সিসিফাসের সেই গল্পের নানা ব্যাখ্যা

ছবি: ফেসবুক
ছবি: ফেসবুক

সিসিফাসের পুরাণ–কাহিনি নিয়ে আজকের লেখা। সিসিফাস বেচারা একটা পাথর খাড়া পাহাড়ের ওপরে ঠেলে তোলে, আর পাথরটা গড়িয়ে নিচে পড়ে। সে আবার পাথরটাকে ঠেলে ওপরে তোলে। যতবার তোলে, ততবার পড়ে। কিন্তু সে বিরতি দেয় না। অবিরাম এই তার একটা কাজ, পাথর ঠেলে পাহাড়ের চূড়ায় তোলা। সেটা গড়িয়ে নিচে পড়লে আবার ঠেলতে থাকা।

গ্রিক পুরাণের গল্প। হোমারের অডিসিতে আছে। ওভিদে আছে। জিউসের চেয়ে নিজেকে বেশি চালাক ভেবে সিসিফাস চালাকি করতে গিয়েছিল। তাই তার এই অভিশপ্ত জীবন।

যুগে যুগে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সিসিফাসের এই কিংবদন্তির ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

সৌরতত্ত্ব অনুসারে এটা হলো সূর্যের প্রতীক। রোজ পুব দিকে উঠে পশ্চিম দিকে অস্ত যেতে হয় সূর্যকে। বারবার। চলতেই থাকে এই কাজ। অন্য তাত্ত্বিকদের মতে, এ হলো সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা। রোজ জোয়ার আসে, কিছুক্ষণ পর আবার আসে ভাটা।

খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের দার্শনিক লুকরেটিয়াসের ব্যাখ্যা, সিসিফাস হলো সেই রাজনীতিক, যে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য চিরকাল চেষ্টা করে গেছে, কিন্তু কোনো দিনও ক্ষমতায় যেতে পারেনি। আর দার্শনিক সলোমন রিনাকের ব্যাখ্যা হলো মানুষ যে সাধনা করে, আর সিদ্ধি অর্জন করে, চেষ্টা আর উৎকর্ষের মধ্যে যে চিরকালীন পার্থক্য তা লাঘবের ব্যর্থ প্রয়াসই হলো সিসিফাসের নিয়তি।

আলবেয়ার কামু মিথ অন সিসিফাস বইয়ে এই পুরাণ–কাহিনির নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কামু বলছেন, সিসিফাস যখন পাথর ঠেলে তোলে, তখন সে হাসিমুখে সেই কাজটা করে, একটু আগে কী ঘটেছিল, একটু পরে কী ঘটবে, এটা তার ভাবনাতেই নেই। সম্প্রতি জে নিগ্রো স্যানসোনিস আরও নতুন কথা বলেছেন। বলেছেন, সিসি ফাস; এটা হলো আমাদের নাক দিয়ে প্রশ্বাস আর নিশ্বাসের শব্দ। সিসি শব্দ করে আমরা শ্বাস নিই, ফাস শব্দ করে শ্বাস ছাড়ি। সিসিফাসের কর্মটি হলো শ্বাস নেওয়া আর শ্বাস ছাড়া।

আমাদের সবার জীবনই কিন্তু এই চক্রাকারে বাঁধা। পথই আমাদের মোকাম। আমরা আসলে কোথাও পৌঁছাই না। আমাদের কাজ হলো পথচলা। আমাদের এই পথচলাতেই আনন্দ।

সিসিফাসের এই গল্পের ব্যাখ্যা এসেছে কর্মী আর কাজের সম্পর্ক বিষয়েও। কর্মীরা যখন জানে, কেন তাদের কাজ করতে হবে, তারা ভালোভাবে কাজ করে। যখন তারা জানে না কেন তারা এই কাজ করছে, তখন তারা হতাশ হয়, কাজে উৎসাহ পায় না।

আরেক জার্মান লেখক ম্যানফ্রেড কপফার বলেছেন, সিসিফাস প্রতিবার পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চূড়ার একখণ্ড পাথর কেটে নামাত। এভাবে একদিন সে পাহাড়টাকে সমান করে ফেলবে। তখন আর তার পাথর গড়িয়ে পড়বে না! বাপ রে, কত আশাবাদী মানুষ হতে পারে!

২.
আমি এত আশাবাদী হতে পারছি না।

মানুষের মতো নিষ্ঠুর প্রাণী তো আর নেই। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী একসঙ্গে লাখো মানুষকে মারতে পারে? প্রতিবছর মারে! মানুষ শুধু মানুষকে মারে না, এই পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করে ফেলার মতো বোমা সে বানিয়ে রেখেছে।

তবু আমাদের ভালোবাসার কথা বলে যেতে হবে। আমরা জানি, এই ‘ভালোবাসো, অন্তর থেকে বিদ্বেষবিষ নাশো’, এই কথা বলে কোনো লাভ নেই। যাদের মারার, তারা মেরেই যাবে। তবু বলতে হবে। একই কথা আমরা বারবার বলি। একই কাজ আমরা প্রতিদিন করি।


মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারের তালিকা বিতর্ক থেকে আমার সিসিফাসের কথা মনে পড়ছে। আমরা প্রতিদিন কষ্ট করে পাথর ঠেলে ওপরে তুলি, প্রতিবারই তা পড়ে যায়। ৪৮ বছর ধরে এই করছি। রাজাকারের তালিকা যদি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের ফাইলে পাওয়া যায়, তাতেও ভুল থাকবে। তারা যাদের নাম তালিকাভুক্ত করেছিল, তাদের সবাই রাজাকারি করেছে তা তো নয়। খোদ অস্ত্র পাওয়া, বেতন পাওয়া রাজাকাররাও অস্ত্রসমেত পালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দিয়েছিল, এমন তো কতই ঘটেছে। আর পাকিস্তানি প্রশাসন একাত্তরে রাজাকারের তালিকা বানিয়ে তাতে হিন্দুদেরও রেখে বলবে, এই তালিকা করে দিলাম, সবাই শান্তি রক্ষা করো, এটা তো হতেই পারে। তার মানে এই না যে যাদের নাম ওঠানো হলো, তারা সবাই রাজাকার হয়ে গেল। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন অনেক রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন একই ছাত্রের নাম তাদের কমিটিতে রেখে কমিটি ঘোষণা করত, এক ছাত্রকে নিয়ে সবাই টানাটানি করত। এই কমিটির তালিকা দেখে বোঝা যাবে না যে ছেলেটি আসলে কোনো দল করত কি না, করলে শেষ পর্যন্ত কোনটা করেছিল।

আর এটা যদি ’৭২-এ প্রস্তুত করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা হয়ে থাকে, তাহলে চিন্তার কথা। প্রথম চিন্তা, সেই তালিকার সোর্স কী, গঠনপদ্ধতি কী। সেটাও কি পাকিস্তানি দলিল থেকে নেওয়া নাকি স্থানীয় থানা কর্তৃক গঠিত। যা-ই হোক না কেন, তাতে ভুল থাকবে, কারণ, প্রতিহিংসা, পূর্বশত্রুতাবশত আমরা অনেক কিছু করে থাকি।

আরেকটা কথা। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীর নাম রাজাকারের তালিকায় থাকবে না। কারণ, রাজাকারটা ছিল মাসোহারা পাওয়া গরিব মানুষের একটা বাহিনী, যাদের হাতে অস্ত্র ছিল, যারা ভিডিপি–আনসারের মতো গ্রামের ব্রিজ পাহারা দিত। এমনকি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো রাঘববোয়ালদের বাড়ি পাহারা দিত। কাজেই সেখানে ধেঁড়েগুলোর নাম থাকবে না।


কিন্তু আলবেয়ার কামুর ব্যাখ্যাটা আমার পছন্দ হয়েছে, পাথর গড়িয়ে পড়বে জেনেও সিসিফাস হাসিমুখে প্রতিবার পাথর ঠেলত। আমাদেরও পাথর ঠেলে যেতে হবে এবং তা গড়িয়ে পড়বে, তবু ঠেলতে হবে এবং তবু হাসতে হবে।

আমাদের উদ্দেশ্যটা সৎ কি না, এটা হলো আসল।

কিন্তু সিসিফাসের ভাগ্য তো করুণ। করুণাই হয় তার জন্য। আমাদের নিয়তি করুণ। আমাদের জন্যও আমাদের নিজেদেরই করুণা করতে হবে।


পুরান ঢাকার রসিক মানুষটাকে যদি সিসিফাসের কাহিনির ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়, তিনি বলবেন, ‘আরে, আমি সাবাসি দিই সেই মুরগাটারে, যে এত বড় একটা পাথরের ডিম পাড়ছে। সিসিফাস হালায় তো মজা পাইতাছে, হালায় খায়া না খায়া পাথর তুলে আর পাথর ভি ফেলে, কিন্তু এই পাথরের বলটার কথা ভাবেন, কেমুন গড়ানি খাইতাছে, হালার জীবনই ভি একখান।’

আমাদের জীবন তো আসলে সিসিফাসের জীবন না। আমাদের জীবন হলো এই পাথরের জীবন। যাকে নিয়ে বিরাট শিশু তোলা আর ফেলার খেলা খেলছে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক