অমুসলিম দেশগুলোর উচিত নতুন মামলা করা: ফ্রেডেরিক জন প্যাকার

অধ্যাপক ফ্রেডরিক জন প্যাকার
অধ্যাপক ফ্রেডরিক জন প্যাকার
>

অধ্যাপক ফ্রেডরিক জন প্যাকার কানাডার অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রাইটস রিসার্চ ও এডুকেশন সেন্টারের পরিচালক এবং আইন অনুষদে ইন্টারন্যাশনাল কনফ্লিক্ট রেজল্যুশনের অধ্যাপক। মিয়ানমারে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের প্রথম স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ারের সহকারী এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ১৯৯২ সাল থেকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন তিনি। এক ডজনের বেশি দেশে তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করেছেন। সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় তাঁর বিশেষজ্ঞ জ্ঞান রয়েছে। ই-মেইলে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) সম্ভাব্য অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ কী হতে পারে? গাম্বিয়ার পক্ষে আইনজীবী অধ্যাপক ফিলিপ স্যান্ডস চার মাস সময় দিয়ে রাখাইনে একটা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠানোর যুক্তি দিয়েছেন। কীভাবে দেখছেন?

জন প্যাকার: আদালতের উচিত আবেদনকারীর অনুরোধে সাড়া দেওয়া এবং মামলার গুণাগুণ বিচার করে রোহিঙ্গাদের অপূরণীয় ক্ষতি এড়ানো এবং তাদের অধিকার সুরক্ষায় আদেশ দেওয়া। আদালতের সামনে সাধারণত যেসব মামলা আসে, এই মামলার ধরন তেমন নয়। এটা অত্যন্ত গুরুতর। কারণ, এখানে দাবি করা হয়েছে যে গণহত্যা চলমান রয়েছে। অন্যান্য মামলার সঙ্গে এর এখানেই ব্যতিক্রম। তাই এটা কষ্টসাধ্য অনুমান নয় যে আদালত তাঁর সংবিধিবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে থেকেই একটা সম্ভাব্য তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন।

প্রথম আলো: অং সান সু চির আইনজীবী, কানাডীয় অধ্যাপক সাবাস, যিনি নিজেই মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এর আগে প্রকাশ্যে মিয়ানমারকে দুষেছিলেন, তিনি এখন স্ববিরোধী অবস্থান নিলেন। এমন ‘দ্বৈত নীতি’ প্রদর্শনের ঘটনায় কি একটা নৈতিক বিচ্যুতি ঘটেনি?

জন প্যাকার: ধারণা করি, অধ্যাপক সাবাস এই মামলার ধরনের বিষয়ে বিভ্রান্ত। আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে মিয়ানমারের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে, কিন্তু এটা কোনো একটা সাধারণ ফৌজদারি মামলা নয়। তাই একজন প্রথিতযশা আইনবিদ হয়ে তিনি যেমনটা বলেছেন, সবারই আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে—এ কথা এ ক্ষেত্রে খাটে না। এখানে কারও দণ্ডদান ঘটছে না, তাই তাঁর আইনি সেবা দেওয়ার বিষয়টি নেই। মামলাটি দুটো রাষ্ট্রের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক দেওয়ানি মামলা। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগই প্রমাণিত, যা বহু মানুষের বিরাট ক্ষতির কারণ হয়েছে। সুতরাং আইনজীবী হিসেবে তিনি প্রথাগত অর্থে তঁার মক্কেলকে সমর্থন করতে দাঁড়ানোর যে যুক্তি দেখিয়েছেন, তা আসলে বিভ্রান্তিকর। এই মামলায় মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করার ঘটনায় অধ্যাপকসাবাসের সিদ্ধান্ত আমাকে দুঃখিত করেছে।

প্রথম আলো: ২০১০ সালেসাবাস একটি গবেষণায় সহায়তা করেছিলেন, যেখানে দেখানো হয়েছিল যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কী করে পদ্ধতিগত আক্রমণ চালানো হয়েছিল এবং সেই প্রতিবেদনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্যভাবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়। সাবাসের এই ভূমিকাকে সমালোচনা করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, তিনি রোহিঙ্গাদের বিক্রি করে দিয়েছেন।

জন প্যাকার: হ্যাঁ। এটা পরিষ্কার যে অধ্যাপক সাবাসেরপূর্ববর্তী প্রকাশ্য বিবৃতির সঙ্গে বর্তমান অবস্থান অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এর ফলে আদালতের সামনে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। তিনি আসলে মিয়ানমারবিরোধী তাঁর পূর্ববর্তী অবস্থানের বিষয়েই আরও নির্দিষ্টভাবে মতামত তৈরি করতে পারতেন। আদালতের বাইরে চুপচাপ নিজের মত বদলাতে পারতেন। অবশ্য স্ববিরোধী অবস্থান নেওয়ার কারণে তিনি আদালত কিংবা অন্যদের বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারবেন না বলেই মনে হয়।

প্রথম আলো: অং সান সু চি আদালতে তঁার বিবৃতিতে বলেছেন, গণহত্যার উদ্দেশ্যই (জেনোসাইডাল ইন্টেট) একমাত্র হাইপোথিসিস হতে পারে না। তিনি এমনকি ‘অসমানুপাতিকভাবে’ শক্তির ব্যবহার, রোহিঙ্গারা ‘দুর্ভোগের’ শিকার হয়েছেন—ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন। আপনার কি মনে হয়, এর ফলে আইনগতভাবে তিনি কোনো বিচ্যুতি ঘটিয়েছেন?

জন প্যাকার: প্রতীয়মান হয় যে অং সান সু চি এবং তঁার আইনজীবী দল ভেবেছেন, গণহত্যা সংঘটনে হয়তো কিছু অনুমোদনযোগ্য উপায় দাঁড় করানো যেতে পারে, যেমন সম্ভাব্য কোনো সন্ত্রাসী হুমকি, সেটা ছোট বা বড় যা–ই হোক না কেন। কিংবা সেটা মোকাবিলা করতে গিয়ে কোনো ভুলভ্রান্তি ঘটা কিংবা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক উন্নয়নের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ব্যবহার করে কোনো সহানুভূতি আদায় করে তাঁর সরকারের প্রতি বিশ্বাস ফেরানো। তাই তিনি বলেছেন, এখন তাঁরা দোষীদের শাস্তি দিচ্ছেন। কিন্তু আসল কথা হলো এসবের কোনো কিছুই গণহত্যা সংঘটনের পক্ষে কোনো যুক্তি হতে পারে না। দিন শেষে একটাই যুক্তি, রাষ্ট্রকে গণহত্যা মোকাবিলা করতে হবে।

প্রথম আলো: সু চির বক্তব্য সাধারণ বিবরণের মধ্যে সীমিত ছিল না। তিনি বেশ তথ্যগত, ঐতিহাসিক এবং আইনগতভাবে একটা বিস্তারিত অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এমনকি তিনি যথারীতি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেননি। আপনার মন্তব্য কী?

জন প্যাকার: রোহিঙ্গা শব্দটি তিনি যে ব্যবহার করেননি, তার মধ্য দিয়ে এটাই পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারি নীতিতে একটি নির্দিষ্ট গভীর বিরোধী ও বিদ্বেষপ্রসূত অবস্থান রয়েছে। আদালতে সু চির বক্তব্যে ওই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনে তাঁর সরকারের অবস্থানেরই একটা প্রতিফলন ঘটেছে। জেনোসাইড কনভেনশন রাষ্ট্রের কাছে যে ধরনের সুরক্ষা দাবি করে, সু চি যে তাঁর বিপরীতটাই করেছেন তারই ছাপ পড়েছে তাঁর যুক্তিতে। তাদের ভেতরে যে অশুভ মনোভাবের অস্তিত্ব রয়েছে, সেটা সু চির বক্তব্যের সূত্রেই আদালত বিবেচনা করতে পারেন।

প্রথম আলো: সু চির বক্তব্যের বেশির ভাগ জায়গাজুড়ে ছিল যে এটা একটা সামরিক এবং বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের মোকাবিলায় একটা সশস্ত্র সংঘাত। যাতে বিষয়টি নিরাপত্তাব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে। যাতে এমন ধারণা তৈরি হয় যে এতে অনেকেরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু গণহত্যার মোটিভ ছিল না।

জন প্যাকার: জেনোসাইড কনভেনশনের কোনো লঙ্ঘন ঘটেছে কি না, সেটা নাকচ করতে ইতিহাসকে টেনে আনা দারুণভাবে অপ্রাসঙ্গিক। সেই কারণে রাখাইনে একটি সামরিক সংঘাতের উপস্থিতি ছিল কি ছিল না, সেটাও গণহত্যা নিরূপণের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অবশ্যই কোনো সামরিক সংঘাত ছিল না, এখনো নেই।

প্রথম আলো: তিনি আরসার কথিত ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের’ কথা বলেছেন। যে কারণে রোহিঙ্গারা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’।

জন প্যাকার: গণহত্যা এমন একটি বিষয় যা শুধু যুদ্ধকালে নয়, শান্তিকালীনও ঘটতে পারে। প্রতীয়মান হয় যে অং সান সু চি জেনোসাইড কনভেনশন সম্পর্কে একেবারেই কিছু বুঝে উঠতে পারেননি কিংবা দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা করেছেন। অথবা তিনি এসব টেনে এনেছেন একদমই এ কারণে যে মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে ‘জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে’ তিনি আগের থেকে ভালো করতে পারবেন!

প্রথম আলো: আইরিশ আইসিজে বিশেষজ্ঞ ড. মাইক বেকার আমাদের বলেছেন, সু চি এমনভাবে যুক্তির অবতারণা করেছেন, যাতে আইসিসিতে দায়ের হওয়া বিচারের সম্ভাব্য ফলাফলের প্রভাব থেকে মিয়ানমারকে রক্ষা করতে পারেন। সে কারণে অভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থার ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। দাবি করেছেন দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

জন প্যাকার: গণহত্যা কনভেনশনে পরিপূরক নীতির কোনো জায়গা নেই। এই যুক্তি হয়তো ব্যক্তিগতভাবে কাউকে শাস্তি দেওয়ার কর্তব্যে ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু সেটা গণহত্যা সংঘটন হতে না দেওয়া কিংবা তাকে প্রতিরোধ করতে রাষ্ট্রের যে দায়বদ্ধতা থাকে, সেটা পালন না করার দায়মুক্তি দেয় না।

প্রথম আলো: সু চি সম্পদশালী দেশগুলোতেও এমন (নিধনযজ্ঞের) ঘটে—যুক্তি দিয়ে তা বিবেচনায় নেওয়ার কথা আদালতকে বলেছেন।

জন প্যাকার: এটা হলো এমন একটা যুক্তি যে তাহলে গণহত্যা সংঘটন সত্ত্বেও মিয়ানমারকে শিথিলভাবেই দেখা উচিত। এটা আসলে তঁার দিক থেকে একটা নিচু মানের কৌশল। এতে বরং এই প্রশ্নটাই সামনে আসে যে তিনি অনুরূপ কর্ম করতে ‘সমান সার্বভৌমত্ব’ দাবি করছেন! সমান মর্যাদাসম্পন্ন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মতোই জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনে তাঁর একই ধরনের দায়মুক্তি চাই। এটা অবশ্যই একটা দুর্বল যুক্তি। এটা যেন কেউ সমুদ্রে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছে। এটা বিস্ময়কর যে সু চির আইনজীবী দল এ ধরনের যুক্তির বিষয়টিকে অনুমোদন করেছে।

প্রথম আলো: আপনি কি একমত যে দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য সু চি কিছুটা হলেও গঠনমূলক মনোভাব দেখিয়েছেন? যেমন আদালতে রোহিঙ্গাদের স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া ও তাদের খেলার মাঠের ছবি দেখানো হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি কি একটি ঐক্যের ইচ্ছা দেখাচ্ছেন?

জন প্যাকার: তাঁর এই আচরণ একেবারেই অর্থহীন (ননসেন্স)। এর কারণ, মিয়ানমার তার রাষ্ট্রীয় নীতি ও আইন এমনভাবে তৈরি করছে, যাতে এটা পরিষ্কার যে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে দেশটির নীতি বৈষম্যমূলক। সব ধরনের পদ্ধতিগত মানবাধিকারের লঙ্ঘন তারা আইনের মাধ্যমেই করে চলেছে। রোহিঙ্গাদের ৮০ ভাগ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর সেই জনগোষ্ঠীর মানুষ বর্তমানে সুখী জীবনযাপন করছে—এটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের এই গণহত্যামূলক দৃষ্টিভঙ্গি আদালত নিশ্চয়ই মূল্যায়ন করবেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা তার একটা বিহিত দেখতে পাব।

প্রথম আলো: ঘনিষ্ঠভাবে যাচাই করলে হয়তো দেখা যাবে যে সু চি যে দাবি করছেন, তা বাস্তবতা থেকে দূরে। আদালত কি এ বিষয়ে একটা সরেজমিন রিপোর্ট চাইতে পারেন? আগামী শুনানির আগে ‘অন্যান্য পন্থা’ অবলম্বনে আদালতের সামনে কি বিকল্প রয়েছে?

জন প্যাকার: এখন আদালতের উচিত হবে দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়া। কারণ, রোহিঙ্গাদের অপূরণীয় ক্ষতির ঝুঁকি এড়াতে অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। আর অবশিষ্ট বিষয়গুলো বিচার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে। হ্যাঁ, আদালত অবশ্যই অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ হিসেবে রাখাইন পরিস্থিতির বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট প্রতিবেদন আশা করতে পারে।

প্রথম আলো: ধরা যাক, আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপে গাম্বিয়া সন্তুষ্ট হতে পারল না। তখন?

জন প্যাকার: গাম্বিয়ার জন্য এটা একটা একক সুবিধা। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে অন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলো তাদের নিজস্ব আবেদন নিয়ে আদালতে আসতে পারবে না। অন্য রাষ্ট্রগুলোর তরফেও আদালতের কাছে ভিন্ন মামলা ও ভিন্ন ধরনের সাময়িক প্রতিকারের দরখাস্ত নিয়ে আসা সম্ভব। যদিও আমি বিশ্বাস করি, এমন কিছুর সম্ভাবনা কম। তদুপরি আমি বলব, এর উত্তর কী হবে, সেটা নির্ভর করে অনেকটাই আদালত কী সিদ্ধান্ত নেন তার ওপর। রাষ্ট্রগুলো বিশ্বাস করে কি না যে আদালতের নেওয়া পদক্ষেপের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ১৯৫৬ সাল থেকে মিয়ানমার জেনেভা কনভেনশনের পক্ষ। তারা একটা দীর্ঘ সময় ধরে কনভেনশন লঙ্ঘন বা তাকে বিচ্যুত হতে দিয়েছে। তাই অন্য কোনো রাষ্ট্র একক কিংবা যৌথভাবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নতুন আবেদন দায়ের করতে পারে। আর এটাও সত্য যে শুধু রোহিঙ্গা নয়, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অন্যান্য গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও তারা জেনোসাইড কনভেনশনের লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ আছে।

প্রথম আলো: কেন এবং কীভাবে গাম্বিয়া এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হলো?

জন প্যাকার: এটা আসলে অনেকগুলো ঘটনার সংমিশ্রণে ঘটেছে। ওআইসি দীর্ঘদিন বিষয়টিকে একই বিবেচনায় রেখেছিল, তার মধ্যে হতাশা এসেছিল। গাম্বিয়াতেও ইতিমধ্যে রাজনীতি এবং সরকারে পরিবর্তন এসেছে। গাম্বিয়ার যিনি বিচারমন্ত্রী, তিনি রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ছিলেন। তখন থেকে তাঁর সঙ্গে অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইনজীবীর একটা সংশ্লিষ্টতা ঘটেছিল এবং এ ক্ষেত্রে একটা ব্যবস্থা নেওয়া হোক, সে বিষয়ে অন্য অনেকেরই অভিপ্রায় ছিল অভিন্ন। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রয়েছেন এবং এই মামলা এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগানও ছিল। এটা তাৎপর্যপূর্ণ এবং একটি নজিরবিহীন ঘটনা যে গাম্বিয়া কেবল জনস্বার্থ এবং জেনোসাইড কনভেনশনের একটি পক্ষ হিসেবে এই মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা অবিস্মরণীয় এবং অভিনন্দনযোগ্য। এবং একই সঙ্গে এটা এই প্রশ্নও সামনে এনেছে যে কেন অন্যরা যাদের সামর্থ্য রয়েছে, তারা সামনে নেই? এসব দেশের মধ্যে আমি কানাডার কথাও বলব, কারণ কানাডা ঘোষণা করেছে যে রোহিঙ্গা গণহত্যা ঘটেছে। কিন্তু তারপরও এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অটোয়া।

প্রথম আলো: গায়ে ডাচ পতাকা জড়িয়ে, সু চি দ্য হেগে গেলেন, গেলেন অভিযুক্ত রাষ্ট্রের এজেন্ট হিসেবে। বলা হয়েছিল, তিনি ডাচ পার্লামেন্টে বক্তব্য দেবেন।

জন প্যাকার: আইসিজেতে দায়ের করা মামলা হয়েছে মিয়ানমার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং এটা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। অং সান সু চি মিয়ানমারের ডিফ্যাক্টো সরকারপ্রধান, যদিও রাষ্ট্রপ্রধান নন। এবং এখন পর্যন্ত তিনি এমন একটা আইনগত প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন, যেখানে তাঁর অংশগ্রহণ করতে তাঁর একটা স্বাভাবিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর সর্বোপরি এটা এমন একটা পর্ব, যেখানে শান্তিপূর্ণভাবে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাই এটি একটি স্বাভাবিক সৌজন্য বিনিময়।

প্রথম আলো: তবে শেষ পর্যন্ত ‘অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের’ কারণে ডাচ পার্লামেন্টে তাঁর সফর বাতিল হয়েছে। আপনি এই মুহূর্তে বার্সেলোনায় রয়েছেন, সেখানে বসে আপনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের জনগণের মধ্যে কী ধরনের অনুভূতি অনুমান করতে পারছেন?

জন প্যাকার: বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর এবং লোকজনের সঙ্গে কথা বলে, বিশেষ করে অনেক অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞই বলছেন, কোনো সন্দেহ নেই যে উদ্বোধনী শুনানি পর্বে অং সান সু চি এবং মিয়ানমারের অবস্থান ধূলিসাৎ হয়েছে। শুনানিতে তাদের যুক্তিগুলো যে কতটা রুগ্ণ এবং দুর্বল, তা প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে।

প্রথম আলো: এর আগে শুরু হওয়া আইসিসি মামলার কী হবে?

জন প্যাকার: আইসিসির অনুসন্ধানের অধিক্ষেত্র, একেবারেই ভিন্ন একটি বিষয়। আইসিসি কাজ করছে জেনেভায় এবং সেটা তার গতিতে এগিয়ে যাবে। আইসিসি নজর দিচ্ছে অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর। আইসিজের মামলা শুধুই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। যদিও এ দুটি বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা কিন্তু এখানে আবার একটা সাযুজ্য রয়েছে। কিছু বিষয়কে পরিপূরক হিসেবে দেখা হতে পারে এবং যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ আইসিসিতে সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেগুলো আইসিসিতে দায়ের করা মামলার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে।

প্রথম আলো: মামলা বিচারাধীন থাকতে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সম্পর্ক কীভাবে আশা করেন? আপনি কি মনে করেন রোহিঙ্গাদের আরেক আশ্রয়দাতা ড. মাহাথির মোহাম্মদের মালয়েশিয়া কি এই মামলায় যুক্ত হতে পারে?

জন প্যাকার: অবশ্যই এই সম্ভাবনা রয়েছে যে আইসিসিতে বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া আলাদাভাবে কিংবা যৌথভাবে জেনোসাইড কনভেনশনের অধীনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দায়ের করতে পারে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া প্রত্যক্ষভাবে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। সুতরাং তাদের দিক থেকে মামলা দায়েরের বিষয়টি আমার বিবেচনায় অত্যন্ত প্রত্যাশিত। আমি মনে করি, তাদের কাছ থেকে আদালতে আবেদন এলে তাতে অনেক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। যেমন যদি দুই দেশ যৌথভাবে এগিয়ে আসে, তাহলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বড় করে তুলে ধরা যেতে পারে। উপরন্তু তাদের অংশগ্রহণে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি হবে।

তবে যেটা আমি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি, তা হলো অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উচিত এই মামলায় আবেদনকারী হিসেবে যুক্ত হওয়া। এর ফলে এটা পরিষ্কার হবে যে এটা একটা সাধারণ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়, এটা ধর্ম কিংবা প্রত্যক্ষ কোনো স্বার্থ দ্বারা তাড়িত নয়। কানাডা এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে। সম্ভবত বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকেও বিভিন্ন রাষ্ট্র যোগ দিতে পারে কানাডার সঙ্গে। আর এটা তখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রায় ও আদেশ বাস্তবায়নে সহায়ক হতে পারে।

প্রথম আলো: জেনোসাইড কনভেনশনের কয়েকটি অনুচ্ছেদ বিষয়ে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ আপত্তি জানিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশ কী করতে পারে? আপনি কি মনে করেন যে গাম্বিয়ার মামলা চলতে থাকবে আর ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মিয়ানমারেরর নেতাদের সঙ্গে ভালো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক চালিয়ে যেতে পারে?

জন প্যাকার: মামলার প্রতিপাদ্য হচ্ছে এটা প্রতিষ্ঠা করা যে জেনোসাইড কনভেনশনের অধীনে মিয়ানমার কোনো একটা বিধানও লঙ্ঘন করেছে কি না। আর এ কারণে কোনো একটা সমাধানে পৌঁছাতে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের সহযোগিতা গড়া কোনো বাধা নয়। বরং বিপরীতক্রমে, মিয়ানমারকে অবশ্যই যেকোনোভাবেই হোক না কেন, রোহিঙ্গা জনগণের প্রতি তার অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে এবং বাংলাদেশকে সেই পথে প্রকৃত এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালনে মিয়ানমারকে সহযোগিতা দিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মামলা সেই পথে মিয়ানমারকে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে।

সাক্ষাৎকারের ইংরেজি ভাষ্য পড়ুন: en.prothomalo.com