নেপথ্য শক্তিকে কেউ ঘাঁটাতে চায় না

ইমরান খান, আসিফ আলী জারদারি ও নওয়াজ শরিফ। এএফপি ফাইল ছবি।
ইমরান খান, আসিফ আলী জারদারি ও নওয়াজ শরিফ। এএফপি ফাইল ছবি।

আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যখন সমাজে খুব ঠান্ডা মাথায় নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা ছড়ানো হচ্ছে, প্রোপাগান্ডা দিয়ে সুবিধামতো জনমানস তৈরি করা হচ্ছে। ক্ষমতার লড়াইয়ে যারা প্রোপাগান্ডা দিয়ে জনগণের মনকে জয় করতে পারে, তারাই শেষমেশ জয়ী হয়। পাকিস্তানে ক্ষমতা দখলের খেলায় এখন এই চালাকি চলছে। অদৃশ্য শক্তির মদদপুষ্ট সরকার এবং বিরোধীরা—উভয় পক্ষই যার যার নিজেদের ভাগের রুটি নেওয়ার জন্য ব্যস্ত রয়েছে। 

ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রবল ক্ষমতাধর সামরিক প্রতিষ্ঠানের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং এখন পর্যন্ত সেনা কর্মকর্তাদের ছত্রচ্ছায়ায় আছে। তারা এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে পাকিস্তানকে বের করে আনতে পারেনি। পিটিআই সরকার
এখনো মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনতে পারছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ দিন দিন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। 

সরকার যে জনগণের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হবে, তা তখনই সবাই বুঝতে পেরেছিল যখন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার চালিয়ে নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে উৎখাত করা হয়েছিল। শরিফ ক্ষমতাচ্যুত হয়েই ঘোষণা করেছিলেন, ইমরানের সঙ্গে সামরিক গোষ্ঠীর আঁতাত হয়েছে। তখন থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের মেরুকরণ হয়েছে। সেই মেরুকরণ যে কতটা প্রকট আকার ধারণ করেছে, তা সম্প্রতি লন্ডনে নওয়াজ শরিফের বাসভবনে পিটিআই সদস্যদের হামলায় স্পষ্ট হয়েছে। আসলে এই মেরুকরণ এখন ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়েছে। 

শাসনক্ষমতার দিক থেকে ইমরান দুর্বল হয়ে পড়লেও তিনি এখনো দাবার বোর্ডে টিকে আছেন। তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ নওয়াজ বর্তমানে অসুস্থ। তিনি আপাতত খেলায় নেই। তাঁর প্রধান অস্ত্র মরিয়ম নওয়াজও চুপ করে আছেন এবং নওয়াজের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ সামরিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন। 

আসিফ আলী জারদারিও অসুস্থ। তাঁর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ইমরান খান কিংবা সামরিক প্রতিষ্ঠানের জন্য হুমকি হওয়ার বিষয়ে আগ্রহী নয়। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পাঞ্জাব প্রদেশে পিপিপির কোনো প্রভাবও লক্ষ করা যাচ্ছে না। 

দাবার বোর্ডে প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষমতা হারিয়েছে। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো, কেউ কাউকে ঠেলে ফেলার চেষ্টায় নেই। এই সুযোগে নওয়াজের পিএমএল–এন বড় আকারে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে পারত এবং মরিয়ম নওয়াজ সহজেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মাঠে নামতে পারতেন। 

কিন্তু পিএমএল–এনের কর্মী–সমর্থকেরা দ্বিধায় আছেন। দলের মূল নেতৃত্ব মরিয়ম নাকি শাহবাজের হাতে, তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে দোটানা ভাব আছে। মরিয়মের অনুসারীরা এখনই ইমরানের বিরুদ্ধে গিয়ে কার্যত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নামার পক্ষে নন। অন্যদিকে শাহবাজপন্থীরা বিক্ষোভ করার পক্ষে।  

পিপিপিও এ মুহূর্তে সেনাবাহিনীকে কোনোভাবে চটিয়ে আরও বড় চাপের মুখে পড়তে চায় না। মওলানা ফজলুর রহমান সেনাবাহিনীর একাংশের সমর্থন নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ইমরানের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনিও এখন ঝিমিয়ে পড়েছেন। সব মিলিয়ে এটি এখন স্পষ্ট, পাকিস্তানে বর্তমানে যে শাসনব্যবস্থা চলছে, তা সহসাই পরিবর্তন হচ্ছে না। পিএমএল–এন সেনাসমর্থিত সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলছে। পিপিপি সিন্ধু প্রদেশে তাদের প্রাদেশিক সরকার এবং দলের প্রধান আসিফ জারদারিকে রক্ষায় সেনাবাহিনীর পেছনে লাগতে যাচ্ছে না। 

যুক্তরাষ্ট্রও আফগানিস্তান ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের ইস্যুতে নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে গিয়ে সেনাসমর্থিত সরকারকে সমর্থন করছে। চীন-পাকিস্তান করিডর বাস্তবায়নের জন্য এই সরকারকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে চীনও। 

চীনের কাছে পাকিস্তান সরকার ধারদেনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এ অবস্থায় চীন পাকিস্তানে সেনাসমর্থিত সরকারকে সমর্থন দিলে সেখানে অনাস্থা দেওয়ার ক্ষমতা পাকিস্তানের কোনো দলেরই নেই। 

মরিয়ম নওয়াজ ইতিমধ্যেই সরকারের কাছে তাঁকে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকা থেকে বাদ দিতে আবেদন করেছেন। অসুস্থ বাবাকে দেখতে তিনি লন্ডন যেতে চান। এ মুহূর্তে পিএমএল–এনের প্রতি সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন থাকলেও সরকার এমনভাবে চারদিক থেকে নওয়াজ ও মরিয়মকে চেপে ধরেছে যে তাঁদের পক্ষে টুঁ–শব্দটি করা সম্ভব হচ্ছে না। 

সব মিলিয়ে এখন যে অবস্থা, তাতে ইমরানকে যদি এ মুহূর্তে সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল বলা যায়, তাহলে নওয়াজ এবং জারদারিকে সেনাবাহিনীর অনুচর বলা যেতে পারে। 

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
ইমাদ জাফর পাকিস্তানের লেখক ও সাংবাদিক