উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ

ডলার
ডলার

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন লক্ষণীয়। গত দশকে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) তিন গুণ হয়েছে, ২০১৮ সালে যা ১ হাজার ৭০০ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০১৯ সালে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অ্যাজেন্ডা-২০৩০, বিশেষ করে সবার জন্য সুপেয় পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং নবায়নযোগ্য ও সাশ্রয়ী জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যগুলো অর্জনে ভালো অগ্রগতি হচ্ছে।

অর্থনৈতিক গতিশীলতার কারণে বাংলাদেশ গত বছর স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে মাপকাঠি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী ২০২১ সালে প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করতে পারলে ২০২৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত করতে সুপারিশ করবে।

এই বিশাল অর্জন নতুন চ্যালেঞ্জও নিয়ে এসেছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের অর্থ হলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিশেষ সুবিধা হারানো। অনেক উন্নত দেশেই বাংলাদেশের পণ্য যে অগ্রাধিকার পায়, তা হারাবে। এলডিসি টেকনোলজি ব্যাংক, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থায়নে এলডিসি তহবিল অথবা এইড-ফর-ট্রেডের মতো উন্নয়ন সহযোগিতা ব্যবস্থায় বাংলাদেশ আর অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারবে না। যদিও উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত হওয়া এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দুই দেশ মালদ্বীপ ও সামোয়া দেখিয়ে দিয়েছে, এই চ্যালেঞ্জ একটি সুযোগও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নয়নে সংস্কার অথবা তালিকাভুক্তির পর অর্থনৈতিক উন্নয়নকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে আর্থিক ব্যবস্থা জোরদার করা।

২০৩০ সালের মধ্যে সবগুলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে চাইলে দেশগুলোর জন্য উন্নয়ন ব্যবস্থায় অর্থায়ন জোরদার করা জরুরি। কিন্তু যেভাবে সব এগোচ্ছে, আমাদের অঞ্চল সবগুলো এসডিজি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্জনে পিছিয়ে থাকবে। অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে হলে, সবগুলো এসডিজি অর্জন করতে চাইলে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বছরে অতিরিক্ত ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বা তাদের মিলিত জিডিপির ৫ শতাংশ বিনিয়োগ করতে হবে। যদিও দেশভেদে অনেক ভিন্নতাও রয়েছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় জিডিপির ১৬ শতাংশ বার্ষিক অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন, যে বিনিয়োগ কেবল সরকারি-বেসরকারি খাতের মিলিত উদ্ভাবনী অর্থায়নেই সম্ভব।

প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত সম্পদগুলো সরবরাহ যাতে আসে, সে জন্য জাতিসংঘ তিনটি মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে টেকসই উন্নয়নের জন্য অ্যাজেন্ডা-২০৩০ অর্থায়নে তিন বছর মেয়াদি রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছে। এই উদ্দেশ্যগুলো হলো অ্যাজেন্ডা-২০৩০-এর সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নীতি ও আর্থিক ব্যবস্থার সামঞ্জস্য সৃষ্টি; আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে টেকসই অর্থায়ন কৌশল ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সম–অর্থায়ন নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক উদ্ভাবন, নতুন প্রযুক্তি ও ডিজিটালাইজেশনের সম্ভাবনা করায়ত্ত করা। রোডম্যাপের উদ্দেশ্যগুলো অর্জনে আমাদের অঞ্চলে জাতিসংঘের উন্নয়ন শাখা ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (এসক্যাপ) বিভিন্ন উদ্যোগকে সহায়তা দিচ্ছে।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) প্রকল্পগুলোয় সেরা অনুশীলন নিশ্চিত করতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অর্থায়ন ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব নেটওয়ার্কের একটি অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই নেটওয়ার্ক সদস্যরাষ্ট্রগুলোয় জাতীয় পিপিপি ইউনিট ও অবকাঠামো প্রকল্পের সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবে। ভুটানের পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে দেশটির সরকারকে সার্বভৌম বন্ড বাজারের উন্নয়নে কারিগরি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশের উন্নয়ন এবং পরিবেশবান্ধব, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রক ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যোগাযোগকে সমর্থন করা হচ্ছে। যদিও এরপরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন।

ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানে (এমএসএমই) অর্থায়ন বিশেষভাবে জরুরি। এসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানই বিশালসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করে, কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করে বেশি এবং জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রে এমএসএমইগুলোকে রেখে জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের কর্মসংস্থান সৃষ্টির, দারিদ্র্যের হার কমানোয় অবদান রাখার, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে দেশগুলো। পরিবার, সমাজ ও অর্থনীতিতে ইতিবাচকভাবে কড়া নেড়ে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সুযোগ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিচিত এমএসএমই।

এমএসএমইগুলোর জন্য আর্থিক সেবা জোরদার করতে ডিজিটাল আর্থিক সেবা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগের মাধ্যমে আর্থসামাজিক পরিবর্তনকে সহায়তা দিতে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির (আইসিটি) সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, এ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৯৪ শতাংশই এখন থ্রি-জি নেটওয়ার্কের আওতায়। ২০১৭ সাল থেকে ১৩টি বাংলাদেশি ব্যাংক ২ হাজার ২২৪ এজেন্টের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের গ্রাহকসহ ৮ লাখ ৭০ হাজার গ্রাহককে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। মুঠোফোনে আর্থিক লেনদেন, বিশেষ করে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ বিভিন্ন বিল পরিশোধ, বেতন দেওয়া-নেওয়া এবং ব্যক্তিপর্যায়ের লেনদেন বেড়েছে। ২০১৪ সালে মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৭ শতাংশ যেখানে মুঠোফোনে আর্থিক লেনদেন করত, ২০১৭ সালে এসে তা বেড়ে ২১ শতাংশে দাঁড়ায়, যাকে একধরনের বিস্ফোরণই বলা যায়।

ঢাকায় এই সপ্তাহে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন: এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য নতুন আর্থিক চিত্রের অনুসন্ধান’ শীর্ষক আঞ্চলিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, যা এসব ভিত্তি নির্মাণে কাজ করবে এবং আমাদের অঞ্চল যাতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের স্রোতে সওয়ার হতে পারে, তা নিশ্চিত করবে। এ ক্ষেত্রে জানানোর মতো মূল্যবান অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপে এসক্যাপ এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণে সহায়তার অংশ হিসেবে প্রয়োজনীয় গতির জন্য উন্নয়ন অ্যাজেন্ডা অর্থায়নের এই সুযোগ নিতে এবং এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আরমিদা সালসিয়াহ আলিসজাহবানা: জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (এসক্যাপ) নির্বাহী সচিব