চামড়াশিল্প নগরী

সাভারের চামড়াশিল্প নগরী কি কালক্রমে আরেকটি হাজারীবাগে পরিণত হবে? এই কুলক্ষণ ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। ১৭ বছর ধরে রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারির স্থানান্তর চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার একনেক বৈঠকে সাফ বলেছেন, আগামী জুনের মধ্যেই চলমান প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে।

আমরা অবশ্যই আশা করব যে এরপর আর সময়সীমা না বাড়ানোর সিদ্ধান্তে সরকার অটল থাকবে। সে জন্য এখনই সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেওয়া যে তারা ব্যর্থ হলে এবার তাদের শৃঙ্খলাভঙ্গের দায় নিতে হবে। কিন্তু এখন প্রকল্প বাস্তবায়নের থেকেও বড় উদ্বেগ, প্রকল্প বাস্তবায়ন ইতিমধ্যে তারা যতটা করেছে, তা প্রত্যাশিত মান থেকে বহুদূরে। সরকারি প্রকল্পের ব্যয় যেখানে শনৈঃ শনৈঃ বাড়ার খবর পাই, তখন ২০০৩ সাল থেকে চলতে থাকা প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৭৮ কোটি থেকে ৬৩ কোটি টাকা ছেঁটে ফেলার খবর মন্দ নয়। কিন্তু হতাশাজনক খবর হলো, নতুন চামড়াশিল্প নগরী তার যাত্রার শুরুতেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। 

বিশেষ করে ইঙ্গিত মিলছে যে আবারও বর্জ্য অপসারণের প্রক্রিয়া এবং তার ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতা নিয়ে ট্যানারির মালিক এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিসিকের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ চলছে। গত অক্টোবরে সাভারে চামড়াশিল্প নগর পরিদর্শনে গিয়ে শিল্পমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, শিল্পসচিব খোদ বিসিক চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে কিছু উদ্বেগজনক নমুনা প্রত্যক্ষ করেন। বিশেষ করে তাঁরা তাঁদের বৈঠকস্থল থেকেই পরিষ্কার অবলোকন করেন যে নর্দমা দিয়ে অবিরাম বর্জ্য গিয়ে মিশছে ধলেশ্বরীতে। অথচ এরপরও পরিস্থিতির উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না।

ট্যানারির মালিকেরা বলছেন, বর্জ্য পাম্প করে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সিইটিপিতে নেওয়ার কথা। অথচ সেটা ঠিকমতো কাজ করে না। অন্যদিকে বিসিকের কর্তারাই শুধু নন, সিইটিপি নির্মাণে পরামর্শকের দায়িত্বে থাকা বুয়েটের একটি সংস্থার মত হলো, দোষটা ট্যানারির মালিকদের। প্রথম আলোর প্রতিবেদক ঠিক দুই বছরের ব্যবধানে গত অক্টোবরে এলাকাটি সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। উভয় অক্টোবরেই তিনি ধলেশ্বরীর ভাগ্য বুড়িগঙ্গার মতো বরণের সব ধরনের অশুভ আলামত লক্ষ করেন।

অথচ রাজধানীবাসীর জনস্বাস্থ্য এবং নির্দিষ্ট করে বললে বুড়িগঙ্গা ‘হত্যাকাণ্ড’ রোধ করাই ছিল ট্যানারি স্থানান্তরের অন্যতম মূল লক্ষ্য। এটাও সুবিদিত যে নদী বাঁচাতেই উচ্চ আদালত অনিচ্ছুক ট্যানারির মালিক ও কর্তৃপক্ষকে ট্যানারি সরাতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু এখন আমরা পরিহাসভরে দেখি, হেমায়েতপুর পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব একটি চামড়াশিল্প নগর হওয়ার আগেই পরিস্থিতি কতটা শোচনীয় আকার ধারণ করেছে। সুতরাং এই প্রশ্ন এখন জ্বলন্ত যে দেড় হাজার কোটির বেশি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প আগামী জুনে যদি শেষও হয়, তাহলে সন্তুষ্টির কোনো সুযোগ আছে কি? ধলেশ্বরী নদী হত্যার এই উন্নয়ন আমাদের কি স্বস্তি দেবে? কোনো সন্দেহ নেই যে দেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী বিশাল সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্পের বিকাশ এবং তার উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মানের সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। 

আমরা মনে করি, আগামী ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হোক, ভালো কথা। কিন্তু পরিবেশের বিষয়টিতে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সিইটিপি নির্মাণ ও প্রাথমিকভাবে পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া চীনা প্রতিষ্ঠান জিংসু লিংঝি এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন কোম্পানির জবাবদিহির প্রশ্নটি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার দাবি রাখে। কারণ, অভিযোগ আছে, তারা সার্বক্ষণিক সিইটিপি চালায় না এবং বর্জ্য টেনে নেয় না। ট্যানারিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তারা চামড়ার বিভিন্ন উচ্ছিষ্ট তরল বর্জ্যের সঙ্গে ছেড়ে দেয়, আর তাতে পাইপলাইন আটকে যায়।

চামড়াশিল্প নগরটি গড়ে ওঠার আগেই যেভাবে ধ্বংসের কবলে পড়েছে, তা থেকে তাকে রক্ষা করতে উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপই ভরসা।