আইসিজেতে মিয়ানমারই আসামি: মাইকেল বেকার

>

মাইকেল বেকার
মাইকেল বেকার

মাইকেল বেকার আইনজীবী; যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এখন আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন ট্রিনিটি কলেজে অ্যাডজাঙ্কড লেকচারার হিসেবে পাবলিক ইন্টারন্যাশনাল ল পড়ান এবং যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ডক্টরাল গবেষণার শেষ পর্যায়ে আছেন। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে একজন অ্যাসোসিয়েট লিগ্যাল অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন এবং সেই সুবাদে আইসিজের বিচারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ পান। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ১০ ডিসেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে শুনানি শুরু হতে যাচ্ছে, তাকে সামনে রেখে তিনি এই মামলার বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি টেলিফোনে নেওয়া এবং ইংরেজি থেকে অনূদিত। এর প্রথম পর্ব ছাপা হচ্ছে আজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।

প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে মামলার শুনানি শুরু হতে যাচ্ছে, তার প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটু বিশদভাবে বলবেন?

মাইকেল বেকার: গত নভেম্বরে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে। মামলাটি দীর্ঘ ও জটিল হবে, তবে আপাতত, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, গাম্বিয়া অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের জন্য আবেদন করেছে। সেই পদক্ষেপগুলো জরুরি প্রকৃতির; মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান অবস্থা বজায় রাখার জন্য কোনো রাষ্ট্র অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের আদেশ চাইতে পারে। ডিসেম্বরের ১০–১২ তারিখে হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে যে শুনানি হবে, তার বিষয় হলো, গাম্বিয়া যেসব অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের আবেদন করেছে, আদালত তার আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন কি না। যেমন, গাম্বিয়া এ রকম একটা আবেদন জানিয়েছে যে আদালত যেন মিয়ানমারকে আদেশ দেন যে এই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমার গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ হয় এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকবে, বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এই মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত সাক্ষ্যপ্রমাণ-আলামত ইত্যাদি ধ্বংস করবে না; রোহিঙ্গাদের পরিত্যক্ত গ্রামগুলো বুলডোজার দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার মতো আলামত ধ্বংসকারী কাজগুলো থেকে বিরত থাকবে। প্রাথমিক শুনানির পর, সম্ভবত ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে আদালত একটি আদেশ দেবেন। মিয়ানমারকে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নিতে বলা হবে কি না তা সেই আদেশে থাকবে। কিন্তু এটা এই মামলার একেবারেই প্রথম ধাপ; এই ধাপে সাক্ষ্যপ্রমাণ কিংবা আইনি যুক্তিতর্কের পুরো বিষয়টা আসবে না। এই ধাপে দেখা হবে গাম্বিয়া এখন এই অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের আবেদন জানানোর এখতিয়ার রাখে কি না, সেটা জরুরি প্রয়োজনীয় কি না এবং যথাযথ কি না। পুরো মামলাটির নিষ্পত্তি হতে এবং চূড়ান্ত রায় পেতে কয়েক বছর লেগে যাবে।

প্রথম আলো: কয়েক বছর বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন? মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমার বিষয়ে আইনে কী বলা হয়েছে?

মাইকেল বেকার: কত তাড়াতাড়ি মামলার নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন, এ বিষয়ে আইনে কিছু বলা হয়নি। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মামলার যৌক্তিকতা সাপেক্ষে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রায় পেতে পেতে চার বছর লেগে যায়; তার আগে সাধারণত হয় না। এই মামলার রায় চার বছরের মধ্যে পাওয়া গেলে আমি সেটাকেই যথেষ্ট মনে করব। সেটা নির্ভর করবে মিয়ানমার কী ধরনের আপত্তি তুলতে পারে, নানা ধাপের প্রক্রিয়াগুলো কীভাবে সম্পন্ন হতে পারে সেসবের ওপর। এই সবকিছুই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অতীতে গণহত্যা কনভেনশন–সম্পর্কিত মামলাসহ অন্যান্য মামলায় আরও অনেক বেশি সময় লেগেছে; কিন্তু সে জন্য আমি বলব না যে এই মামলা নিষ্পন্ন হতেও ১০ বছর বা ওই রকম সময় লেগে যাবে। আমার মনে হয়, এই মামলার ক্ষেত্রে চার থেকে ছয় বছর সময় লাগা বাস্তবসম্মত।

প্রথম আলো: আইসিজেতে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন অং সান সু চি। কিন্তু তিনি একজন অভিযুক্ত। অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থন করার এখতিয়ার সম্পর্কে কি কোনো বিধান আছে?

মাইকেল বেকার: এ বিষয়ে কয়েকটা পয়েন্ট উল্লেখ করতে হবে। প্রথমত, এই মামলায় মিয়ানমার যে হাজিরা দিতে যাচ্ছে এটা ইতিবাচক। কারণ, আমার মনে হয়, অনেকেই এই আশঙ্কায় আছেন যে মিয়ানমার শুনানিতে অংশ নেবে না। সেটা হলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক। রাষ্ট্রগুলো যেহেতু এই ঐকমত্যে পৌঁছেছে যে তাদের মধ্যকার পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তি করার এখতিয়ার আইসিজেকে দেওয়া হয়েছে, সেহেতু সে রকম কোনো মামলার শুনানিতে কোনো সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের হাজির হতে অস্বীকৃতি জানানো উচিত নয়। অং সান সু চি যে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের অংশ হতে যাচ্ছেন, এটা উল্লেখযোগ্য এবং আগ্রহব্যঞ্জক খবর। যদিও আইসিজেতে কোনো দেশের প্রতিনিধিদলে রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্রীয় কোনো নেতার অংশগ্রহণের ঘটনা অভূতপূর্ব কিছু নয়, তবু এই ক্ষেত্রে এটা অসাধারণ ঘটনা। কারণ, অং সান সু চি রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত; সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের একটি ফোরামে হাজির হয়ে তাঁর মনে হতে পারে যে তাঁর অবস্থা একজন ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আসামির মতো। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস—আইসিজে) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট—আইসিসি) থেকে ভিন্ন রকমের একটি ফোরাম। আইসিজেতে কোনো ব্যক্তিকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় না, সেখানে কোনো ব্যক্তিগত আসামি থাকে না। সেখানে যে মামলাটির কথা বলা হচ্ছে সেটার বিষয় হলো, মিয়ানমার নামের রাষ্ট্রটি স্বয়ং গণহত্যা কনভেনশনের বাধ্যবাধকতাগুলো ভঙ্গ করেছে, কোনো ব্যক্তি করেনি। অবশ্য মানুষ নিয়েই রাষ্ট্র; এবং কোনো রাষ্ট্র কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করেছে কি না এই প্রশ্নের সঙ্গে ওই রাষ্ট্রের নেতৃত্বের পদগুলোতে আসীন ব্যক্তিদের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের সম্পর্ক থাকে। এই মামলার ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিরা হলেন অং সান সু চি এবং সেনাবাহিনীর জেনারেলরা। সুতরাং তাঁরা এক অর্থে অভিযুক্ত, কিন্তু সেটা পরোক্ষ অর্থে। এই মামলায় তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে আসামি নন। তবে এই পরিস্থিতিটা একটু অস্বাভাবিক, কারণ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যা হয়েছে, গাম্বিয়াসহ আরও অনেক রাষ্ট্র যেটাকে গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা করছে, সেই অবস্থার জন্য অং সান সু চিকে অভিযুক্ত করা হবে কারণ তাঁর গৃহীত সিদ্ধান্তের ফলে সেই অবস্থা হয়েছে, অথবা তিনি সেই অবস্থা ঠেকাতে হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে সেটা ঘটেছে। কিন্তু সে জন্য হেগের আদালতে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে না। তিনি সেখানে যাবেন মিয়ানমারের সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধিদলের অংশ হিসেবে; সেই প্রতিনিধিদলে মিয়ানমারের পক্ষে মামলা লড়ার জন্য বিদেশ থেকে আনা কয়েকজন আন্তর্জাতিক আইনজীবীও থাকবেন। কিন্তু মামলাটা আইসিসিতে করা হলে সেখানে অং সান সু চিকে ব্যক্তিগতভাবে আসামি করার আশঙ্কা ছিল।

প্রথম আলো: আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এই মামলা বা অং সান সু চির হেগে যাওয়ার বিষয়টি কি আইসিসির তদন্তের জন্য কোনোভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে?

মাইকেল বেকার: আমি আইসিসির কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না; তবে বলতে পারি যে সেখানকার কার্যপ্রণালি আলাদা। কারণ, প্রথমত মিয়ানমার রোম স্ট্যাটিউটে স্বাক্ষর করেনি। আইসিসির প্রসিকিউটর বেশ সৃজনশীলতার সঙ্গে যে পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে আছেন, তার উদ্ভব ঘটেছে এই বাস্তবতা থেকে যে বাংলাদেশ রোম স্ট্যাটিউটে স্বাক্ষরকারী দেশ। রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে বাধ্য হয়েছে, এই সত্যের ভিত্তিতে আইসিসি বলতে পারে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু মিয়ানমারে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর সমস্তটার কত দূর পর্যন্ত আইসিসির তদন্ত যেতে পারবে তা এখনো পরিষ্কার নয়, কারণ তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। প্রসিকিউটর তাঁর তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে সম্প্রতি পরবর্তী অনুমোদন পেয়েছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়নি এবং এই মুহূর্তে আইসিসিতে ব্যক্তিগতভাবে অভিযুক্ত কোনো আসামি নেই। কী ঘটতে যাচ্ছে তা আমরা আগে থেকে বলতে পারি না; এবং আমার মনে হয় আইসিসিতে শিগগিরই আর কিছু ঘটবে না।

প্রথম আলো: গাম্বিয়া আইসিজেতে মামলা দায়ের করেছে ওআইসির পক্ষ থেকে। মিয়ানমারের পক্ষে আসিয়ান বা তার মিত্রদের কেউ তৎপর হতে পারে কি না?

মাইকেল বেকার: এই প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলতে হলে দেখতে হবে এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের পক্ষে তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার এখতিয়ার আছে কি না। এক অর্থে তৃতীয় কোনো পক্ষের এতে ঢোকার প্রয়োজন নেই। আইসিজেতে গাম্বিয়া হলো আরজি পেশকারী আর মিয়ানমারের ভূমিকা জবাবদাতার। তবে বিষয়টিতে অন্যান্য রাষ্ট্রের অংশগ্রহণের পথ আছে। আইসিজের কার্যপ্রণালি পরিচালিত হয় তার স্ট্যাটিউটের ভিত্তিতে; সেই স্ট্যাটিউট জাতিসংঘ সনদের সঙ্গে সংযুক্ত। সেটাতে বিধান আছে, কোনো আন্তর্জাতিক বিরোধ নিয়ে মামলা হলে সেই মামলার দুই পক্ষ ছাড়াও তৃতীয় কোনো রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারবে। হস্তক্ষেপ করার বা সংশ্লিষ্ট হওয়ার বিভিন্ন ধরন আছে। যেমন, গণহত্যা কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে এমন যেকোনো রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারে; তবে সেই হস্তক্ষেপ সীমাবদ্ধ থাকবে গণহত্যা কনভেনশন কীভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত সে বিষয়ে সেই রাষ্ট্রের বক্তব্যের মধ্যে। নীতিগতভাবে, সেই রাষ্ট্র মামলাটির ঘটনা বা বিষয় নিয়ে বিতর্ক করবে না, তার হস্তক্ষেপ হবে এটুকুই যে গণহত্যা কনভেনশনের কোনো নির্দিষ্ট বিধানের ব্যাখ্যা কীভাবে করা উচিত সে বিষয়ে সে তার অবস্থান তুলে ধরবে। গণহত্যা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী প্রতিটি রাষ্ট্রেরই এভাবে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আছে।

হস্তক্ষেপের আরও একটা ধরন আছে, সেটা একটা বিশেষ অধিকারমূলক পন্থা এবং অপেক্ষাকৃত জটিল। এই ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে ইচ্ছুক রাষ্ট্রটির এমন কিছু আইনি স্বার্থ থাকতে হবে, যা সংশ্লিষ্ট মামলার রায়ের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। আইসিজে তৃতীয় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিষয়ে বেশ উন্নত একটা মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কতগুলো রাষ্ট্র বিধানটি কাজে লাগিয়ে হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম হবে তা আমার কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার নয়।

সেই ধরনের বিশেষ অধিকারমূলক হস্তক্ষেপের জন্য সর্বোত্তম প্রার্থী হতে পারে বাংলাদেশ, কারণ মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত বিপুলসংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এখন এই দুই ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারে যেকোনো রাষ্ট্রই, তা সে রাষ্ট্র গাম্বিয়ার অবস্থানকে সমর্থন করুক কিংবা মিয়ানমারের অবস্থানকে। কিংবা হস্তক্ষেপকারী রাষ্ট্রটির অবস্থান একেবারেই ভিন্ন হতে পারে; দুই পক্ষের কোনো একটার অবস্থানের সমর্থক তাকে হতেই হবে এমন নয়।

প্রথম আলো: মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার মতো একই ধরনের মামলা কি অতীতেও হয়েছে? নাকি এ ধরনের মামলা এটাই প্রথম?

মাইকেল বেকার: অতীতে এমন একাধিক রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, যারা নিজেরা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য বাধ্যতামূলকভাবে পালনীয় বিধান প্রয়োগের চেষ্টা করেছে। অতীতে গণহত্যা কনভেনশনের সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি মামলা আইসিজেতে হয়েছে: একটা বসনিয়া বনাম সার্বিয়া, আরেকটা ক্রোয়েশিয়া বনাম সার্বিয়া। উভয় মামলাই ১৯৯০–এর দশকের শুরুর দিকে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পর বলকান অঞ্চলে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি যখন আইসিজেতে কর্মরত ছিলাম, সেই সময়ে ক্রোয়েশিয়া বনাম সার্বিয়া মামলার অনেকটা কাজ সম্পন্ন হয়েছিল; আমি সেখানে থাকতেই চূড়ান্ত শুনানি হয়ে গিয়েছিল এবং রায়ের ওপরে কাজ শুরু হয়েছিল। অবশ্য রায়ের খসড়া তৈরি ও চূড়ান্ত করার সময় আমি সেখানে ছিলাম না, আমি চলে আসার পর সেটা ঘটেছিল। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার এই মামলায় কী ঘটতে পারে তা সম্পর্কে কিছু দিকনির্দেশনা ওই দুটি মামলা থেকে পাওয়া যাবে; এবং গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের আইনজীবীরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন, ওই দুই মামলায় গণহত্যা কনভেনশনের ব্যাখ্যা সম্পর্কে আইসিজে কী বলেছে, কী কী সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখাতে হবে এবং প্রমাণের কী মানদণ্ড পূরণ করতে হবে। আইসিজে কিছু দিক থেকে গণহত্যা কনভেনশনের বেশ কঠোর ব্যাখ্যা দিয়েছে। সে কারণেই আমি এই মামলা লড়ার সময় সতর্ক থাকতে বলব, এমনকি যে ক্ষেত্রে ভয়ংকর নৃশংসতা ও বৈষম্যের ব্যাপক সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, সেখানেও সতর্কতার সঙ্গে মামলা লড়তে হবে। গণহত্যা কনভেনশনের সঙ্গে সম্পর্কিত আইনটি জটিল, ফলে মিয়ানমারের মতো রাষ্ট্রগুলোর এমন যুক্তি হাজির করার সুযোগ আছে যে উল্লিখিত নৃশংসতার ঘটনাগুলো যদি ঘটেও থাকে, তবু তাদের গণহত্যা ঘটানোর লক্ষ্য ছিল না, বরং তারা বলতে পারে, নৃশংসতার ঘটনাগুলো ছিল সন্ত্রাসবাদী হুমকির জবাবের ফল। এ রকম ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়ায় গণহত্যার অভিপ্রায় প্রমাণ করা; এটা প্রমাণ করা যে নৃশংসতা যারা ঘটিয়েছে তাদের চেষ্টা ছিল একটা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার।

প্রথম আলো: কী রকমের কার্যধারায় আইসিজেতে এই মামলা এগোবে?

মাইকেল বেকার: এর কার্যধারা হবে কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ফৌজদারি অপরাধের বিচারের কার্যধারা থেকে বেশ ভিন্ন রকমের। এটা অনেকটা হবে বিবদমান দুটি ব্যক্তিগত পক্ষের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দেওয়ানি পদক্ষেপের মতো; শুধু পার্থক্যটা এই যে এ ক্ষেত্রে পক্ষ দুটি ব্যক্তি নয়, বরং দুটি রাষ্ট্র। আইসিজের মামলায় কোনো প্রসিকিউটরের সংশ্লিষ্টতা নেই। মামলার কার্যধারা সম্পর্কে বলতে গেলে, প্রথম শুনানি হবে এ মাসেই; শুনানি হবে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নিয়ে। আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন, সেই সব পদক্ষেপ গ্রহণের আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার তাঁর আছে কি না। তারপর আদালত কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আদেশ দিতে পারেন। এরপর আদালত একটা ব্রিফিং শিডিউল নির্ধারণ করবেন। এটা থেকেই বুঝতে সুবিধা হবে আইসিজের মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হতে কেন এত দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। মামলার উভয় পক্ষকে নিজ নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য প্রচুর সময় দেওয়া হয়।

গাম্বিয়া তার সব যুক্তি ও সাক্ষ্যপ্রমাণসহ একটা বিশদ আইনি ডকুমেন্ট তৈরি ও পেশ করার জন্য বেশ কয়েক মাস সময় পাবে। এটা করার জন্য তাদের খুব সম্ভব এক বছর সময় দেওয়া হবে। এটা বেশ লম্বা সময় বলে মনে হবে, কিন্তু কোনো মামলা যখন খুব জটিল প্রকৃতির হয়, তখন সময় খুব দ্রুত চলে যায়। তারপর মিয়ানমারকে জবাব দেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হবে, সেখানে তাদের সমস্ত আইনি যুক্তি ও সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকবে, যার জোরে তারা গাম্বিয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করবে। এভাবে সম্ভবত আরও এক বছর চলে যাবে। সেই পর্যায়ে আদালত দ্বিতীয়বারের মতো ব্রিফিং শিডিউলের সিদ্ধান্ত দিতে পারেন, যাতে মামলার উভয় পক্ষ পরস্পরের উত্থাপিত যুক্তিতর্ক খণ্ডন করার জন্য আরেকবার সুযোগ পায়। এটার পেছনে আরও সময় যাবে। যখন উভয় পক্ষের উত্থাপিত সব যুক্তিতর্ক শেষ হবে এবং সেগুলো কাগজে নথিবদ্ধ হবে, তখনই আদালত কার্যত একটা শুনানি অনুষ্ঠান করবেন। মামলার উভয় পক্ষ হেগের পিস প্যালেসে আইসিজের এজলাসে উপস্থিত হবে এবং প্রত্যেক পক্ষকে তাদের যুক্তি মৌখিকভাবে উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া হবে এবং সেখানে সাক্ষীদের জবানবন্দি দেওয়ারও ব্যবস্থা থাকবে। সাক্ষীদের মধ্যে থাকতে পারে ঘটনার তথ্যাবলির সাক্ষী কিংবা বিশেষজ্ঞ সাক্ষী, যাদের সঙ্গে এই মামলার বিভিন্ন দিকের সম্পর্ক থাকবে। আইসিজের সব মামলায় সাক্ষী থাকে না; এই দিক থেকে আইসিজে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ আদালত কক্ষের থেকে খুবই আলাদা। সাক্ষীর সংখ্যা প্রচুর হতে হবে এমন নয়, তবে অতীতে গণহত্যা কনভেনশন–সম্পর্কিত অনেক মামলায় সাক্ষীদের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয়, গাম্বিয়ার এই মামলায়ও সাক্ষী থাকবে। বিচারকদের মামলার উভয় পক্ষকে সরাসরি প্রশ্ন করারও সুযোগ থাকবে। তারপর আদালত বিদায় নেবেন এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা-পরামর্শ করবেন। কীভাবে রায় তৈরি করা হবে সে বিষয়ে আইসিজের বেশ সুসংহত অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া আছে। এতে সাধারণত ৯ মাসের মতো লাগে; অবশ্য মামলা খুব জটিল হলে আরও বেশি সময় লেগে যেতে পারে। বিচারকদের মধ্যে ভোটাভুটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে চূড়ান্ত রায় গৃহীত হওয়ার পর একটি গণশুনানিতে তা পড়ে শোনানো হয়।

আইসিজেতে বিচারপ্রক্রিয়া সাধারণত এভাবেই চলে, তবে একটু ভিন্ন রকমের কিছুও ঘটতে পারে। যেমন ধরা যাক, গাম্বিয়া তার সব যুক্তিসহ আইসিজের কাছে প্রথমে লিখিতভাবে আরজি পেশ করার পর মিয়ানমার আইসিজের এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাহলে সম্পূর্ণ একটা আলাদা কার্যধারা বা প্রসিডিংয়ের প্রয়োজন হবে, যেখানে প্রত্যেক পক্ষ আদালতের এখতিয়ার নিয়ে নিজ নিজ যুক্তি তুলে ধরবে; তারপর আদালত একটা রায় দেবেন, যা শুধু তাঁর এখতিয়ারের প্রসঙ্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আদালত যদি সিদ্ধান্ত দেন যে তাঁর এই মামলার বিচার করার এখতিয়ার আছে এবং গাম্বিয়া যেসব অভিযোগ বা দাবি জানিয়েছে সেগুলো আমলে নেওয়ার যোগ্য, তাহলেই শুধু মামলাটা সামনে এগোতে পারবে। কিন্তু এ রকম ঘটলে আরও এক বছরের বেশি সময় লেগে যেতে পারে। এ ছাড়া আরও কয়েক ধরনের কার্যধারাগত ইস্যু আছে, সেগুলোও সামনে চলে আসতে পারে; এবং এলে মামলাটির নিষ্পত্তি হতে আরও বেশি সময় লাগবে। 


(আগামীকাল দ্বিতীয় পর্ব)