তা তো বেড়েছেই, মানুষ তা মেনে নিয়েছে তাদের নিয়তি বলে, কিন্তু যা মেনে নিতে পারেনি তা হলো দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সুবচন। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে অনেকেরই সংকোচ নেই। বড় বড় কথা বলতেও লজ্জা হয় না। সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্তা বললেন, দু-তিন বছর পর বাংলাদেশ ভারতে পেঁয়াজ রপ্তানি করবে। সব ব্যাপারে জনগণের সঙ্গে পরিহাস চলে না।

তাঁর এই কথা বিশ্বাস করত মানুষ, যদি তাঁর আগের আর একটি কথা সত্য প্রমাণিত হতো। ১০ দিনের মধ্যে পেঁয়াজের দাম ৫০ টাকা কেজি হবে, এমন কথা তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন। আমার এই লেখা যেদিন প্রকাশিত হবে, সেদিন তাঁর ১০ দিনের সময়সীমা শেষ হবে। অবশ্য বাঙালি ঠাট্টা-মশকরা পছন্দ করে। কোনো কারণে কারও বক্তব্য ভুল বা অসত্য হলে ক্ষমা চাওয়াটাই রীতি। ক্ষমা চাইতে ভালো না লাগলে দুঃখ প্রকাশ করা উচিত।

আত্মপ্রতারণায় আমরা অদ্বিতীয়। এ সম্পর্কে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে কৃষি পরিসংখ্যান নিয়ে। কর্মকর্তাদের সব মুখস্থ। কয়েক বছর আগে আমি এক উপজেলার একজন কৃষি কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁর এলাকায় মাষকলাই চাষ হয় কী পরিমাণ জমিতে। তিনি একটা অঙ্ক বললেন এবং সেই সঙ্গে যোগ করলেন সারা দেশে কত একর বা হেক্টর জমিতে মাষকলাই চাষ হয়। আমি তাঁকে বললাম, আমার সারা দেশের খবরের দরকার নেই। আপনার এলাকার কোন মাঠে চাষ হয়, বলুন, আমি সেখানে দেখতে যাব। তিনি আমতা-আমতা করে মাথা চুকলাতে লাগলেন। যে দেশে আদমশুমারি হয় ঘরে বসে, সেখানে কৃষি পরিসংখ্যান টেবিলে বসেই হবে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা কেন্দ্র ও ইনস্টিটিউটের অভাব নেই। সেসব প্রতিষ্ঠানে লোকবলেরও ঘাটতি নেই। তবে কোনো গবেষক ও বিজ্ঞানী যদি একবার কর্মকর্তায় পরিণত হন, তখন তাঁর মনোযোগ থাকে ইনক্রিমেন্ট ও পদোন্নতির প্রতি। তাঁর কাছে গবেষণার আনন্দের চেয়ে চাকরির বেতন-ভাতার আনন্দ বড় করে দেখা দেয়।

প্রায় সব ধরনের মসলা আমাদের আমদানি করতে হয়। কোনো কোনো মসলা আমদানি করতেই হবে, যেমন এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ প্রভৃতি। অধিকাংশ মানুষের ওসবের প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে মসলা গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে গবেষকেরা আছেন। আমাদের বহু কৃষিবিজ্ঞানীর অবদানও অসামান্য। উচ্চফলনশীল অনেক কিছু তাঁরা উদ্ভাবন করেছেন। সেগুলো ফলিয়ে সাধারণ কৃষকেরা কৃষিতে উন্নতি ঘটিয়েছেন। মাছ, ফলমূল ও শাকসবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিপুল।

কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণা এক জিনিস, কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের গবেষণা ও পর্যালোচনা অন্য বিষয়। দেশে কোন কৃষিপণ্যের প্রয়োজন কতটা, তা কৃষিবিজ্ঞানী নন, সরকারি কর্মকর্তাদের অঙ্ক কষে দেখার কথা। জনসংখ্যা বাড়লে চাহিদা বাড়বে, সুতরাং সেই অনুপাতে উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সেইভাবে কৃষককে প্রণোদনা দিতে হবে। নাকে তেল দিয়ে ঘুমালে সমস্যা দেখা দেবেই।

সরকার অঙ্ক কষে দেখেছে যে বছরে ২৪ লাখ টন পেঁয়াজ লোকে খায় এবং এটাও দেখেছে যে উৎপাদন ১৭-১৮ টন। আমরা আমাদের পারিবারিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, খেত থেকে তোলার পর পেঁয়াজের যে ওজন থাকে, তিন-চার মাসের মধ্যে তার ওজন কমে যায় ১০-১২ ভাগ। সে জন্য বাংলাদেশকে ১০ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।

পেঁয়াজ-রসুনের ঘাটতি কমানোর পথ দুটি—উৎপাদন বাড়ানো এবং আমদানি করা। প্রথমটি ছিল সহজতর, অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর, কিন্তু সেটি না করে দ্বিতীয়টির ওপর নির্ভর করা হচ্ছে; কারণ, সেটা আমদানিকারকদের পছন্দ এবং তাঁদের উপকারে আসে। অন্যদিকে কৃষকেরাই-বা আরও বেশি উৎপাদন করতে চান না কেন? তাঁদের তা না চাওয়ার সংগত কারণ রয়েছে। পেঁয়াজ উৎপাদনে প্রতি কেজিতে খরচ হয় ২৩-২৪ টাকা। সেই পেঁয়াজ উৎপাদন মৌসুমে তাঁরা বিক্রি করেন ১৫-১৬ টাকায়। কৃষকের ছেলেমেয়েদের এক-আধ দিন ইলিশ বা রুই মাছ খাওয়ার ইচ্ছা হয়। এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ বা রুই মাছ কিনতে বিক্রি করতে হয় ৪০ কেজি পেঁয়াজ।

বাংলাদেশের জিডিপি তরতর করে বাড়ছে। জিডিপি বাড়ার জন্য আমরা ভারী শিল্পকারখানার ওপর জোর দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার জন্য শিল্পকারখানা দরকার। এ যুগে শিল্পেও উন্নতি করতে হবে। তবে শিল্পে যদি অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভালো করতে না পারি, আমরা মরব না, কিন্তু কৃষিতে ভালো না করলে না খেয়ে মরার আশঙ্কা।

কৃষির প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি আরও ইতিবাচক হওয়া দরকার। কৃষকেরা স্যুট-কোট পরেন না বলে সরকারি কার্যালয়ে তাঁদের কদর নেই। তাঁরা সড়ক পরিবহন ও নৌপথশ্রমিকদের মতো কথায় কথায় ধর্মঘট করতে পারেন না। তাঁরা সড়কে ধান ফেলে দিয়ে যে প্রতিবাদ করেন, তা সরকারের গায়ে লাগে না।

ক্রেতা পর্যায়ে কৃষিপণ্যের দাম বাড়ার কারণ বর্তমান ব্যবস্থা। একটি পণ্য তিন-চার জায়গায় হাতবদল হয়ে ভোক্তার হাতে আসে। ফড়িয়া আছে, মজুতদার আছে, চাঁদাবাজি তো সীমাহীন। জাতীয় সংসদের মাননীয়দের অধিকাংশই হয় ব্যবসায়ী, নয় তো ব্যবসায়ীবান্ধব।

দানাদার শস্য এবং শাকসবজি প্রভৃতির ফলন বাড়ছে। কিন্তু জমি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক অতিমাত্রায় ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ালে তা হবে আত্মঘাতী। সে জন্য খুব সতর্কতার সঙ্গে সমস্যা শনাক্ত করে কৃষিনীতি প্রণয়ন করতে হবে। খাদ্যশস্যের বাফার স্টক বা পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করতে হবে, যেমন অনেক উন্নত দেশ করে।

মজুতদার, মুনাফাখোরদের প্রতি সদয় থেকে খাদ্যশস্যের ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য রোধ করা সম্ভব নয়। কৃষক পান না ধানের দাম, অন্যদিকে চালের দাম বেশি—রহস্য কোথায়? চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন অটো চালকলের মালিকেরা। কিন্তু তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করার বা নজরদারিতে রাখার ক্ষমতা রাষ্ট্রযন্ত্রের নেই। সিন্ডিকেট নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের কাছ থেকে লুণ্ঠন করে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। খাদ্যে স্বয়ম্ভরতাকে অগ্রাধিকার না দিলে শুধু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল জাতি গঠন সম্ভব হবে না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক