ইরান: শাসক ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির কারণ অর্থনীতি

যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় ইরানের অর্থনীতির পতন ঘটছে। ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় ইরানের অর্থনীতির পতন ঘটছে। ছবি: রয়টার্স

ইরান যতই তার পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি প্রসারিত করছে, ততই যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার আওতায় দেশটির অর্থনীতির পতন ঘটছে। বর্তমান সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও হতাশা ইরানের সমাজের মধ্যে গভীর বিভাজন তৈরি করছে। তবে ইরানের শাসকগোষ্ঠী কীভাবে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক চাপের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

অপেক্ষাকৃত কম বৈরী মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার আশায় ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির অবসান পর্যন্ত অপেক্ষা করার ইরানি কৌশল কাজ না-ও করতে পারে। বাইরের অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন যে ইরানের অর্থনীতির পতন প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুতগতিতে হচ্ছে। তাঁরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ইরান হয়তো ট্রাম্পের শাসনের অবসান হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না। কেননা, ইরানের ওপর ফের মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ার পর থেকে ইরানের অর্থনীতি তার প্রায় ১০ শতাংশ উৎপাদন হারিয়েছে।

যদিও প্রাথমিক ঝড় থেকে ইরানের অর্থনীতিকে বাঁচতে দেখা গেছে, কিন্তু সময়টা এখন ইরানের পক্ষে নেই। দেশটির সাম্প্রতিক বিক্ষোভ-প্রতিবাদ তা-ই প্রমাণ করেছে।

গত মে মাসে বহু পর্যায়ের পদ্ধতির মাধ্যমে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি শুরু করার ঘোষণা দেওয়ার পর ইরানের নীতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে ইউরোপীয় দেশগুলো। যদিও ইউরোপীয়রা ২০১৫ সালের ইরান পারমাণবিক চুক্তির প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছিল। তবে বেশ কয়েকটি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও ইউরোপ ইরানের পক্ষে ট্রাম্পকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানাবে, তা কল্পনা করা শক্ত। সর্বোপরি, তিনটি ইউরোপীয় শক্তি গত সপ্তাহে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জন্য ইরানকে দোষারোপ করেছে। এই ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে তারা তেহরানের ব্যাপারে ধৈর্য হারাতে পারে। 

কানাডার ইউনিভার্সিটি ডি মন্ট্রিয়লের ইরানের পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ ভাহিদ ইউসেসোয় বলেছেন, সর্বশেষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভের কারণে ইরানের শাসকদের এবং জনগণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ভারী চাপ সহ্য করা ইরানের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি অবশ্য এটা মনে করেন যে সংকট নিরসনের জন্য যেকোনো ধরনের সংলাপ অসম্ভব নয়। 

বর্তমানে ইরানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কোনো সম্ভাবনা নেই। নিউজার্সিভিত্তিক রুটগার্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, ইরান আমেরিকান কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি এবং ২০০৫,২০১৩ ও ২০১৭ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হুশাং আমিরাহমাদির মতে, ইরানের অর্থনীতি এখন ‘ধসের কিনারায়’, তবে মূল সমস্যাটি নিষেধাজ্ঞার চেয়ে মূলত অব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। আমিরাহমাদি মনে করেন, ইরানের শাসকেরা জানেন যে আলোচনায় ফিরে এলে তাঁদের সমস্যার সমাধান হবে না এবং এ কারণে তাঁরা ‘প্রতিরোধ অব্যাহত রাখবে এবং ট্রাম্পের শাসন অবসানের জন্য অপেক্ষা করবে।’ 

গত অক্টোবর মাসে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঘোষণা করেছে যে চলতি বছর ইরানের অর্থনীতির অবনমন ঘটবে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। ইরানের পেছনে কেবল লিবিয়া ও ভেনেজুয়েলা রয়েছে। দেশটির খনিজ ও ধাতবশিল্প রপ্তানির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি তেল ও গ্যাস রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে এই অবনমন ঘটবে। তেলের আয় ইরানের বেঁচে থাকার মূল চাবিকাঠি, কারণ ইরানের করের আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই আসে তেল রপ্তানি থেকে। পুনরায় আরোপিত নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে ইরান বিকল্প উপায়ে তেল রপ্তানির চেষ্টা করেছিল। তবে এভাবে তেল বিক্রি ইরানকে চরম মন্দা অবস্থা থেকে রক্ষা করেনি। 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক জ্যেষ্ঠ সদস্য সারা বাজুবন্দি বেশ কিছু হতাশাব্যঞ্জক তথ্য দিয়েছেন। যেমন ইরানের তেল রপ্তানির পরিমাণ প্রতিদিন পাঁচ লাখ ব্যারেল করে কমছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে এবং জমিজমা ও বাড়িঘরের দাম ৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। যদিও সার্বিক বেকারত্বের হার ১০ শতাংশের কিছু বেশি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের প্রায় ৪৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। 

আমিরাহমাদির মতে, এসব সমস্যার কোনো সমাধান কারও কাছে নেই। কারণ, এখানে একটি মারাত্মক অচলাবস্থা বিরাজ করছে এবং তা অব্যাহত থাকবে। ইউসেসোয় উল্লেখ করেছেন যে বিপ্লবের প্রথম দুই দশক থেকে দেশটি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, এবং এমনকি প্রাদেশিক শহরগুলোতেও শাসকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তুষ্টি রয়েছে। 

সাম্প্রতিক বিক্ষোভে এটা বোঝা গেছে যে ক্রমাবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং বিদেশি চাপ দেশের ভেতরে আরও গভীর বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে। বাজুবন্দি দেখেছেন যে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে ফাটল গভীরতম পর্যায়ে রয়েছে। তাঁর মতে, সাম্প্রতিক বিক্ষোভ দুটি বিষয় প্রমাণ করেছে, ‘জনগণের এমন দুঃখ-কষ্টে রয়েছে, যেগুলো সমাধান করা হচ্ছে না’ এবং ‘যেকোনো ধরনের বিরোধিতায় সরকার সর্বোচ্চ সহিংস উপায় ব্যবহার করতে প্রস্তুত।’ আসলে সরকারের ওপর জনগণের আর কোনো আস্থা নেই। আমিরাহমাদির মতে, প্রেসিডেন্ট রুহানির সরকার ভেঙে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এবং এটাও সম্ভব যে ‘জনগণের সঙ্গে মিলে সেনাবাহিনী সরকারকে উৎখাত করেছে।’ 

মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত


স্তাসা সালাসানিন কাতারভিত্তিক সংবাদপত্র বিকিউ ম্যাগাজিনের জ্যেষ্ঠ সংবাদদাতা