মোনাজাতউদ্দিনের মানুষেরা

মোনাজাতউদ্দিন
মোনাজাতউদ্দিন

‘আমাদের ঘরের পাশে যে হাঁড়ি-ডোম-কৈবর্ত-বাগদি রহিয়াছে তাহাদের সম্পূর্ণ পরিচয় পাইবার জন্য আমাদের লেশমাত্র উৎসুক্য জন্মে না, তখনই বুঝিতে পারি পুঁথি সম্পর্কে আমাদের কত বড় একটা কুসংস্কার জন্মিয়া গেছে।’ অর্থাৎ জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞানই যে আসল জ্ঞান, এটা রবীন্দ্রনাথ ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’–এ বহু আগেই বলে গেছেন।

প্যারিসের রাজপথে প্যারিসকে পাওয়া যায় না যেমন, তেমনি বাংলাদেশকে পাওয়া যায় না শুধু ঢাকায়। বাংলাদেশ আছে চিলমারীতে, কানসোনায় ও লক্ষ্মীটারীতে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তমিজের বাপ, হাড্ডি খিজির কিংবা দেবেশ রায়ের বাঘারুর মতো মানুষকেও দেখা যায় সেখানে। যাঁদের ছবি মোনাজাতউদ্দিন তুলেছেন চুয়াত্তরে, বিরাশিতে, আটাশিতে, নব্বইতে, একানব্বইতে। প্রতিবছর। যারা মরছেই। যাদের কথা সব সময় সংবাদে সরাসরি অনাহারে মৃত্যু বলে বলা যায় না। বলতে হয় ডায়রিয়া, খাদ্যাভ্যাজনিত অপুষ্টিতে মৃত্য ইত্যাদি। যাঁরা মৃত্যুমুখে বলেন, ‘হামরা না খায়া মরি যাই আর ওমরা খালি ফটোক তোলে! খালি ফটোক তোলে!’ তাদের ঘটনা লেখা থাকে মোনাজাতউদ্দিনের ‘শাহা আলম ও মজিবরের কাহিনী’, ‘ছোট ছোট গল্প’, ‘নিজস্ব সংবাদ’, ‘চিলমারীর এক যুগ’, ‘পথ থেকে পথে’, আর ‘সংবাদ নেপথ্যে’।

‘গরম ভাত থেকে ধোঁয়ার সাথে সাথে উবে যায় স্মৃতি। অতীত উধাও, দুদিন আগে শেরপুরের কোনো অভাবী গ্রামে ছিলাম, ভুলে যাই। ভুলে যাই দীর্ঘদিন বেকার বৃদ্ধ মজুর ভাদুর কথা, বিস্মৃত হই কাঁচাকলা সেদ্ধ খাওয়া সেই বৃদ্ধা। যে গ্রামে ক্ষুধা আজও আছে, যেখানে অনাহারজনিত অপুষ্টিতে মারা গেছে নর-নারী-শিশু। তারা কোথায়?...তারা থাকুক কি মরুক, আধ সের চালের ভাত ৭ জনে ভাগ করে খাক কিংবা কেউ খাক কাঁচাকলা সেদ্ধ, আমার যেন কিছু যায় আসে না।’ পথ থেকে পথে এ রকম ছবি তুলতে তুলতে নিজেই একদিন যমুনার জলে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরের ২৯ তারিখ বিলীন হন। চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের আজ মৃত্যুবার্ষিকী।

২.
‘ইয়ুরোপ প্রভৃতি দেশ হইলে তিনি শিক্ষক-শ্রেষ্ঠ স্পেনসারের সমান সম্মান ও খ্যাতিলাভ করিতে পারিতেন’—কাঙাল হরিনাথ মজুমদার শিক্ষকতা নিয়ে কথাগুলো আত্মজীবনীতে বলেছেন তাঁর ছাত্র জলধর সেন। কথাটা তোলার কারণ এই, কখনো কখনো বড়ত্ব বোঝার ক্ষেত্রে তুলনার গজকাঠির দরকার হয়। জগতের লাঞ্ছিত-বঞ্চিতদের কথা যিনি সংবাদপত্রে গ্রিক দেবতা প্রমিথিউসের বুকভরা আগুন নিয়ে লিখেছেন, সেই মোনাজাতউদ্দিনের তুলনীয় কাঙাল হরিনাথ ছাড়া কে আছেন? যে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারকে বলা হয় উপমহাদেশের প্রথম গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ।

কাঙাল হরিনাথ তাঁর ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’য় ১৮৭০–এর ২৩ জুন জানাচ্ছেন, ‘দক্ষিণ সাবাজপুরবাসী মনুষ্যদিগের দুর্দশার কথা শুনিলে শরীর রোমাঞ্চিত হয়। সরকারি বিজ্ঞাপনীতে প্রকাশ, তথায় চাউল দুষ্প্রাপ্য হইয়াছে। অতি যৎসামান্য চাউলের প্রতি মণ ৩ টাকায় বিক্রয় হইতেছে। প্রজার ঘরে কিছুমাত্র চাউল নাই। দুইবেলা আহার করিতে পায়, এরূপ লোক তথায় নাই। অনেকে আবার দুইতিন দিন অনাহারেও জীবন ধারণ করিতেছে। বিধবা, উপায়হীন শিশু সন্তান এবং বিগত ঝড় হইতে যাহারা রক্ষা পাইয়াছে, ইহাদের ক্লেশের পরিসীমা নাই।...গবর্ণমেন্ট বেচক্র দেখিয়া হাত গুটাইয়া বসিয়াছেন।’

ঠিক তার ১০৪ বছরের মাথায় মোনাজাতউদ্দিন লিখেছেন: চিলমারীতে নামি। রমনা স্টেশনে শত শত মানুষ। থানা সদরে রিলিফের জন্য দীর্ঘ লাইন। ভাঙা দেহ, শত ছিন্ন বস্ত্র, কোটরাগত চোখ, হাতে হাতে সানকি, মাঠময় হইহল্লা, কান্না, ঠেলাঠেলি ছোটাছুটি। সবাই কিছু বলছে, কেউ কাতরাচ্ছে, কিন্তু বোঝা যায় না। শুধু গমগমে একটা ভারী আওয়াজ বাতাস যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে। লঙ্গরখানায় রান্না হচ্ছে খিচুড়ি। তারই একটি মুঠোর জন্য হাজারো নর-নারী-শিশুর অপেক্ষা। লাঠি হাতে একদল স্বেচ্ছাসেবক, কিছু চৌকিদার, আনসার সদস্য হিমশিম খাচ্ছেন পরিস্থিতি সামলাতে। (নিজস্ব রিপোর্ট)

এসব আগুনখোর মানুষের কথা লিখতে গিয়ে দুজনে একই বেদনায় পুড়েছেন। একজন বলেছেন, তাহাদিগের মত এই, এ–দেশীয়রা নানা কারণে অত্যাচারিত হইয়াও, বেদনা প্রকাশ করিতে পারিবে না। এ যুগে মোনাজাতউদ্দিন বলছেন, ‘কিন্তু খাদ্য সংকট আর মৃত্যু সম্পর্কে চুয়াত্তরে যা লিখতে পেরেছি, আশি-বিরাশিতে যা লিখতে পেরেছি, আটাশিতে যা লিখতে পেরেছি, এমনকি একানব্বইতে যা লিখতে পেরেছি, বিরানব্বইতে তা লিখতে পারলাম না। এ যে কী যন্ত্রণা!’ যাদের ইতিহাসের নির্মাতা বলা হয়, যে জনগণের কথা ব্রিটিশ আমল থেকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশেও বলা যায় না। তাদের কথা সংবাদমাধ্যমে বলার মতো নিদান বন্ধু কাঙাল হরিনাথের পর মোনাজাতউদ্দিন ছাড়া আর কেউ আছে?

৩.
মোনাজাতউদ্দিনের নামহীন–গোত্রহীন অজস্র মানুষের মধ্যে কয়জনের কথা আমরা বলব? তাঁদের একটিই সমষ্টি নাম—জনগণ। যে জনগণকে মুক্তিযোদ্ধা, কবিরা বঙ্গোপসাগরের আদিগন্ত নীল জলরাশির কল্লোল আর বন্ধন থেকে মাতালের মতো আকাঙ্ক্ষা করেছেন। মোনাজাতউদ্দিন তাঁদেরই লোক, তাঁরা মোনাজাতউদ্দিনের মতো সাংবাদিকেরই উদ্দিষ্ট মানুষ।

লেখক: শিক্ষক ও সামাজিক সংগঠক।
[email protected]