কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি

বছর কয়েক আগের ঘটনা, একটি সম্মেলনে যোগ দিতে বিদেশে গিয়েছিলাম। যে হোটেলে এর আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে পরিচয় হলো একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর সঙ্গে। সম্মেলনে তিনিও অংশ নিচ্ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই আমি ভেবেছিলাম, তাঁকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য। কিন্তু যখন দেখলাম, কারও সাহায্য ছাড়া হুইলচেয়ারটি ব্যবহার করে তিনি একাই সুন্দরভাবে চলেফিরে বেড়াচ্ছেন, তখন ভালোই লাগল। যে হোটেলের মিলনায়তনে সম্মেলনটি আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে প্রতিবন্ধীবান্ধব চলাফেরার সুব্যবস্থা ছিল। আরও বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, ফেরার সময় তিনি নিজেই হুইলচেয়ার চালিয়ে গাড়ির কাছে গেলেন এবং গাড়িতে উঠে স্টিয়ারিং হুইলে বসে পড়লেন। তারপর দিব্যি গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেলেন। দেখলাম, গাড়িটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীরা সহজে উঠতে, নামতে, বসতে এমনকি গাড়িটি চালাতেও পারেন। আবারও উপলব্ধি করলাম, অক্ষমতা নয়, বরং আমাদের অবকাঠামো থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকে না বলেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মূলস্রোতে মিশে যেতে পারেন না।

সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো, যথেষ্ট প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার অধিকারী হয়েও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি অবহেলা এবং তাঁদের সবকিছুর বাইরে রাখার এক অদ্ভুত প্রবণতা আমাদের অনেকের মধ্যে কাজ করে। অথচ আমাদের মানসিকতা যদি একটু ইতিবাচক হতো, তাহলে অন্য দশজনের মতো তাঁরাও সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে এবং জাতীয় উন্নয়নে অনেক অবদান রাখতে পারতেন।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগের ১ ভাগ শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী। তাদের বেশির ভাগই অতিদরিদ্র এবং গ্রামে থাকে। তারা নিজেরা তো বটেই, কখনো কখনো তাদের পরিবারও সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় বাস করে। এর ফলে মূলধারার উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে তারা বাদ পড়ে যায়। সবচেয়ে করুণ দশা হয় প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুদের। এমনিতেই নারী ও শিশু সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে সমাজের দুর্বলতর শ্রেণি। তাদের মধ্যে যারা আবার শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধিতার শিকার, তাদের অবস্থা অনুমান করা কঠিন নয়। যা-ই হোক, আমাদের মনে রাখতে হবে, সমাজের লাখ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে এক কোণে সরিয়ে রেখে জাতীয় উন্নয়ন কোনো দিনই সম্ভব নয়। কাজেই তাদের দিকে রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়কেই বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশ অষ্টম দেশ হিসেবে জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক সনদে স্বাক্ষর করেছে। এ সনদ ২০০৮ সাল থেকে কার্যকর রয়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী জনগণের জন্য যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করেছে। আইনটির কার্যকর প্রতিফলন ঘটাতে হলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে শিক্ষা-কর্মসংস্থানসহ সব ক্ষেত্রে সমান সুযোগ দিতে হবে। আমরা জানি, সরকার ইতিমধ্যে এ ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি চাকরিতে তাঁদের জন্য বিশেষ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে; সাম্প্রতিক বাজেটগুলোতে তাঁদের জন্য পৃথক ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে; প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ চাকরি মেলারও আয়োজন করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এসব পদক্ষেপের কোনো কার্যকর তদারকির ব্যবস্থা নেই। এর ফলে এসব কার্যক্রম থেকে কতটা সুফল আসছে, তা স্পষ্ট নয়। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে নিবন্ধনের প্রক্রিয়াটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ। অনেক সময় সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে এটিই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বর্তমানে প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি বরাদ্দের দিকটি বিবেচনা করলে দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যই অধিকাংশ ব্যয় হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিশুরা অনেকটাই এর বাইরে থেকে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী শিশুর বিকাশের গুরুত্বকে সামনে আনা জরুরি। তাদের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো সম্ভব হলেই একমাত্র তারা ভবিষ্যতে জাতীয় উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে পারবে। কিন্তু আমরা কি প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ও পরিপূর্ণ বিকাশে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি? গণপরিবহনে করে তারা যেন অনায়াসে স্কুলে যাতায়াত করতে পারে, সে ব্যবস্থা আমরা করতে পেরেছি কি? শ্রেণিকক্ষে তাদের জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন, তা কি তারা পাচ্ছে? জানি, এর সব কটির উত্তরই হবে ‘না’।

যত দিন পর্যন্ত না এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ‘হ্যাঁ’ হচ্ছে, তত দিন আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী জনগণ পিছিয়েই থাকবে, দেশ বঞ্চিত হবে তাদের অবদান থেকে। তবে আশার কথা হচ্ছে, পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নানা ধরনের কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে। তারা নীতিমালা পরিবর্তন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচারণা চালাচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তাও দিচ্ছে। কিন্তু তাদের এই কার্যক্রম লম্বা সিঁড়ির শুরুর ধাপমাত্র। যতক্ষণ পর্যন্ত না ব্যক্তিমালিকানা খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এবং সরকার এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে নেতৃস্থানীয় গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পেরেছে। বৈচিত্র্যের মাধ্যমে যে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, এই মৌলিক বিষয়টিই এখনো বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান উপলব্ধি করতে পারেনি। ব্যক্তিমালিকানা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো টেবিলভিত্তিক কাজ ও প্রযুক্তিভিত্তিক চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত নিয়োগ দিচ্ছে না। বেসরকারি খাতে এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান করা সম্ভব, কিন্তু যোগ্য কর্মী খুঁজে পেতে হলে যে তথ্য-উপাত্ত দরকার, তা তাদের কাছে নেই। অন্যদিকে এনজিওগুলোর কাছে এ বিষয়ে হয়তো তথ্য-উপাত্ত আছে, কিন্তু নিয়োগের জন্য বাজেট নেই। উন্নয়ন সংস্থাগুলো এবং ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

মাত্র এক প্রজন্ম আগের কথা, কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণের বিষয়টি সাধারণ মানুষের চিন্তার বাইরে ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। এখন কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ প্রশংসিত হচ্ছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য তা সাফল্যের একটি মাপকাঠিও বটে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, প্রতিবন্ধীবান্ধব যানবাহন ও অবকাঠামো এই জনগোষ্ঠীর জ্ঞান ও দক্ষতার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে সাহায্য করতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক তৈরি করবে, জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত আমরা ইতিমধ্যে স্থাপন করেছি।

মারিয়া হক: ব্র্যাকের হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড লার্নিং বিভাগের পরিচালক