নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রতিবাদের পরিণতি কী?

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও রেল অবরোধ, বিভিন্ন রেল ও বাসস্টেশনে হামলা, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ট্রেন। ফাইল ছবি
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও রেল অবরোধ, বিভিন্ন রেল ও বাসস্টেশনে হামলা, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ট্রেন। ফাইল ছবি

ভারতের অন্তত তিনজন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাঁরা নিজ নিজ রাজ্যে নতুন নাগরিকত্ব আইন (ক্যাব) বাস্তবায়ন করতে চান না। এ রকম রাজ্যের তালিকা হয়তো আরও বাড়বে।

এই প্রতিবাদীদের মধ্যে সবচেয়ে সোচ্চার পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘ক্যাব’ নামে পরিচিত নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বড় আকারে সহিংস বিক্ষোভ হয়েছে আসাম, ত্রিপুরা, কেরালা, মহারাষ্ট্র ও নয়াদিল্লিতে। অন্যান্য প্রদেশেও নানাভাবে প্রতিবাদে শামিল হচ্ছে বিজেপিবিরোধী শক্তি। তাদের কথা, এই আইন সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করছে। ‘বহুত্ববাদী ভারত’কে ফেরত চাইছে তারা। বিস্ময়করভাবে তরুণ-তরুণীদেরই এসব মিছিলে বেশি দেখা যাচ্ছে।

এর মাঝেই লোকসভা, রাজ্যসভায় অনুমোদনের পর দেশের রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে গেছে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীগুলো। বিরোধীরা অবশ্য হাল ছাড়তে নারাজ। তারা এবার উচ্চ আদালতে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা থেকেও এই আইন নিয়ে আপত্তি তুলে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে; যা এক বিরল ঘটনা। কিন্তু আদৌ এই আইনের বাস্তবায়ন ঠেকানো সম্ভব কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে ইতিমধ্যে।

ক্যাব ও উচ্চ আদালতের এখতিয়ার

প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দের স্বাক্ষরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে অনেকগুলো আবেদন পড়ে গেছে। রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি গবেষক, সাংবাদিক অনেকে এই আইনের ন্যায্যতার বিষয়ে আদালতের মতামত প্রত্যাশী। বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করে যাওয়া কূটনীতিবিদ দেব মুখার্জিও এ রকম আবেদনকারীদের মাঝে রয়েছেন। তাঁদের সাধারণ অভিমত, লোকসভা ও রাজ্যসভা অনুমোদন করলেও এই আইন দেশের সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশেষ বিশেষ ধর্ম পরিচয়কে নাগরিকত্বের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা বৈষম্যমূলক এবং ভারতীয় সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে এই সংক্ষুব্ধদের দাবি। এ অবস্থায় উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ চান তাঁরা।

ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৪ বলছে, আইনের চোখে সকলে সমান। এখন ক্যাব এবং ওই অনুচ্ছেদ সাংঘর্ষিক হয়েছে কি না সেটাই দেখার বিষয়। সংক্ষুব্ধদের সব আবেদন আদালত হয়তো একসঙ্গেই বিবেচনা করবেন। যার শুনানি শুরু হতে পারে আগামী সপ্তাহ থেকে। সরকারের পক্ষে ৮৮ বছর বয়সী অ্যাটর্নি জেনারেল বেণু গোপালও প্রস্তুত হচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ এই মামলা লড়তে।

প্রদেশগুলো কী ক্যাব মানতে বাধ্য?

যেসব রাজনীতিবিদ ক্যাবের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে গিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা মহুয়া মৈত্রও। এই দলের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে কেবল নাগরিকত্ব আইনই নয়—এনআরসিও ঠেকাতে প্রতিশ্রুত। তাঁর স্লোগান: ‘নো এনআরসি নো ক্যাব’। প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের সেই অধিকার আছে কি না। কিংবা কেরালা বা পাঞ্জাব কী তা করতে পারে? যেমনটি বলছেন, মমতার মতোই কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন ও পাঞ্জাবের অমরিন্দর সিং।

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে নাগরিকত্বের বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারভুক্ত। নাগরিকত্বকে সংবিধানের সপ্তম তফসিলের বিষয় হিসেবে রাখা আছে—যে বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এককভাবে আইন করতে পারে। রাজ্যের এতে আলাদা অবস্থানের সুযোগ নেই। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা এ ক্ষেত্রে ২৫৬ অনুচ্ছেদের কথাও জানাচ্ছেন। যেখানে রাজ্যকে কেন্দ্রের আইন অনুযায়ী চলার দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে।

তবে কেন্দ্রীয় কোনো আইনে যদি কোনো রাজ্যের আপত্তি থাকে, সেটা নিয়ে আদালতে যাওয়ার অধিকার আছে তার। রাজ্য যদি বোঝাতে পারে, কেন্দ্রীয় আইনে সমাজে বিশৃঙ্খলার শঙ্কা রয়েছে তাহলে সেটা আদালতের কাছে গ্রহণীয় হতে পারে। সংবিধানের ১৩১ নং অনুচ্ছেদে এমন সুযোগ আছে। এই অনুচ্ছেদের আলোকে সুপ্রিম কোর্টেরও সেই আপত্তি শোনা এবং মতামত দেওয়ার এখতিয়ার আছে। তবে এখনো কোনো রাজ্য সরকার ক্যাব নিয়ে সেরকম পথে যায়নি। আবার এক রাজ্যে ক্যাব অকার্যকর থাকলে অন্য রাজ্যে সেটা কার্যকর হবে কি না, এটাও এক বিবাদিত বিষয় হবে তখন।

তবে ক্যাব পরবর্তী মাঠের পরিস্থিতি আইন-আদালতের জন্য বসে নেই। ইতিমধ্যে আসামে ‘বন্‌ধ’ পালিত হয়ে গেছে, সংঘর্ষে পাঁচজন মারা গেছেন এবং কারফিউ ছিল অন্তত দুদিন। পশ্চিমবঙ্গে রেল অবরোধসহ নানান ধরনের কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। বিহারে লালু প্রসাদ যাদবের জনতা দল ২১ ডিসেম্বর বন্‌ধ ডেকেছে। সেদিন ওই রাজ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন সকলে।

ক্যাব সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস বাড়াল

ক্যাব যেমন ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্রে আঘাত হেনেছে, তেমনি এর বিরোধিতার মতাদর্শও বিচিত্র। উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্যাব বিরোধিতার সঙ্গে মধ্য ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতার চরিত্রগত ফারাক আছে। আসামে মূলত অসমিয়ারা এবং ত্রিপুরায় প্রধানত আদিবাসীরা ক্যাবের বিরোধিতা করছে তাদের অঞ্চলে বাঙালি হিন্দুদের বসতি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকে। অন্যদিকে, নয়াদিল্লি, চেন্নাই ও পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিক্ষোভ হচ্ছে ক্যাবের মুসলমান বিদ্বেষী বৈশিষ্ট্য থেকে।

বিক্ষোভ ও বিতর্ক বাড়ার মুখে, সর্বত্র এই আইন সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস ও বিভেদও বাড়াচ্ছে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে দেখা গেল, মুসলমানরা এই আইনের বিরুদ্ধে যতটা সরব বাংলাভাষী অমুসলমানরা ততটা নন। ফলে বিজেপি ক্যাবের বিরোধিতাকে সংখ্যালঘুদের ‘সাম্প্রদায়িক বিষয়’ হিসেবে চিত্রিত করছে এবং সংখ্যাগুরুকে কাছে টানার চেষ্টায় আছে। স্বভাবত ভোটের বিবেচনা মাথায় রেখে মমতা ব্যানার্জিকে ক্যাব ও এনআরসি বিরোধিতায় ভারসাম্য রাখতে হচ্ছে। মুসলমানদের ভোট তাঁর বড় পুঁজি হলেও অমুসলিমদের ভোট তিনি মোটেই অবজ্ঞা করতে পারবেন না। যে জন্য ক্যাব নিয়ে ‘অশান্তি’ বাড়াতে চাইছেন না দিদি। বরং রাজ্যে ‘শান্তি’র ডাক দিয়েছেন। অর্থাৎ পরোক্ষে মুসলমানদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ কমাতে বলছেন। বিজেপির বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রিত আন্দোলন চাইছেন তিনি।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও রেল অবরোধ, বিভিন্ন রেল ও বাসস্টেশনে হামলা, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ট্রেন।ফাইল ছবি
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও রেল অবরোধ, বিভিন্ন রেল ও বাসস্টেশনে হামলা, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ট্রেন।ফাইল ছবি

তবে ক্যাব বিরোধিতা মোটেই হিন্দু বনাম মুসলমান সমীকরণভুক্ত কোনো বিষয়ের মতো নয়। বরং এটা সেই প্রশ্ন যে, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাত বা কোনো ধর্মাবলম্বীদের অবজ্ঞা করা হবে কি না। বিজেপি সরকার ঠিক সেটাই করেছে ‘ক্যাব’-এ।

ভারতের রাজ্যে রাজ্যে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে এই যে বিভেদ ও বিভাজন দেখা যাচ্ছে, সেটা বিজেপির জন্য অত্যন্ত সুখকর একটা বিষয়ই। এই বিভেদের রাজনীতি তাকে বেশ নিরাপদ করে তুলছে এবং নিজেকে সংখ্যাগুরু অমুসলিমদের প্রাণের সংগঠন হিসেবে তুলে ধরতে সাহায্য করছে।

কিন্তু মুশকিল বেঁধেছে অন্যত্র। ক্রমে তরুণ-তরুণীরা বুঝতে পারছে এটা আসলে ধর্মের নামে এক ধরনের ভোটের রাজনীতিমাত্র। কাশ্মীর, এনআরসি, রাম মন্দিরের পর একই রাজনীতি বয়ে এনেছে ক্যাব প্রসঙ্গ। অথচ ভারতজুড়ে অর্থনীতিতে মন্দার লক্ষণ স্পষ্ট। ক্যাব অসন্তোষে অর্থনীতির ক্ষতি বাড়ছে।

সর্বশেষ জাপানের সঙ্গে বাৎসরিক সম্মেলনটি ক্যাব উত্তেজনার মুখে বাতিল করতে হয়েছে সরকারকে। ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই সম্মেলনে জাপানের প্রধানমন্ত্রী আসার কথা ছিল আসামে। ক্যাব নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ, শঙ্কা ও প্রতিবাদ কেবল জাপানের প্রতিক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই। আরও কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের আপাতত ভারত ভ্রমণ না করতে পরামর্শ দিয়েছে।

বিজেপির জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ হয়ে উঠতে পারে ক্যাব ও এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বাংলাভাষীদের মাঝে ক্যাব ও এনআরসি নিয়ে যে অস্থিরতা তার উত্তাপ ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তে লাগছে এবং সেটা উভয় দেশের অনেক দিনের ‘ভালো সম্পর্ক’কে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। ভারতজুড়ে ক্যাবপন্থীরা বাংলাদেশে ধর্মীয় নিপীড়নের কল্পিত কাহিনি ছড়িয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেভাবে ফায়দা তুলতে চাইছেন, তা চূড়ান্ত এক অনৈতিক দৃষ্টান্ত।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক