'পুলিশ কহেন, নারী যাত্রী শুনেন'

সম্প্রতি গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা বিষয়ে দারুণ উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের সচেতনতামূলক একটি প্রচারণা বার্তায়। বার্তাটি নারীকে উদ্দেশ করে লিখিত। বার্তাটিতে মূলত নারীকে সচেতন করা হয়েছে, তিনি যখন একা একা গণপরিবহনে ভ্রমণ করবেন, তখন তিনি তাঁর নিরাপত্তার স্বার্থে কী কী সাবধানতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এ বিষয়ে। বার্তাটির উদ্দেশ্য ভালো, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যে কৌশলে বার্তাটি রচনা ও পরিবেশন করা হয়েছে, তাতে পুনর্বার প্রতিফলিত হয়েছে সেই সনাতনী পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা; যে ধ্যানধারণা প্রতিষ্ঠা করে নারীর সমস্যা নিতান্তই নারীর একার। তাই তার সমাধানও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে নারীর ওপর। অপরাধ যারই হোক না কেন নারীর নিরাপত্তা রক্ষার সব দায়ভার যেন নারীর একার। সেখানে পুরুষের কোনো অংশগ্রহণ নেই, নেই কোনো অংশীদারত্ব।

বার্তাটিতে নারীকে যে ধরনের সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে, তা গোয়েন্দা পুলিশের তৎপরতাকেও যেন হার মানায়। নারী যেন কোনো যাত্রী নয়, তিনি যেন এক তদন্ত কর্মকর্তা। বাসে ওঠার পর থেকেই তিনি অবিরাম সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন গাড়ির প্রতিটি ইঞ্চিতে, কোনায় কোনায়। তিনি একাধারে প্রতিমুহূর্তে গাড়ির যাত্রীর সংখ্যা গুনবেন, তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবেন, সন্দেহজনক আচরণ পর্যালোচনা করবেন, গাড়ির নাম-ধাম-অবস্থান মুখস্থ করে রাখবেন। আরও মজার বিষয় হলো নারী যাত্রীটি যতই ক্লান্ত থাকুন না কেন, কোনো অবস্থাতেই তিনি গাড়িতে ঘুমাতে পারবেন না। এ ছাড়া বিপদ অনুমিত হলে তিনি সন্দেহকারীকে উদ্দেশ করে, তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে মোবাইলে এমনভাবে কথা বলবেন, যেন সন্দেহকারী বুঝতে পারেন যে নারীটি তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। ফলে অপরাধী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নারীটিকে হয়রানি করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন। আরও বলা হয়েছে কোনো স্টপেজে যাত্রীর সংখ্যা কমে ৫–এর নিচে চলে আসার উপক্রম হলে সেটি নারী যাত্রীটির গন্তব্যস্থল না হলেও তিনি নেমে পড়বেন এবং যাত্রীদের মধ্য থেকে নির্ভরযোগ্য কাউকে পরিজন না আসা পর্যন্ত থাকার জন্য অনুরোধ করবেন। প্রশ্ন হলো কিছু সময়ের মধ্যে পরিচিত ব্যক্তিটির নির্ভরশীল হয়ে ওঠার মানদণ্ড কী! সেই স্থানে সেই ব্যক্তি কর্তৃক নারীটি যে সহিংসতার শিকার হবেন না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

কী অদ্ভুত এই আয়োজন! আমি জানি না এই বার্তার উন্নয়নে কারা সম্পৃক্ত ছিলেন! সেই কমিটিতে কোনো নারী সদস্য ছিলেন কি না! বার্তাটিতে নারীর জন্য স্তরে স্তরে এতগুলো নির্দেশনা এলেও কোনো নির্দেশনা নেই পুরুষের জন্য। কোথাও উত্ত্যক্তকারী কিংবা ধর্ষকের জন্য নেই কোনো সতর্কবার্তা, কোথাও উল্লেখ নেই অপরাধীর অপরাধের জন্য শাস্তির বিধানসমূহ কী কী, নেই ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টারের ভূমিকার বিষয়টি। নারীর কাজ কী কেবলই সতর্ক থাকা আর নিজেকে গুটিয়ে রাখা? নারী আর কত দিন কতভাবে নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন আর আড়াল করবেন! ঘরে–বাইরে সর্বত্র নিজের নিরাপত্তা বিধানের দায়ভার কী এবার নারীর একার নিতে হবে! সারা দিনের কর্মক্লান্ত শরীরে চোখে সামান্য ঢুলুনি এলেও তা পরিত্যাগের জন্য যে দেশের পুলিশ বাহিনী নারীকে নিদের্শনা দেয়, ব্যর্থ সে দেশের পুলিশ প্রশাসন, ব্যর্থ সে দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা।

সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ২৫৩ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এর মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে প্রায় ৯৮ শতাংশ নারী এবং কন্যাশিশু কখনো না কখনো পাবলিক প্লেসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যাত্রীকল্যাণ সমিতি কর্তৃক এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছিল, গণপরিবহনে ১৩ মাসে মোট ২১ জন নারীর ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণের ভয়াবহ তথ্য। ২০১৮ সালে ব্র্যাক পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছিল বাংলাদেশের গণপরিবহনে যাতায়াতকালে ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময় মৌখিক, শারীরিক এবং অন্যান্যভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। এই যে ৯৪ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন, তার জন্য কি তাঁরা নিজেরা দায়ী? যদি তাঁরা দায়ী না হন, তবে নিজেদের রক্ষার দায়দায়িত্ব কেন তাঁরা নিজেদের কাঁধে তুলে নেবেন? আর ৯৪ শতাংশ নারীর চলার পথের স্বস্তি নষ্টকারী মানুষগুলো কোন ক্ষমতাবলে সব নির্দেশনার ঊর্ধ্বে থাকবে?

সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে যে বার্তা রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব এবং সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত নাগরিকের অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, সে বার্তা কখনোই কাম্য হতে পারে না। কোনো দোষ না করেও অপরাধের ঘানি টানার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নেই। তাই এ ধরনের বার্তা নারীর জন্য চরম অবমাননাকর। আজ বাংলাদেশের প্রতিটি নারীর প্রতিটি দিন কাটে চরম নিরাপত্তাহীনতায়। নারীর স্বস্তি নেই পরিবারে , স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্মক্ষেত্রে, গণপরিবহণে। সাত মাসের শিশু থেকে শতবর্ষী পৌঢ়া কেউই বাদ যাচ্ছেন না যৌন সহিংসতা থেকে। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, জিনস, টি–শার্ট কিংবা পায়ের পাতা থেকে মাথা ঢাকা পোশাক কোনোটিই নিরাপত্তা দিচ্ছে না নারীকে। তাই নতুন করে আর কোনো করণীয়-বর্জনীয়র গুরুভারে নারীর জীবনকে জর্জরিত না করা হোক। অপরাধকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক, অপরাধীদের চিহ্নিত করা হোক আর অপরাধীর উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাপকভাবে প্রচার–প্রচারণা চালানো হোক।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]