ভিপি নূরের পাওয়ারহাউসের গল্প

তারা ভেঙে পড়ছে না, আবার সাধ্যের বাইরে গিয়ে নিজেদের আগাম বিনাশও ডেকে আনছে না। ছবি: প্রথম আলো
তারা ভেঙে পড়ছে না, আবার সাধ্যের বাইরে গিয়ে নিজেদের আগাম বিনাশও ডেকে আনছে না। ছবি: প্রথম আলো

ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নূর বারবার নির্যাতিত হয়েও অপরাজিত। শত মার খেয়েও যে ময়দানে খাড়া থাকে, তাকে পরাজিত বলা যাবে না। বারবার নির্যাতিত হয়েও নূরের এই দাঁড়িয়ে থাকাটা অবশ্যই একটা ঘটনা। তার পরও নূর নিজে না যত বড় ঘটনা, তারচে বড় তিনি যে পাওয়ারহাউস থেকে শক্তি পান সেটা। প্রতিপক্ষ যা–ই বলুক, নুরের এই পাওয়ারহাউস জামায়াত-শিবির বা বিএনপি বা কারও মাসোহারা না। এই পাওয়ারহাউস বাংলাদেশের মহানগরী ও ক্ষমতার তাপের পাশে হাজির হওয়া উদীয়মান নতুন মধ্য শ্রেণি। চলনে-বলনে কেতাদুরস্ত না হয়েও নূর তাঁর সাধারণ স্বাভাবিকতা নিয়ে তাঁদের কাছে চলে যেতে পেরেছেন, যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ।

এই ঘটনার মধ্যে নূর একা নন। তাঁর মতো একদল ছেলেমেয়ের মনের জোরে ভর করে নূর আজ বড় ছাত্রনেতা। ব্যক্তি নূর কতদূর যাবেন তা এখনই বলা যায় না। তবে এই গুচ্ছের ছেলেমেয়েরা অনেকদূর যাবে। কারণটা সহজ ও পরিষ্কার। যখন রাজনীতি জনগণের বড় অংশের প্রতিনিধি হতে ব্যর্থ, তখন এঁরা সমাজের একটা মৌলিক ভিত্তিকে প্রতিনিধিত্ব করা শুরু করেছে। এরা নিম্ন ও উঠতি মধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে এসে সেই শ্রেণীকেই প্রতিনিধিত্ব করতে চাইছে।

নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত যাদের পাশে, তারাই জয়ী হয়।

গত দুই দশকের যা কিছু অর্থনৈতিক বিকাশ, তা এই উঠতি মধ্যশ্রেণিটাকে তৈরি করেছে। এই শ্রেণীর সন্তানেরা বাবার ছোট ব্যবসা বা চাকরি, প্রবাসী বড় ভাইয়ের পাঠানো টাকায় খামার, নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এখানে এসেছেন। এঁরা আরও সামনে যেতে চান। এগোতে গিয়ে দেখেন বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি পাওয়া ছাড়া তাঁদের জন্য তেমন বড় সুযোগ নেই। তারপর বিসিএস দিতে গিয়ে দেখেন, হরেক রকমের কোটায় তাদের সেই সুযোগের মোয়া আধখাওয়া হয়ে আছে। তখন তাঁরা সরকারি চাকরিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। এভাবে নিজেদের জন্য রাস্তা খুলতে গিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিষ্ঠার রাস্তাটাকে তাঁরা আরও চওড়া করে রেখে যান। এঁরাই আবার দাঁড়ান বেসরকারি উচ্চশিক্ষায় সরকারের ভ্যাট আরোপের বিরুদ্ধে। তাঁদের শ্রেণি থেকে আসা তাঁদেরই ভাইবোনেরা সড়কে নিরাপত্তা আন্দোলনে নেমে ইতিহাস সৃষ্টি করে। কোনো ঘটনা যদি পরপর তিনবার ঘটে এবং তারপরেও টিকে থাকে, তাহলে ভাবতে হবে ঐ ঘটনার শেকড় অনেক গভীরে। গত কয়েক বছরে যে নির্দলীয় ছাত্র অধিকার আন্দোলন চলে আসছে, তার শেকড় অবশ্যই সমাজের গভীরে। সেই গভীরে হাত রাখলে পাওয়া যাবে নতুন ঐ মধ্যশ্রেণীটাকে।

এঁদের জীবনীশক্তি কম না। স্বার্থের আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁরা দেখেন তাঁদের নেতা নেই। ডান-বাম কারও প্রতি টান নেই যাঁদের, সেসব ‘সাধারণ’ ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এঁদের থেকে নির্বাচিত করেন তাঁদের নেতা নুরুল হককে। জীবিকার জন্য যে পথে তাঁরা নেমেছিলেন সেই পথ তখন গিয়ে মেশে রাজনীতির সড়কে। তারপর থেকে দেশে যা কিছু প্রতিবাদ, সম্ভাবনা, সাহসিকতা—সবকিছু তাঁদের ঘিরেই ঘটে চলেছে। যে সময়ে যে কথা বলা দরকার, নুরুরা সেই সময়ে সেই কথাটা বলছেন। তাঁদের কথার দাম তাঁরা দিচ্ছেন বারবার নির্যাতিত হয়ে। নির্যাতনকারীরা এভাবে চিনিয়ে দিচ্ছে নতুন দিনের রাজনীতি কোথায় দানা বাঁধছে। মানুষ দেখছে এবং নির্যাতিতর প্রতি ভালবাসা জানাচ্ছে, তাদের সাহসকে বিশ্বাস করছে।

এই তরুণেরা তাঁদের পরিবারের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ ও সবেমাত্র আশা। এঁদের পিতামাতা প্রায় কৃষক হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষের জীবনের খবর তারা রাখতে পারে। কৃষকের মতোই বাধ্য হলে এরা পায়ে ধরবে আবার সুযোগ পেলে শ্রেণিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার জ্বলুনিতে প্রতিবাদে নামবে। এঁদের হারানো অসম্ভব, কারণ এঁরা শুধু সংখ্যায় অসংখ্যই না, খেলার নিয়মও তারা শিখে ফেলেছে। তারা ভেঙে পড়ছে না, আবার সাধ্যের বাইরে গিয়ে নিজেদের আগাম বিনাশও ডেকে আনছে না।

নুর ব্যক্তি হিসেবে কে কী কেমন, তারচে বড় তিনি যাঁদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা বিরাট, বিপুল ও সংগ্রামী মনোভাবসম্পন্ন। নুর একটা নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের প্রতীক। বিএনপি বা জামায়াত বা বামেরা একে ধারণ এখনো করতে পারছে না। তারাও যে পুরোনো রাজনৈতিক বর্গের মধ্যে ঢুকবে, তেমনটা মনে হচ্ছে না। সুতরাং দলীয়ভাবে একে দেখা যাবে না।

নুর চলে গেলেও এই শ্রেণি থেকে আরও কর্মী-নেতা আসবেন। এঁরাই বাংলাদেশের আশা। পুরোনো মধ্যবিত্তকে পরাজিত করেছে উঠতি বড়লোকেরা ও তাদের দুর্বৃত্ততান্ত্রিক রাজনীতি। স্বদেশে এই মধ্যবিত্ত আর ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না। তারা পলায়িত ও দিশাহীন। বরং নুরুর শ্রেণির পরিবারগুলো নিচ্ছে সেই জায়গা, যা ষাটের বা আশির দশকের মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিয়েছিল। এদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাই এদের উঠতি মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি বানাচ্ছে। ব্যক্তি নূরের জায়গায় তাঁর শ্রেণি থেকে আরও আরও নেতার জোগান আসবেই।

এঁদের যোগ্যতাও কম না। এঁরা লেগে থাকতে জানেন, যেমন সন্তানের পেছনে লেগে থাকেন নিম্নবিত্ত পিতা। এঁরা সংগঠন-জমায়েতে সহজ গলায় কথা বলতে পারেন, এঁরা মানুষের ভাষাটা বোঝেন। এরা হাইড্রার মতো, একদিকে বাধা পেলে আরেক দিকে মাথা তোলেন।

পুরোনো রাজনীতির নায়ক-মহানায়কেরা অনেক যোগ্যতা নিয়েও ফেল মারছেন, কারণ তাঁরা সময়ের প্রতিনিধি না, তাঁরা কেবল নিজের প্রতিনিধি।

ঠিক এঁরাই ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, গ্রাম-মফস্বল থেকে এসে। বাংলাদেশে যাঁরা নেতা হতে চান, রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে চান, তাঁদের নুরের গোষ্ঠীকে টার্গেট করা উচিত। যেটুকু শিক্ষা নেতৃত্বের জন্য দরকার, যেটুকু বিত্ত জীবন চালাতে প্রয়োজন এবং যেই বয়স বড় কাজে নামার জন্য জরুরি—তার সবই এঁদের আছে।

এ রকম আরেকটা মুহূর্ত এই জাতির জীবনে এসেছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তারপর কোরীয় যুদ্ধের সময় এ দেশের পাটের চাহিদা বেড়ে গেল। পাটচাষিরা একটু পয়সা পেলেন। বাড়ির চালে টিন আর ছেলেটাকে স্কুলে পাঠানোর সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে তাঁরা শেরেবাংলার নেতৃত্বে জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। তাঁদের ছেলেরাই আরও শিক্ষিত হতে এবং শ্রেণি উত্তরণ ঘটাতে ঢাকা ও রাজশাহীর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলো। এঁরাই পরে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত লড়াই করলো। নতুন পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়ন আমাদের আবার সেই সুযোগ ও সংকটের দোলায় দোলাচ্ছে।

৯০-এর পরে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক গতিশীলতা বেড়েছে। দরিদ্র শ্রেণি থেকে চাকরি-ব্যবসা-প্রবাসে কাজ ইত্যাদি করে উঠে এসেছে লাখো পরিবার। এরা সাবেক শহুরে মধ্যবিত্তের মতো আত্মকেন্দ্রিক ও বিচ্ছিন্ন না। এদের গায়ে গ্রামের গন্ধের সঙ্গে সামাজিকতার চুম্বক লেগে আছে। বিদেশমুখী হওয়ার কায়দা এদের এখনো আয়ত্ত হয়নি। ফলে দেশ ও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে তারা বাধ্য। ভাবতে গিয়ে নতুন এই শ্রেণি বাকিদের সঙ্গে যোগসূত্র গড়বে।

এভাবে আরেকটা ইতিহাস শুরু হচ্ছে। এই ইতিহাস নো-ভ্যাট, কোটা সংস্কার, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ মুভমেন্ট দিয়ে সামনে এগোচ্ছে। ময়দানে একমাত্র যাঁরা দাঁড়িয়ে, যাঁরা দানা বাঁধছেন, যাঁরা তৎপর, তাঁরা এই নূরেরা। এ জন্যই এঁদের ওপর আক্রমণ বেশি।

মনে রাখা ভালো, এঁরা মার খেলে বাংলাদেশ মার খায়, সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধ মার খায়। এই নুর মারা গেলেও আরও নূর আসবেন। এটাই সায়েন্স। এই নুর টিকলে আরও নূর জ্বলবে, সেটাই মানুষ।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]