শ্রীলঙ্কায় নির্বাচনোত্তর উত্তেজনা পাকিয়ে উঠছে

গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এএফপি ফাইল ছবি
গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এএফপি ফাইল ছবি

কট্টরপন্থী গোতাবায়া রাজাপক্ষে নির্বাচিত হওয়ার দুই সপ্তাহ না পেরোতেই শ্রীলঙ্কায় বিবদমান গোষ্ঠীগুলোর সমঝোতার সব আশা ছিন্নভিন্ন হওয়া শুরু হয়েছে। গোতাবায়ার ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে যে তামিল অধ্যুষিত উত্তর–পূর্ব শ্রীলঙ্কায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলেন, গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সেখানে সেই পুরোনো আতঙ্ক নতুন করে দেখা দিয়েছে।

২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে গোতাবায়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় চলা গৃহযুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। তামিল সম্প্রদায় চেয়েছিল, নির্বাচনে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা সাজিত প্রেমাদাসা জয়লাভ করুক। কারণ, তাঁকে তামিলরা গোতাবায়ার চেয়ে ‘কম খারাপ’ মনে করে। নির্বাচনী প্রচারকাজের সময় গোতাবায়া জাতীয়তাবাদী বাগাড়ম্বরকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে তিনি সেনাপ্রধান শাভেন্দ্র সিলভাকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের হাত থেকে রক্ষা করবেন ও বৌদ্ধধর্মের লোকদের অগ্রাধিকার দেবেন। এখন তিনি জেতায় সংখ্যালঘুরা ভয়ে পড়েছেন।

উত্তর–পূর্বাঞ্চলে তামিলরা এবং তামিল ভাষাভাষী মুসলমানদের বেশির ভাগই প্রেমাদাসাকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এই ভোট প্রেমাদাসার জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাঁর প্রতিপক্ষ গোতাবায়া দক্ষিণের সিংহলিদের একচেটিয়া ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। এই ভোটের পরই সংখ্যাগুরু সিংহলিরা তামিল এবং মুসলমানদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। তাদের সম্পর্কের পুরোনো ফাটল নতুন করে বড় হচ্ছে।

গোতাবায়ার পূর্বসূরি মাইথ্রিপালা সিরিসেনা পশ্চিমা সরকারগুলো ও কলম্বোভিত্তিক অভিজাত শ্রেণির সহায়তায় সব গোষ্ঠীর মধ্যে সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠায় বেশ আশা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সে আশা এখন নিভে গেছে। নতুন প্রেসিডেন্ট তাঁর ‘স্ট্রং ম্যান’ ভাবমূর্তি প্রদর্শনের জন্য কোনো রকম সময় নষ্ট করেননি। জিতেই তিনি সিংহলি বৌদ্ধদের নিয়ে বিশাল র‍্যালি করেছেন। গত ১৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেওয়া তাঁর প্রথম ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘বৌদ্ধ দর্শন’ মেনে তাঁর সরকার পরিচালিত হবে, তিনি সিংহলি সংস্কৃতি ও বৌদ্ধ ঐতিহ্যকে অগ্রাধিকার দেবেন। গৃহযুদ্ধের সময় তিনি যে ভূমিকা রেখেছিলেন, সেটিকে মহিমান্বিত করেও তিনি ভাষণ দিয়েছেন। তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানটি হয়েছে উত্তরাঞ্চলীয় অনুরাধাপুর শহরের একটি বৌদ্ধমন্দিরে। এই মন্দিরটি বানিয়েছিলেন সিংহলি শাসক দুতুগামুনু, যিনি তামিলচোলা রাজবংশেররাজা এলালানকে পরাস্ত করে সমগ্র দ্বীপরাষ্ট্রটিকে সিংহলি শাসনের অধীনে এনেছিলেন।

গোতাবায়া যাদেরই তাঁর সরকারের জন্য হুমকি মনে করছেন, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন। গোতাবায়ার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অপরাধের অভিযোগ তদন্তে যে পুলিশ কর্মকর্তারা নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের সবার বিদেশভ্রমণে তিনি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এসব কর্মকর্তার মধ্যে একজন প্রাণ বাঁচাতে ভোটের পরপরই দেশ ছেড়ে পালিয়ে সুইজারল্যান্ড চলে গেছেন। তিনি পালানোর পর শ্রীলঙ্কায় সুইস ভিসা বিভাগের একজন কর্মীকে শ্রীলঙ্কার পুলিশ আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

তামিল ও সিংহলি সংবাদমাধ্যম ভোটের পর থেকেই বড় ধরনের চাপে আছে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে তাঁদের কম্পিউটার পুলিশকে দিতে হয়েছে। তাঁরা গোতাবায়ার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন কি না, তা তারা খতিয়ে দেখছে। তামিল অধিকারকর্মীরা এখন নিরাপত্তাকর্মীদের কড়া পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। সেলফ সেন্সরশিপ সেখানে আবার স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তামিলদের বিরুদ্ধে সিংহলিরা সমানে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালাচ্ছে। গোতাবায়ার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার অভিযোগে দেশের কেন্দ্রস্থলেও সিংহলিরা তামিলদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, নতুন এই প্রেসিডেন্টের অধীনে শ্রীলঙ্কা আবার জাতিগত সহিংসতার দিকে এগিয়ে যাবে। সেখানে এখন এই আইডিয়া প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে যে, শ্রীলঙ্কা সিংহলি বৌদ্ধদের দেশ এবং তাদের বাইরে যারা আছে তাদের কেউই এই দ্বীপের আদি বাসিন্দা নয়। তারা বহিরাগত। ফলে তাদের সিংহলি বৌদ্ধদের সমান নাগরিক মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে না। এই ‘বহিরাগত’ তামিল, তামিল ভাষাভাষী মুসলমান, খ্রিষ্টানসহ অন্যদের সিংহলি বৌদ্ধদের শ্রেষ্ঠত্ববাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে। এ বিষয়ে কোনো ধরনের প্রতিবাদ করতে গেলেই তাদের সিংহলিদের ওপর হামলাকারী হিসেবে গণ্য করা হবে।

যেহেতু তামিলরা বিদ্রোহী জাতি হিসেবে বহুকাল ধরে পরিচিত। তাদের অবদমন করে রাখার চেষ্টা তারা সহজে মেনে নেবে—এমনটা আশা করা যায় না। গোতাবায়ার জয়ে তারা কোণঠাসা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা একেবারে দমে যায়নি। এ অবস্থায় সিংহলিরা উসকানিমূলকভাবে তাদের ওপর হামলা চালালে তার পাল্টা জবাব আসতে পারে। আর সেটা এলে আবার পুরো দ্বীপটি দাঙ্গার ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মারিও আরুলথাস: ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক সংগঠন ইকুয়ালিটি অ্যান্ড রিলিফ ইন লঙ্কা (পার্ল)-এর অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর