আমার বাবার জুতা

হ‌ুমায়ূন আহমেদ
হ‌ুমায়ূন আহমেদ
১৯৭১ সালে আমাদের বিজয়ের মুহূর্তের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখা সংকলিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে, ভোরের কাগজ পত্রিকার বিজয় দিবসের ক্রোড়পত্রে। সেই লেখাগুলো নিয়ে প্রথমা প্রকাশন প্রকাশ করেছে বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১ শিরোনামের একটি বই। এবার বিজয়ের মাসে আমরা বইটি থেকে কিছু নির্বাচিত লেখা প্রকাশ করছি প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য। আজ ছাপা হলো হ‌ুমায়ূন আহমেদ–এর লেখাটি।


আমার দূরসম্পর্কের এক চাচা বিজয় দিবসের স্মৃতি এভাবে বলেন, খবরটা শোনার পরে কানের মধ্যে ‘তবদা’ লেগে গেল। আর কিছুই কান দিয়ে ঢোকে না। আমি দেখছি সবার ঠোঁট নড়ে, কিন্তু কিছু শুনি না। আজব অবস্থা। একজন মাতালকে নেশা কেটে যাওয়ার পর যদি জিজ্ঞেস করা হয়, নেশা করার ওই রাতে তুমি মদ্যপান ছাড়া আর কী করেছিলে? সে পরিষ্কার কিছু বলতে পারবে না। বলতে পারার কোনো কারণ নেই। বিজয় দিবসে আমরা সবাই এক প্রচণ্ড নেশার মধ্যে ছিলাম।

আজ আমি বিজয় দিবসের স্মৃতির গল্প করব না। আমি বরং আমার বাবাকে নিয়ে একটি গল্প বলি।

আমার বাবার এক জোড়াই জুতা ছিল। লাল রঙের চামড়ার জুতা। মাল্টিপারপাস জুতা। সাধারণভাবেও পরতেন, আবার তাঁর পুলিশের ইউনিফর্মের সঙ্গেও পরতেন। জুতা জোড়ার সঙ্গে আমরা খুব পরিচিত, কারণ আমাদের প্রায়ই তাঁর জুতা কালি করতে হতো। কাজটা আমাদের খুব পছন্দের ছিল। জুতার কালির গন্ধটা খুব মজা লাগত। আবার ব্রাশ ঘষতে ঘষতে জুতা যখন ঝকঝকে হয়ে উঠত, তখন দেখতে ভালো লাগত। সবচেয়ে বড় কথা, ঝকঝকে জুতা দেখে বাবা বলতেন, ‘আরে বাপ রে এক্কেবারে আয়না বানিয়ে ফেলেছে।’ এই বাক্যটি শুনতেও বড় ভালো লাগত।

১৯৭১ সালের ৫ মে আমার বাবা তাঁর লাল জুতা পরে বরিশালের গোয়ারেখো গ্রাম থেকে বের হলেন। সেদিন জুতাজোড়া কালি করে দিল আমার ছোট বোন। বাবা যথারীতি বললেন, ‘আরে বাপ রে এক্কেবারে আয়না বানিয়ে ফেলেছিস দেখি।’ সেই তাঁর জুতা পরে শেষ বের হয়ে যাওয়া।

সন্ধ্যার সময় খবর এল, বলেশ্বর নদের তীরে দাঁড় করিয়ে মিলিটারিরা তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। মানুষকে যে এত সহজে মেরে ফেলা যায়, তা আমার মা তখনো জানতেন না। তিনি খবরটা বিশ্বাস করলেন না। তিনি আমাদের ডেকে বললেন, তোরা এই লোকগুলোর কথা বিশ্বাস করিস না। তোর বাবা সারা জীবনে কোনো পাপ করেনি। এ রকম মৃত্যু তাঁর হতে পারে না। তোর বাবা অবশ্যই বেঁচে আছেন। যেখানেই থাকুন তিনি যেন সুস্থ থাকেন, এই দোয়া কর। আমি জানি তোর বাবার সঙ্গে তোদের আবার দেখা হবে, অবশ্যই হবে।

একজনের বিশ্বাস অন্যের মধ্যে সংক্রমিত হয়। আমরা সবাই মায়ের কথা বিশ্বাস করলাম। এর মধ্যে মা এক রাতে স্বপ্নেও দেখলেন, মিলিটারিরা বাবাকে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে সেখানের এক জেলে আটকে রেখেছে। বাবা স্বপ্নে মাকে বললেন, ‘দেশ স্বাধীন হলেই এরা আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। এই কদিন একটু কষ্ট করে থাকো।’

মা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিছুই খেতে পারতেন না। এই স্বপ্নের পর আবার অল্পস্বল্প খেতে শুরু করলেন। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম স্বাধীনতার দিনটির জন্য। আমরাও মায়ের মতোই ধরে নিয়েছিলাম, দেশ স্বাধীন হলেই বাবাকে পাওয়া যাবে। মায়ের প্রতি আমাদের এই অবিচল বিশ্বাসের কারণও আছে। আমার মা কখনোই তাঁর ছেলেমেয়েদের কোনো ভুল আশ্বাস দেননি।

আমরা তখন গ্রামে পালিয়ে আছি। মে মাস প্রায় শেষ হতে চলছে। ঘোর বর্ষা। দিনের পর দিন একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। তখন অদ্ভুত একটা খবর পাওয়া গেল। এক লোক নাকি বলেশ্বর নদ দিয়ে ভেসে যাওয়া একটা লাশ তুলে কবর দিয়েছে। তার ধারণা, এটা পিরোজপুরের পুলিশপ্রধান ফয়জুর রহমান আহমেদের লাশ। সে লাশটা কবর দিয়েছে, তবে প্রমাণের জন্য লাশের পা থেকে জুতা জোড়া খুলে রেখেছে। এই জুতা জোড়া সে আমাদের হাতে তুলে দিতে চায়। আমার মা বললেন, অসম্ভব! এটা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই অন্য কারও জুতা। তবু পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য আমাকে জুতা আনতে শহরে পাঠালেন। আমাকে পাঠানোর কারণ হলো, আমার মায়ের ধারণা, আমি খুব ভাগ্যবান ছেলে। আমি কখনো অমঙ্গলের খবর আনব না।

মিলিটারিতে তখন পিরোজপুর গিজগিজ করছে। এ অবস্থায় কোনো যুবক ছেলের শহরে ঢোকা মানে জীবন হাতে নিয়ে ঢোকা। তার ওপর শুনেছি, মিলিটারিরা আমাকে এবং আমার ছোট ভাইকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আমি শহরে গেলাম লুঙ্গি, পাঞ্জাবি এবং টুপি মাথায় দিয়ে। যেন কেউ চিনতে না পারে। ওই লোককে খুঁজে বের করলাম। আমাকে জুতা জোড়া দেওয়া হলো। হ্যাঁ, আমার বাবারই জুতা। ভুল হওয়ার কোনোই কারণ নেই। জুতা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরলাম। আমার মা জুতা দেখলেন, তিনিও বুঝলেন এটা কার জুতা, তারপরও বিশ্বাস করলেন না। এক রকম জুতা তো কত মানুষেরই থাকতে পারে। তিনি আমাদের বললেন, জুতা দেখে তোরা মন খারাপ করিস না। এটা মোটেই কোনো জোরালো প্রমাণ না। জুতা জোড়া কাগজে মুড়ে এক কোনায় রেখে দেওয়া হলো।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর মা ঢাকা থেকে পিরোজপুর গেলেন। নদীর পাড়ে যেখানে বাবাকে কবর দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে, সেই জায়গা নিজে উপস্থিত থেকে খোঁড়ালেন। কবর থেকে লাশ তোলা হলো। শরীর পচে গলে গেছে, কিন্তু নাইলনের মোজা অবিকৃত। মা পায়ের মোজা, দাঁত, মাথার চুল দেখে বাবাকে শনাক্ত করলেন। দীর্ঘ ছয় মাস পর তিনি স্বীকার করলেন, তাঁর স্বামী বেঁচে নেই।

তিনি ঢাকায় ফিরে এলেন, আমাদের যে এত দিন মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমার সবচেয়ে ছোট বোনটি অসুস্থ। সে কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না। মা আমার ছোট ভাইকে বললেন, তাকে যেন বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলা হয়।

সন্ধ্যাবেলা মা কাগজের মোড়ক থেকে জুতা জোড়া বের করলেন। অনেক সময় নিয়ে পরিষ্কার করলেন। লাল কালি কিনে এনে জুতা কালি করা হলো। আমরা দেখলাম, তাঁর বিছানায় বালিশের পাশে জুতা জোড়া রাখা হয়েছে। সেই রাতে তিনি বাবার জুতা জোড়া জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুতে গেলেন।

প্রতিবছর বিজয় দিবস আসে, আমি নিজের হাতে বাসায় একটা পতাকা টানাই। পতাকাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে বড় ভালো লাগে। আমার কী সৌভাগ্য, স্বাধীন দেশের পতাকা নিজের হাতে ওড়াচ্ছি।

আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব

ফুরায়ে গেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।

[ঈষৎ সংক্ষেপিত]

হ‌ুমায়ূন আহমেদ: কথাশিল্পী (১৯৪৮–২০১২)