অশান্ত সময়ের হিরো

২০১০–এর দশক শেষ হতে চলল। কিন্তু ২০১০ সালে দুনিয়াজুড়ে যে কাঁপন শুরু হয়েছিল, এখনো তা থামেনি। ২০১০–এর ১৭ ডিসেম্বরে তিউনিসিয়ার তরুণ মোহামেদ বৌয়াজিজি গায়ে আগুন দিয়ে আরব বসন্তের সলতেটা জ্বালিয়ে দেন। দেশে দেশে তা দাবানল লাগিয়ে দেয়। আর দশকের শেষ বর্ষে, ২০১৯ সালে ১৬ বছর বয়সী সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থানবার্গের জলবায়ু যুদ্ধে আলোড়িত হলো পশ্চিমা সমাজ। দুনিয়া যেভাবে চলছে, তরুণেরা তাতে ভরসা পাচ্ছে না। বিশ্বব্যবস্থার কাছে এই তরুণেরা একটা সমস্যা, আর তরুণদের কাছে এই ব্যবস্থা অকেজো। কখনো বয়সী মানুষেরা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করেন। আবার এমন সময়ও আসে, যখন তরুণেরা পুরোনো নিয়মকানুনে আস্থা হারায়।

গত দশকটা হয়ে উঠেছে নতুন-পুরোনোর দ্বন্দ্বের দশক। ২০১০-২০১৯, এই ১০ বছরে প্রায় সব মহাদেশের বড় বড় রাজধানী বারবার কেঁপে উঠছে লাখো তরুণের স্লোগানে, পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ে। এখনো ভারত থেকে আলজেরিয়া, ইরাক থেকে চিলি, হংকং থেকে বলিভিয়া—সর্বত্র সবচেয়ে মুখর মুখ তরুণের। তারাই গত দশকের সবচেয়ে আলোচিত, তারাই গত দশকের সবচেয়ে বিক্ষুব্ধ সামাজিক এজেন্ট।

অনেকেই এই দশককে ১৯৬০ দশকের দুনিয়া কাঁপানো ছাত্র আন্দোলনের সময়ের সঙ্গে তুলনা করছেন। ষাটের দশকেও তরুণেরা বিপ্লব-বিদ্রোহ ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই দশকে একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেছে। মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি তরুণ জনগোষ্ঠী এখন এই গ্রহে বিচরণ করছে। এবং তারা সুখী নয়। তারা রাগী। ভারতীয় লেখক পঙ্কজ মিশ্র তো বই লিখেই ফেলেছেন ‘এজ অব অ্যাঙ্গার’—ক্রোধের কাল।

বিশ্বে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বয়স ধরা হয় ১৫ থেকে ৬৪। এরাই এখন জনসংখ্যার ৬৫ দশমিক ২২ শতাংশ। এদের সিংহভাগই আবার তরুণ। আবার এই দশকেই, বলা যায় ২০১২ সাল থেকেই বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে জনসংখ্যা-সুফল, তথা পপুলেশন ডিভিডেন্ডের পর্যায়ে। বাংলাদেশে এখন কর্মক্ষম ৬৫ শতাংশ মানুষই ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী। আর ১৫-৩৫ বছরকে তারুণ্যের ভাগ ধরলে দেশের ৩ ভাগের ১ ভাগই তরুণ। যে হিসাবেই যাওয়া যাক, বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও তরুণেরাই একক বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। এ নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই।

এই হিসাবের একটা সোনালি দিক যেমন আছে, তেমনি আছে ধূসর আরেক প্রচ্ছদ। ভালো হলো এই, বাংলাদেশে এখন নির্ভরশীল মানুষের চেয়ে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি। আগে এক পরিবারের একজন আয়কর্তাকে যতজনের দায়িত্ব নিতে হতো, এখন নিতে হয় তার চেয়ে কম। জনসংখ্যাতত্ত্বের এই সোনালি দিকের নাম দেওয়া হয়েছে ‘পপুলেশন ডিভিডেন্ড’ বা জনসংখ্যা-সুফল। তবে সুফলটা তখনই আসে যখন এদের কাজে লাগানো যায়, কাজ দেওয়া যায়, দেওয়া যায় সুন্দর-শোভন জীবন।

কিন্তু এই সুফল যদি কাজ লাগানো না যায়, তাহলে এক বিপুল বিক্ষুব্ধ ও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে থাকা তরুণ জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠে সময়বোমা। সময়-সময় তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঠিক যা এখন ঘটছে উত্তর ও দক্ষিণ উভয় গোলার্ধে।

৩০ বছর ধরেই ইরাকের সমাজবিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ার করে আসছেন যে উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা না করলে সামাজিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। ইরাকের বর্তমান অস্থিতিশীলতার বড় চালিকা শক্তি হলো যুগপৎ দুর্নীতি ও বেকারত্বের শিকার তরুণেরা। এই বেকারেরা যদি আইএস বা আল-কায়েদার মতো জঙ্গি দলে নাম লেখায়, তাহলে এক ধরনের বিপদ। আবার তারা এখনকার মতো সরকারবিরোধী অসন্তোষে ফেটে পড়লে তা সামলানো সরকারের জন্য বিপদের ব্যাপার। জনসংখ্যা-সুফলের এটা হলো ধূসর দিক।

ভয় হয় বাংলাদেশের তরুণদের না জানি এই ধূসর দিকটা ছেয়ে ফেলে। বেকারত্ব ক্রমশ বাড়ছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার আশানুরূপ না। সম্প্রতি করা প্রথম আলো তারুণ্য জরিপও বলছে, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ তরুণের চারজনই জীবনের লক্ষ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রায় ৬৫ শতাংশ তরুণ জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই নিজেকে অপ্রস্তুত বোধ করছে। তার ওপর ধেয়ে আসছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। নতুন প্রযুক্তি, নতুন জীবনধারা এবং উৎপাদন ও যোগাযোগের নতুন পদ্ধতি অনেক পুরোনো প্রযুক্তি ও পেশার লোককে অযোগ্য করে ফেলবে। প্রবাসেই হোক বা দেশের পোশাকশিল্পেই হোক, শ্রমঘন কায়িক শ্রমের কাজ কমে যাবে। সৃষ্টি হবে নতুন বেকার।

আবার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগ নেওয়ার মতো কারিগরি ও প্রযুক্তি জানা লোকও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারছে না। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশের এই জনসংখ্যা-সুফলের মেয়াদ বড়জোর ২০৪১ সাল পর্যন্ত। তারপর আবার বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। এর মধ্যেই শিক্ষা, রাজনীতি, অবকাঠামো এবং সর্বোপরি অর্থনীতিকে উপযোগী করে গড়ে তুলতে না পারলে ‘ডিভিডেন্ড’ হয়ে যেতে পারে ‘ডিজাস্টার’। আমাদের গত এক দশক যে মাত্রায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক দুর্নীতিতে কাটল, তাতে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি কাঙ্ক্ষিত প্রস্তুতি নিতে পেরেছি? যদি না পারি, তাহলে অবস্থা হতে পারে ইরাক বা নাইজেরিয়ার মতো বিশৃঙ্খল।

ইতিহাসে একেকটা সময় একেক রকম যায়। নতুন সহস্রাব্দ তরুণদের সহস্রাব্দ। প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে তরুণদের হাতে; সোশ্যাল মিডিয়া ও অ্যাপসের উদ্ভাবন মৌলিকভাবে দশকটাকে বদলে দিয়েছে। একই সঙ্গে এই দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের মতো মানুষ উদ্বাস্তু ও দেশান্তর হচ্ছে। নেশা ও অবসাদ সব গোলার্ধের তরুণদেরই ভোগাচ্ছে। আবার তরুণেরাই #মিটু, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সামনের সারিতে। আবার ব্যবসা থেকে রাজনীতি, উৎপাদন থেকে প্রতিষ্ঠান সবখানেই তরুণের মেধা ও শ্রম ছাড়া কিছু চলবে না। তেমনি তারুণ্যের ক্রোধকে পাত্তা না দিয়েও চলছে না কারও।

তরুণ জনসংখ্যার বিস্ফোরণ আর তারুণ্যের দ্রোহ তাই একই মুদ্রার দুই পিঠ। শুধু এই দশক নয়, আগামী দিনগুলোতে তরুণ প্রিক্যারিয়েত, তথা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ঝুঁকিতে থাকা বিপুল জনগোষ্ঠী কী পাবে আর কী পাবে না, তা-ই অনেকটা ঠিক করবে ইতিহাসের গতিপথ।

সহস্রাব্দের এত সব ঝুঁকির তির যাকে নিশানা করছে, সে মানুষটি তরুণ। আবার গত এক দশকে দুনিয়াকে বদলে দেওয়ার নায়কও তারা। সম্ভাবনার সোনার কাঠিটা তাদেরই হাতে। কিন্তু তারা এখন চায় পরিবর্তনের রুপার কাঠিটা তাদের সঙ্গে মিলুক। আমাদের চারপাশেই তারা আছে, কখনো ট্র্যাজিক কখনো বিজয়ী।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]