আমি হুহু করে কেঁদে উঠলাম

>১৯৭১ সালে আমাদের বিজয়ের মুহূর্তের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখা সংকলিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে, ভোরের কাগজ পত্রিকার বিজয় দিবসের ক্রোড়পত্রে। সেই লেখাগুলো নিয়ে প্রথমা প্রকাশন প্রকাশ করেছে বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১ শিরোনামের একটি বই। এবার বিজয়ের মাসে আমরা বইটি থেকে কিছু নির্বাচিত লেখা প্রকাশ করছি প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য। আজ ছাপা হলো সন্‌জীদা খাতুন-এর লেখাটি।

শরণার্থী দশা তখন আমার। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে আছি শান্তিনিকেতনে। স্থান-নাম শুনে মনে হওয়া স্বাভাবিক—আহা কী সুখের জায়গায় বাস গো! কিন্তু আমার তখনকার পরিস্থিতিটা ছিল কী রকম? রিসার্চ ফেলোশিপের মাসিক পাঁচ শ টাকা দিয়ে চালাচ্ছি সংসার। তবু অন্য অনেকের চেয়ে ভালো দশা বলতেই হবে, কারণ মাসে পাঁচ শ টাকা আয় তখন কজন শরণার্থীর কপালেইবা জুটেছিল! 

পাঠভবনের ছাত্রদের কিচেন থেকে দুটি meal এনে ভাগ করে খেতে হতো। বাড়ির উত্তর-পুব কোণে সীমানা ঘেঁষে ময়লা ফেলার এক গর্ত ছিল। কিচেন থেকে বলেকয়ে কিছু বেশি করে আনা ভাতের বেশ খানিকটা ওই গর্তে ফেলে দিতে হতো—মেখে খাবার তরকারির অভাবে। একদিন বাড়িওয়ালা কাকাবাবুদের ঘরে কী একটা শাকভাজি হয়েছিল। পরিমাণে বেশি হওয়াতে বাটিতে করে কিছুটা আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন তাঁরা। সেদিন আমাদের ভাতই কম পড়ে গেল! পরে ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে কথায় কথায় বৃত্তান্ত শুনে কাকাবাবু এসে আমাকে বলেছিলেন, ‘তাই তো! তরকারি থাকে না বলেই বুঝি তোমরা অতগুলো ভাত ফেলে দাও। তারপর থেকে কাকাবাবু বাড়ির সবজিখেতে ফলানো একটি-দুটি করলা কাপড়ের আড়ালে করে এনে ফেলে দিয়ে যেতেন রান্নাঘরের জানালা গলিয়ে। কাকিমাকে লুকিয়ে দিতে হতো বোধ করি। বাজার থেকে আনা ছোট একটা ফুলকপি বা দুটি শিম চাদরের আড়াল থেকে চট করে বের করে দিয়ে যেতেন কাকাবাবু। তাতে অবশ্য আমার কাজ বাড়ত। আগেকার জীবনে কাজের লোকের ওপরে পুরো নির্ভরশীলতার দরুন, এই জীবনে সকালের হাতরুটি তৈরি, কাপড় কাচাকাচি ইত্যাদির পরে গবেষণার জন্য পড়াশোনা, সপ্তাহে এক দিন তত্ত্বাবধায়কের কাছে গিয়ে কাজের অগ্রগতির রিপোর্ট দেওয়া কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। পূজার ছুটিতে কিচেন একদম বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অক্টোবর থেকে পুরোদস্তুর রান্না শুরু করে দিতে হলো ঘরে। ঘরের রান্না খেয়ে ছেলেমেয়েদের পরিতৃপ্তি দেখে কিচেনের খাবারের ব্যবস্থায় ফিরে যাইনি আর। 

নভেম্বর পড়লে শীতের কাপড়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে ফতুর হলাম। চেয়েচিন্তে লেপ-কম্বল জোগাড় হলো। শান্তিনিকেতনের এক সম্মানিত ব্যক্তি বলেছিলেন, শীতবস্ত্রের ভাবনা নেই, সব তিনি পাইয়ে দেবেন সংশ্লিষ্ট কোনো এক ‘সহায়ক সমিতি’ থেকে। কিন্তু কী কারণে যে তাঁর গোস্‌সা হলো আমার ওপরে, তখন জানতে পারিনি। একদিন তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিতে গেলে তিনি সাফ জবাব দিলেন, ‘কই, তুমি তো এসে সময়মতো আমাকে বলোনি! আমি এখন কোত্থেকে দেব।’ পরে শুনেছি, কার কাছে কানকথা শুনেছিলেন, আমি নাকি তাঁর নামে কী বলেছি! সে খবর শুনেছি আবার তাঁরই কাছ থেকে, স্বাধীনতা পেয়ে যাওয়ার অনেক পরে, তত দিনে তিনি বুঝেছেন, তাঁর প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধাতে আমার কোনো খাদ থাকতেই পারে না! হায় রে সেদিন! সন্ধ্যার অন্ধকারে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরেছিলাম দুশ্চিন্তার বোঝা মাথায় বয়ে। তারপর ডিসেম্বর এল শান্তিনিকেতনের লালকাঁকুরে মাটির কড়া শীত নিয়ে। 

যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গেছে তখন। আকাশে-বাতাসে খবর-স্বাধীনতা এল বলে! তারই মধ্যে ও দেশের মানুষের নানান আলোচনা শুনে যাচ্ছি। ওদের প্রশ্ন এই যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিলিয়ান্ট যোদ্ধারা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে এমন প্রাণ দিচ্ছে—এর প্রতিদানে কী পাব আমরা! আমাদের ওপারে ফেলে আসা জমিজমা, ধনসম্পত্তি ফিরিয়ে দেবে ওরা! সংশয়-সন্দেহ নিয়েই এসব প্রশ্ন। আমার রিসার্চ ফেলোশিপ নিয়েও আন্দোলন হয়ে দরখাস্ত পড়ে গেছে শুনলাম। আমার ব্যাপারে প্রশ্ন ছিল, ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা দিয়েছেন যে বুদ্ধিজীবীরা এপারে চলে এলে তাঁদের তিনি চাকরি দেবেন, সেসব চাকরি নতুন তৈরি করবেন তো তিনি? আমাদের জন্য বরাদ্দ করা চাকরি ওদের দিয়ে দেবেন, সে আমরা সইব কেন? হক কথা! বিশ্বভারতীর উপাচার্য প্রতুল গুপ্ত আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘ও নিয়ে ভাববেন না, যে পদ নিয়ে আপত্তি হয়েছিল, আমি সে পদ থেকে সরিয়ে আপনার জন্য অন্য ব্যবস্থা করেছি।’ তাঁর প্রশান্ত হাসি আর সহৃদয় ব্যবহার আমার দুঃখ লাঘব করেছে সেদিন। 

শীতকালীন অবকাশে বেড়াতে যাওয়ার আগে দরদি প্রতিবেশী পাকুন্তলা মাসিমা তাঁর ট্রানজিস্টারখানি দিয়ে গেলেন আমাকে, খবর শোনার জন্য। কলকাতা রেডিও, ঢাকা রেডিও, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনছি। আর পাকিস্তানিদের শেষ কামড়ের ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি। ঠিকই খবর হলো, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বুদ্ধিজীবী হত্যা ঘটে গেছে। মরিয়া অবস্থা তখন পাকবাহিনীর আর তাদের এদেশি দোসর রাজাকার–আলবদরদের। এরই মধ্যে এক প্রতিবেশী কন্যা আবদার জানাল, ‘স্বাধীনতা আসছে! মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু!’ পাংশু হয়ে গেল মুখ হাতের রেস্তর অবস্থা ভেবে। আর আমার মুখ দেখে সে বেচারির উচ্ছ্বাস স্তব্ধ হলো মুহূর্তে। কী যে সে বুঝেছিল সেদিন, সে-ই জানে। ডিসেম্বরের ১৪ গেল, ১৫ গেল। প্রতীক্ষায় অধীর হয়ে আছি। বাইরে কাজে গেলে তড়িঘড়ি ফিরে আসি খবর শুনব বলে। তারপরে এল ১৬। দুপুরের রান্না করছি তখন। হঠাৎ রেডিওর খবর শুনে ঘরে কে চিৎকার করে উঠল, ‘বিজয় হয়ে গেছে! নিয়াজি সারেন্ডার করবে!’ আমি ঘুরে তাকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলাম। 

কেন? পরে ভেবে দেখেছি, প্রত্যাশিত মুহূর্ত উপস্থিত হতেই শরণার্থী জীবনের যত দুঃখ–অপমান, মা-বাবা, ভাইবোন সব ছেড়ে দূর অজ্ঞাতবাস পরিস্থিতির অনিশ্চয়তার দরুন সার্বক্ষণিক অসহায়তাবোধ—সবকিছু জট পাকিয়ে গিয়ে ওই দুর্বার কান্না ফেটে পড়েছিল। দুঃখমুক্তির আনন্দমুহূর্তে দুঃখবোধটাই হয়ে উঠেছিল সরব। মানুষজনকে সত্যি সত্যি মিষ্টি খাইয়েছিলাম। গোবিন্দভোগ আতপ চাল আধভাঙা করে তাই দিয়ে খুব ঝরঝরে করে ভাত রেঁধে জর্দার রং দিয়ে জ্বাল দেওয়া চিনির রসে ফেলে শুকিয়ে নিয়ে জর্দাই তৈরি করেছিলাম একরকম। তবে পরিমাণে কম বলে মোটামুটি ছোট আকারেরই গুলি পাকিয়ে রাখলাম। থালায় সাজানো সেই মিষ্টি দুটির বেশি তো কেউ তুলে নেবে না—এই ছিল ভরসা। অভিনন্দন জানাতে যাঁরাই এলেন, ওই তথাকথিত ‘মিষ্টি’ দিয়ে আপ্যায়ন করলাম তাঁদের।

বিজয়ের মুহূর্তে দুঃখ আর দুঃখ অবসানের আনন্দ একই সঙ্গে বিমূঢ় করে দিয়েছিল আমাকে। যে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার কথা লিখলাম, তা আমাকেও ভয়ানক বিস্মিত করেছিল। 

(ঈষৎ সংক্ষেপিত)

সন্‌জীদা খাতুন সংগীতশিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক