আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলা

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনা গাম্বিয়ার মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। ৫৭ জাতি ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে গাম্বিয়া গত ১১ নভেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে। বিষয়টি শুধু রোহিঙ্গা নামের একটি জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার লাভের অধিকারের বিষয় নয়, এটি মূলত বিশ্বমানবতার মর্যাদা রক্ষার প্রশ্ন। বিশ্ববাসীর কাছে সাধারণভাবে এ পর্যন্ত এটাই প্রতীয়মান হয়ে আসছে যে সেনানিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র মিয়ানমার বেশ শক্তিশালী। শক্তির জোরেই তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালিয়েছে, তাদের দেশছাড়া করেছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি তারা ঝুলিয়ে রেখেছে। দফায় দফায় রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত ও দেশছাড়া করে তাদের ফিরিয়ে নিতে গড়িমসি ও অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।

মিয়ানমার রাষ্ট্র হিসেবে পদ্ধতিগতভাবে বহু বছর ধরে এসব করেছে। কিন্তু তারা কখনোই কোনো আন্তর্জাতিক আদালতে জবাবদিহির জন্য দাঁড়ায়নি। এর আগে মিয়ানমার এখতিয়ারের প্রশ্ন তুলে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতকে (আইসিসি) সহযোগিতা করতে চায়নি। কিন্তু এবার আন্তর্জাতিক বিচার আদালত আইসিজে মিয়ানমার রাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার বিচার করতে পারবেন। এখানে ব্যক্তি নয়, অভিযুক্ত স্বয়ং রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমার।

তবে আমরা সবাই জানি যে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায় চূড়ান্তভাবে কার্যকর করার বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করে। আর এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ও হতাশার যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সদস্য খোলাখুলিভাবেই মিয়ানমার রাষ্ট্রের পক্ষ অবলম্বন করেছে। এসব দেশ বাংলাদেশেরও গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার। আশা করব, আইসিজেতে যেহেতু মামলাটির বিচার শুরু হয়েছে, তাই এই দেশগুলো এখন আইনকে তার আপন গতিতে চলতে সহায়তা করবে। বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের যেকোনো আশাবাদের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। অনেক বাস্তবতাকে আমাদের অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ, রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হলেও অনেক দেশ ভূরাজনৈতিক ও সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শুনানি শুরু এবং এই মামলার ফলাফল এই দেশগুলোকে তাদের অবস্থান বদলের সুযোগ করে দিতে পারে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যা ঘটেছে, জাতিসংঘের তরফেও শুরুতে তাকে গণহত্যা বলা হয়নি, বলা হয়েছিল এথনিক ক্লিনজিং। পরে অবশ্য তারা পরিষ্কারভাবে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার কথা বলেছে। আদালতের সামনে এখন যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, মিয়ানমারে কোনো ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। যদিও বহু স্বাধীন সংস্থার কাছে তার অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। তদুপরি আদালত চাইলে সরেজমিন পরিদর্শন করতে পারেন। মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি আদালতের এমন অভিপ্রায়ের প্রতি কী মনোভাব দেখান, সেটা জানতে বিশ্বের বিচারকামী মানুষের স্বাভাবিক আগ্রহ থাকবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তরফে গাম্বিয়ার মামলা কিংবা মানবতা সুরক্ষার মামলাটি পরিচালনায় সহায়ক শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর সুযোগ রয়েছে। আমরা বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে সেই অনুরোধ রাখতে চাই। এই মামলা ভাবীকালের গণহত্যাকারীদের প্রতি একটি কঠোর বার্তা দেওয়ার সুযোগ ও পরিস্থিতি তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগে ওআইসিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করার জন্য বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই মামলার বিচার কার্যক্রম চলাকালে বাংলাদেশের তরফ থেকে একটি সর্বাত্মক কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকবে, সেটাই প্রত্যাশিত।

গাম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন আইনজ্ঞ প্রতিনিধিদলের ওপর আমাদের পুরো ভরসা ও আস্থা রয়েছে। আমরা লক্ষ করি, এ পর্যন্ত এই মামলায় অগ্রসর গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার দেশগুলোর মধ্যে শুধু নেদারল্যান্ডস ও কানাডা সরব হয়েছে। আমরা আশা করছি, এই দুটি দেশের সঙ্গে অন্য আরও অনেক দেশ শামিল হবে।