দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক

বিদ্যুতের মূল্যনিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) পাইকারি ও খুচরা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর চার দিনের গণশুনানি শেষ হয়েছে। বিইআরসির বিধান অনুযায়ী কোনো বিতরণ সংস্থা লাভজনক থাকলে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে পারে না। দেশে গ্রাহক পর্যায়ে ৬টি বিতরণ সংস্থা আছে—যথাক্রমে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) এবং ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। এর মধ্যে পিডিবি দেশে এককভাবে পাইকারি বিদ্যুৎ বিক্রির পাশাপাশি গ্রাহক পর্যায়েও বিদ্যুৎ বিতরণ করে থাকে।

বিতরণ সংস্থাগুলোর মধ্যে ডেসকো পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানি। ২০১৫ সাল থেকে টানা চার বছর নগদ ১০ শতাংশ প্রণোদনা দিয়েছে প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে। অন্য ৫টি সংস্থাও লাভে রয়েছে।

এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক ও বেআইনি। আগে বিতরণ সংস্থাগুলোকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা লোকসানে চলছে। তারপরই মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি হতে পারে। তার আগে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আলোচনায়ই হতে পারে না।

পিডিবি পাইকারি বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে ১ টাকা ১১ পয়সা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। সংস্থাটির দাবি, দাম না বাড়ালে ২০২০ সালে ৮ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। কিন্তু জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিবর্তে এই খাতে যে অদক্ষতা, অপচয় ও দুর্নীতি আছে; সেটি কমাতে পারলে ঘাটতি অনেকটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। গ্রাহকদের ওপর চাপ না বাড়িয়ে সরকারের উচিত সেদিকে মনোযোগ দেওয়া। উল্লেখ্য, গত ১০ বছরে সরকার খুচরা বা গ্রাহক পর্যায়ে ছয়বার ও পাইকারি পর্যায়ে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এবার নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া নিয়ে জনমনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

পাইকারি দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি হিসেবে পিডিবি আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার অবমূল্যায়ন, গ্যাসের দাম ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি, কয়লার ওপর নতুন করে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বাড়ার কথা বলেছে। তাদের এই যুক্তি হয়তো অমূলক নয়। কিন্তু ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার বিকল্প পথ আছে কি না সেটিও সরকারকে ভাবতে হবে। বিতরণ সংস্থাগুলোর অর্থ পরিশোধ না করার দায় পিডিবি গ্রাহক সাধারণের ওপর চাপাতে পারে না। যদি কোনো বিতরণ সংস্থা বিদ্যুতের বর্তমান দাম শোধ না করে থাকে, তারা বর্ধিত দাম শোধ করবে তার নিশ্চয়তা কী। 

প্রশ্ন উঠেছে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো টিকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা নিয়েও। ২০০৯-১০ সালে আপাত–সংকট কাটাতেই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো চালু করেছিল। উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি দাম দিয়ে সরকার তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনেছে। দেশের শিল্পকারখানা বাঁচিয়ে রাখতে এবং জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সে সময়ে কুইক রেন্টালের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী যেখানে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বেশি, সেখানে কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো টিকিয়ে রাখার কোনো যুক্তি নেই। 

অন্যদিকে সরকার বিদ্যুৎ খাতে ৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির যে হিসাব দিয়েছে, তার মধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হয় দরিদ্রদের মধ্যে স্বল্প দামে বিদ্যুৎ দিতে। এটি সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অংশ। এই ভর্তুকিকে পিডিবির লোকসানের খাতায় দেখানোটা জনগণের চোখে ধুলা দেওয়া ছাড়া কিছু নয়। অতএব, বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে এই খাতে অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধ করুন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ফিরিয়ে আনুন।