জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: ভিসি নয়, দুর্নীতি খেদাও আন্দোলন

‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’ আন্দোলন করে দুর্নীতি নামক অসুখকে তাড়াতে।
‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’ আন্দোলন করে দুর্নীতি নামক অসুখকে তাড়াতে।

১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালে ৫০ বছর পূর্ণ করবে। সম্প্রতি অনেকের প্রশ্ন, কেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এত আন্দোলন? কেন এখানে ভিসি খেদাও আন্দোলন? জাহাঙ্গীরনগরের কিসের অসুখ?

আবরার হত্যাকাণ্ডের পরে ৬০ দিন বন্ধ ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। আবরার হত্যার বিষয়টি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন করে নাড়া দেয়। কারণ, অনেক ছাত্রছাত্রীর জীবনে র‌্যাগিং এখানকার নিত্যদিনের সঙ্গী। ১৯৯১ সাল থেকেই আমরা জেনে আসছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে র‌্যাগিং হচ্ছে। এমন অভিযোগে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলছে। মানুষের সহ্যক্ষমতারও সীমা আছে। সেটি অতিক্রম করে গেলে মানুষ প্রতিবাদ করে। তারা তখন আন্দোলনে নামে, বিচার চায়। এত দাবির পরেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য র‌্যাগিং বন্ধে সফলতার পরিচয় দেননি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শীতের পাখির এক অভয়ারণ্য। এটি গৌরব করার মতো বিষয়। প্রকৃতিপ্রেমী নগরবাসী জাহাঙ্গীরনগরে আসেন পাখির মেলা, প্রজাপতির মেলা দেখতে, সেহেতু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের প্রত্যাশ এখানে জীববৈচিত্র্যবান্ধব পরিবেশ রক্ষা করে টেকসই উন্নয়ন হবে। বর্তমান উপাচার্য উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা করেছেন ওই জীববৈচিত্র্যকে কণামাত্র মূল্য না দিয়ে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দেন। তিনি জাতীয় বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা দিয়ে তহবিল তৈরি করেছেন। তিনি সে জন্য জাতিসংঘ থেকে সম্মানসূচক সনদ ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ উপাধি পেয়েছেন। সেই টেকসই উন্নয়নের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় হলো অংশীজনের সবাইকে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। বর্তমান উপাচার্য সেখানে বিষয়টি দাপট দেখিয়ে উপেক্ষা করেছেন।

এরপর এসেছে মহাপরিকল্পনা অনুসারে টেন্ডার প্রক্রিয়া। সেখানে তিনি সুশাসনের অন্যতম দিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। দরপত্র ছিনতাইয়ের ঘটনা এবং ই-টেন্ডার দেওয়ার নীতিমালাকে উপেক্ষা করা তার প্রমাণ। এসব তিনি করছেন যাতে নির্ধারিত মেয়াদে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা খরচ করে হল ও ভবন নির্মাণ করতে পারেন এবং সেগুলোয় নিয়োগ দিয়ে যেতে পারেন। এই তাড়াহুড়ো সবার মনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।

আরও মজার বিষয় হলো, দরপত্র মূল্যায়নের জন্য বিধিবহির্ভূতভাবে একজন বিতর্কিত কর্মকর্তাকে মনোনীত করা হয়েছে। ওই ব্যক্তি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন কোটার সুযোগে। ১৯৯৮ সালে পাস করার পর ২০০৯ সালে কোনো লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষা না দিয়ে অ্যাডহক ভিত্তিতে বর্তমান উপাচার্যের একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এরপর বর্তমান উপাচার্যের আনুকূল্যে তিনি ২০১৫ সালে নিজের স্ত্রীসহ আরও চারজনকে অ্যাডহকভিত্তিক অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় সমর্থ হন। শুধু তা–ই নয়, মাত্র ১০ বছরে তিনি ডেপুটি রেজিস্ট্রারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন।

একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল একমাত্র সেশনজটমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। সেই গৌরব ফিরে পেতে জাহাঙ্গীরনগর এখন অদম্য চেষ্টা করছে।

বিশ্ববিদ্যালয় যেমন সর্বোচ্চ মানের জ্ঞানচর্চার জায়গা, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ নৈতিকতা শিক্ষা ও চর্চারও স্থান। দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম নীতি। এখানকার সবাইকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হয়। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে মর্যাদা দিতে আচার্য করা হয় প্রধানমন্ত্রী কিংবা মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের সাংসদদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন দ্বিতীয়বারের জন্য। সেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বয়ং উপাচার্য প্যানেল ছাড়া মনোনীত তথা অনির্বাচিত।

যদি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কারও সঠিক ধারণা থাকে, তবে সেখানে ‘কেন এত ভিসি খেদাও আন্দোলন?’ প্রশ্ন অসার। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন এমন ব্যক্তি, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অভিভাবকই নন, তিনি জাতির অভিভাবক, বরেণ্য ব্যক্তি। তাঁকে অবশ্যই সর্বোচ্চ নৈতিকতা দেখাতে হবে কাজে ও আচরণে। কিন্তু আমরা দেখেছি বিজ্ঞাপন ও সাক্ষাৎকার ছাড়া এক দিনে পাঁচজনকে অ্যাডহকে নিয়োগ দিতে।

কোনো উপাচার্য যদি ৮ তারিখ বলেন ছাত্রলীগের জাতীয় পর্যায়ের নেতা ও ডাকসুর ভিপি-জিএসএর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, আর ৯ তারিখ বলেন হলের নির্মাণের টাকার থেকে কমিশন ভাগের আলোচনা হয়েছে এবং সেটার পরিমাণ ৬ শতাংশ হতে হবে, তাহলে আর কি কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকল ওই মহান পদে থাকার? তিনি ছাত্রের কাছে এভাবেই কথা বলেছেন।

শিক্ষকের আদর্শ মূর্তি সমাজে আছে। অথচ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ৩টি গাড়ি, ১৩টি এসি, ১২ জন কাজের লোক খাটান, যার সব খরচ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে বহন করতে হয়।

আপনারা আপনাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য যাঁদের হাতে সঁপে দেন, তাঁদের নেতা উপাচার্য যদি অসৎ হন, তাহলে আপনি বা জাতি সেখান থেকে কী আশা করতে পারেন? মানবসন্তান কেবল একটি কম্পিউটার বা রোবট নয় যে তাকে কিছু সফওয়ারে সমৃদ্ধ করলেই হলো—রবীন্দ্রনাথের ভাষায় পাখিকে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে খাওয়ানোর মতো। শিক্ষা শব্দটার মানে আমরা বুঝি, কিন্তু ভুলে যাই। আমিও হয়তো ভুলে যাই। আমার ছাত্ররা সেটা স্মরণ করিয়ে দেয়। আর এরই নাম বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে আমরা পরস্পরের গুরু-শিষ্য।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ বিশ্বমানের হতে পারেনি ওই উপাচার্যদের জন্য। তাঁরা শিক্ষক নিয়োগ দেন সবচেয়ে মেধাবীকে বাদ দিয়ে সবচেয়ে কম মেধাবীকে।

দেশের উন্নয়ন খায় ঘুণপোকায়, আর বিশ্ববিদ্যালয় খায় দুর্নীতিবাজ উপাচার্যরা। তাদের এই কর্মকাণ্ড দেখে জাতি লজ্জা পায়! তাদের ক্ষমতার এত লোভ যে আদালতকে রায় দিয়ে অবৈধ নিয়োগ ঠেকাতে হয়!

‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’ সরকারকে সহায়তা দিতে আন্দোলন করে, কোনো ভিসি খেদাও আন্দোলন করে না। তারা আন্দোলন করে দুর্নীতি নামক অসুখকে তাড়াতে। সেখানে আন্দোলন হয় প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে, উপাচার্যকে সাহায্য করতে। যখন তিনি এটা বুঝতে ব্যর্থ হন, তখন তিনি আন্দোলন ভয় পান এবং আন্দোলন সম্পর্কে অপপ্রচার চালান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ক্ষমতাবলে আন্তর্জাতিক মানের সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ ও স্টাফ কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য। প্রধানমন্ত্রী সেখানে সভাপতি। সে জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হতে হবে অনেক অনেক উঁচু মানের পরিশীলিত একজন। এখানে তাই জিরো টলারেন্স প্রযোজ্য! আর এ জন্য জাহাঙ্গীরনগরে ভিসি খেদানো হয় না, আন্দোলন হয় দেশটাকে এগিয়ে নিতে, বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচাতে।

ড. ফরিদ আহমেদ: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।