নতুন পাঠক্রম: শিশুদের মধ্যে অনৈতিকতা বাড়াতে পারে

ফাইল ছবি, প্রথম আলো
ফাইল ছবি, প্রথম আলো

এবারই প্রথম প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একযোগে শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের যজ্ঞ শুরু হচ্ছে। বিরাট মহাযজ্ঞ। যে চার দলিলের ভিত্তিতে এই নতুন কারিকুলাম দাঁড় করানো হচ্ছে, তার গোড়াতেই বড় গলদ। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে পষ্টাপষ্টি বলা আছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে আট বছর মেয়াদি। অর্থাৎ, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু গত এক দশকে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখিনি, যা প্রমাণ করে যে সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক না। প্রাথমিক শিক্ষা সেই পঞ্চম শ্রেণিতেই আটকে আছে। আইনি জটিলতা, অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষকের যোগ্যতা, মর্যাদা ও বেতন স্কেল ঠিক করা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষক নিয়োগ, কারিকুলাম তৈরি, পাঠ্যপুস্তক লেখা, গোটা ব্যবস্থা নজরদারি—এসব কোনো বিষয়েই সরকার কোনোই পদক্ষেপ নেয়নি। তার সোজাসাপ্টা মানে দাঁড়ায়, এ বিষয়ে সরকারের কোনো আন্তরিক অঙ্গীকার নেই, যা আছে তা কেবলই লোক–ভুলানো কথামালা। প্রস্তাবিত কারিকুলামে প্রাথমিক ও জেএসসি পরীক্ষার বিধান অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার অঙ্গীকারের সরাসরি লঙ্ঘন।

এই শিক্ষানীতি নিয়েও কম বিতর্ক ওঠেনি। যাঁরা এ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তাঁর অভিযোগ, পঞ্চম শ্রেণিতে প্রাথমিক সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণিতে জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা গ্রহণের কোনো সুপারিশ তাঁরা করেননি। কে বা কারা এই দুই সর্বনাশা পরীক্ষা জাতীয় শিক্ষানীতিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, তা এক বড় রহস্য। ওদিকে দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষাবিজ্ঞানী এই দুই পরীক্ষার প্রবল বিরোধী। তাঁরা এই দুই সর্বনাশা পরীক্ষা বন্ধের জন্য অনেক আন্দোলন ও আদালতে মামলা করেও পরিত্রাণ পাননি।

প্রাথমিক সমাপনী ও জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা আমাদের সন্তানদের কৈশোরিক সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে, ধ্বংস করছে শিশুর সৃজনী ও উদ্ভাবনী সম্ভাবনাও। শৃঙ্খলা ভঙ্গ, দুর্নীতি ও অনৈতিক আচরণে শিশুদের অভ্যস্থ করে তুলছে। শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ছিদ্দিকুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে (প্রথম আলো, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৯)। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, এই দুই পরীক্ষা সেই মূল্যবোধ শিক্ষা ও চর্চার পথ বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, শিক্ষার মূল লক্ষ্য থেকে এ এক চরম বিচ্যুতি। এই দুই পরীক্ষা রমরমা কোচিংয়ের বিস্তার ঘটিয়েছে, নোট ও গাইড–বাণিজ্যের সদর দরজা খুলে দিয়েছে। এই দুই পরীক্ষার ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হলেও সরকার তা গ্রাহ্যই করছে না। উল্টো প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপনের জন্য সরকারের উদ্যোগ-আয়োজনের ঢাক বাজছে এখন।

নতুন কারিকুলাম প্রণয়নে আরও একটি বিষয় সবার নজর কেড়েছে। তা হলো, দুই বছরের প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষা চালু। এ পরিকল্পনায় বলা হচ্ছে, শিশুর বয়স চার বছর হলে সে স্কুলে যাবে এবং দুই বছর তাকে প্রাক্‌-প্রাথমিকে পাঠ নিতে হবে। চালু নিয়মে শিশুর বয়স পাঁচ পেরোলে তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয় এবং প্রাক্‌-প্রাথমিক এখন এক বছর। নতুন নিয়ম চালু হলে শিশুর ওপর মানসিক চাপ আরও বাড়বে। বাড়বে অভিভাবকের খরচও। আমাদের স্কুলগুলো শিশুবান্ধব হয়ে ওঠেনি। শিক্ষক–স্বল্পতা প্রকট। অবকাঠামোর সুবিধা খুবই সীমিত। শিশুদের জন্য আনন্দ-বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। নেই আধুনিক অন্যান্য সুবিধাও। এমন পরিস্থিতিতে চার বছর বয়সী শিশুকে স্কুলে নিয়ে নির্যাতনের এক নতুন রাস্তাই খুলে দেওয়া হবে মাত্র। ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হবে। তারা শিকার হবে মনোবিকারের।

নতুন কারিকুলাম পরিকল্পনায় ‘কীভাবে শিখতে হয়’, তারচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ‘কী শিখতে হবে’। অর্থাৎ, ‘পদ্ধতি’র চেয়ে ‘বিষয়বস্তু’র ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটি শিক্ষার মৌলিক দর্শনের পরিপন্থী।

খবরে বলা হচ্ছে, প্রাথমিক স্তরেও বর্তমান চাহিদার ওপর ভিত্তি করে কারিকুলামে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়ক এমন বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পাঠ্যবইয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জঙ্গিবাদ, নিরাপত্তা বিষয়গুলো যুক্ত করা হবে (সমকাল, ২৯ নভেম্বর, ২০১৯)। ইদানীং বাংলাদেশে নতুন এক জাতের বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব ঘটেছে। তাঁরা যেকোনো সমস্যার সহজ সমাধানে শিশুদের পাঠ্যবইয়ে তা অন্তর্ভুক্তির নিদান দিয়ে থাকেন। এ নিদানে আমাদের শিশুরা বই আর বাহুল্য সিলেবাসের লৌহকারায় বন্দী হচ্ছে দিন দিন। যাঁরা এসব বলেন, শিক্ষাবিদ তাঁরা নন; কিন্তু সব সমস্যার সমাধান শিশুদের কাঁধে চাপিয়ে নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে তাঁদের জুড়ি নেই। বড়দের সৃষ্টি করা সমস্যা সমাধানের দায় শিশুদের ওপর চাপানো রীতিমতো অন্যায়। তাঁরা ভুলিয়ে দিতে চান সুশাসন এবং সুবিচারের অভাবই সব অপরাধের আঁতুড়ঘর।

তত্ত্বগতভাবে স্কুলে ধারাবাহিক মূল্যায়ন একটি উত্তম ব্যবস্থা; কিন্তু সে জন্য কয়েকটি আবশ্যকীয় শর্ত পূরণ হতে হবে। প্রথমত, শিক্ষককে ধারাবাহিক মূল্যায়নে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ১ অনুপাত ২০-এ সীমিত রাখা, শিক্ষকের কাজের চাপ কম রাখা, শিক্ষার্থীর আবেগ, রুচি ও ঝোঁকের ওপর নজর রাখা, দুর্বল শিক্ষার্থীর জন্য নিরাময়মূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, নিয়মিত নথি সংরক্ষণ ইত্যাদি জরুরি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হয়। আমাদের দেশে রাজনৈতিক মাস্তানি, সামাজিক অসহিষ্ণুতা যে হারে বাড়ছে, তাতে এ পদ্ধতি কোনো সুফল দেবে বলে আশা করা বৃথা। শিক্ষকের মর্যাদা নিশ্চিত না করা গেলে এ পদ্ধতি ভেস্তে যেতে বাধ্য। রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক না হলে, ভিন্নমতের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে এ পদ্ধতি বিপর্যয় ডেকে আনবেই। এ পদ্ধতি সবচেয়ে ক্ষতি করবে সমাজের পিছিয়ে পড়া দুর্বল জনগোষ্ঠীকে।

ইতিমধ্যে যেসব বিষয়ে স্কুলে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে, তার কুফল শিক্ষা বোর্ডের রেকর্ডে স্পষ্ট ধরা পড়ছে। একটি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষানিয়ন্ত্রক আমাকে জানিয়েছেন, অন্যান্য বিষয়ে কোনো রকমে যারা পাস নম্বর পাচ্ছে, তারাও ধারাবাহিক মূল্যায়নে ৯৮ শতাংশ নম্বর পাচ্ছে। অর্থাৎ, স্কুলে ধারাবাহিক মূল্যায়ন চালু হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা এসব বিষয় কিছুই শিখছে না; কিন্তু নতুন ধরনের দুর্নীতির জন্ম দিচ্ছে। মিথ্যা নম্বর লেখা থাকছে শিক্ষা বোর্ডের একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্টে। দুর্নীতির সে দলিল শিক্ষার্থী সারা জীবন বহন করবে এবং নিজে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে উৎসাহিত হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রে তার বিপুল নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]