দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ অবস্থান পরিষ্কার নয়

>

বিদায় নিচ্ছে ২০১৯। কেমন ছিল দেশের দুর্নীতি পরিস্থিতি? দুর্নীতি দমন কমিশন কতটা ভূমিকা রাখল বা কোথায় আটকে থাকল। বছরের শেষ ভাগে চলল ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। সেটাই বা কোথায় গিয়ে ঠেকল। এসব নানা প্রসঙ্গ ও দুর্নীতি দমন নিয়ে নতুন বছরের প্রত্যাশা প্রসঙ্গে লিখেছেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান

২০১৯ সালে দেশে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে এমন কিছু যুক্ত হয়েছে, যা নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। বিশেষ করে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান ঠিক দুর্নীতিবিরোধী না হলেও দেশের মানুষ বিষয়টিকে অবশেষে ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ নীতি হিসেবে দেখেছে। কিন্তু কী যে হলো। অনেকের আশঙ্কাই আপাতত সঠিক প্রতীয়মান হচ্ছে। আশঙ্কাটা হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে সব সময়ের অবস্থান বা এ-সংক্রান্ত সাধারণ নীতি কী? যে ক্যাসিনো-কাণ্ড সংবাদমাধ্যমকে আলোড়িত করল, তা কি দুর্নীতিবিরোধী সাধারণ নীতির প্রতিফলন? মানুষ বছরের শেষে প্রশাসনের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে স্পষ্টতই সন্দিহান থাকল। তারা ধরে নিচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতিবিরোধী রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিরেট নয়। গত এক দশকে দুর্নীতি বা অনাচারের যে মহিরুহ পত্রপল্লবে বিকশিত হয়েছিল, তার রাশ কিছুটা টানা সম্ভব হলেও এখন এটা থমকে আছে। এর বিরুদ্ধে আইন তার ‘আপন গতি’ গতি পেল না। সরকারি দলের বড় পদে থাকা বিশেষ কয়েকজন কারাগারে আছেন। কিন্তু অবিলম্বে বিচার বা সাজা নিশ্চিত হবে, তার আলামত নেই।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বছরের শেষে সরিষার ভূতবিষয়ক একটি অকপট উচ্চারণ করেছেন। তার অর্থ দাঁড়ায়, দুদকের কিছু কর্মকর্তা তথ্য পাচার করেন, সঠিকভাবে তদন্ত না করেন না। এর সঙ্গে থাকে বিভিন্ন গাফিলতি। এসবের কারণে ৩০ ভাগ মামলায় শাস্তি হয় না। তবে তিনি আশাবাদী, ‘কর্মকর্তারা যদি সততা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন’, তাহলে কমিশনের ‘ব্যর্থ’ হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু যা তিনি হয়তো বিলক্ষণ জানেন কিন্তু বলেননি, সেটা হলো রাজনীতিতে বার্তাটা দ্ব্যর্থহীন থাকতে হবে। রাজধানী ঢাকায় ডজন ডজন রিট দায়ের থাকা অবস্থায় জুয়া-ক্যাসিনোর রমরমা ব্যবসা চলছিলই। যাঁদের জানা থাকা দরকার, তাঁদের প্রায় সবারই তা জানা ছিল। কিন্তু অস্পষ্ট কারণে হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটল। আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিদ্রাভঙ্গ ঘটল। দীর্ঘদিন পর মানুষ বিশ্বাস করল, ক্ষমতাসীন দলের উঁচুতে থাকা মানুষগুলো বড় দুর্নীতি করে এবং তারও জবাবদিহি হতে পারে। এমন কিছু নেতা, যাঁরা নক্ষত্রের পর্যায়ে ছিলেন, তাঁদের পতন ঘটল। তার কারণ, সমীকরণ যা-ই হোক।

২০১৯ সালে আরও কিছু ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষণীয়। প্রথমত, টিআইবি এবং দুদক তৃতীয়বারের মতো একটি চুক্তি সই করল। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান স্বীকার করলেন, দুদকের সক্রিয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, উচ্চ আদালতের অঙ্গনে দুর্নীতিবিরোধী বার্তাটা জোরালোভাবে এসেছে। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের মামলার নিষ্পত্তি ও দণ্ডিত হওয়ার হার বেড়েছে। মানি লন্ডারিংয়ে কিছু ভালো রায় এসেছে। ২০১৯ সালে হাইকোর্টে রুল জারি হয়েছে। ২০১৯ সালেই হাইকোর্ট রুলের নিষ্পত্তি করেছেন। মার্চের রুল জুনে নিষ্পত্তি হয়েছে। চেম্বার জজে গিয়ে হাইকোর্টের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ মেলেনি। এ কারণে বিচারিক আদালতে মামলা চলেছে। আগে এমনটা ঘটেনি? জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, খুবই বিরল ছিল।

তৃতীয়ত, আগাম জামিন বিষয়ে চলতি বছরই সুপ্রিম কোর্ট তাঁর নির্দেশনার পরিমার্জনা করেছেন এবং হাইকোর্ট তা বিশেষ করে দুদকের মামলায় অনুসরণ করেছেন। এর আগে আমরা দেখেছি, আপিল বিভাগ আগাম জামিনসংক্রান্ত তার কড়াকড়ি প্রক্রিয়া যত্নের সঙ্গে পালন না করায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। সর্বশেষ প্রবণতা হলো, মোটামুটি চার সপ্তাহের সময় দিয়ে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করা। গত জুলাইয়ে ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় করা মামলায় নিম্ন আদালতে জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পর হাইকোর্ট থেকেও জামিন পাননি ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী। এরপর ২৪ ডিসেম্বর রোজী চিশতী ও মেয়ে রিমি চিশতীর আগাম জামিন নামঞ্জুর হয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে তাঁদের বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৩৭ কোটি টাকার বেশি সম্পদ অর্জনের দায়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

চতুর্থত, দুদক আইনজীবীদের আরেকটি বড় সন্তুষ্টি হলো খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তাঁরা আরও পুরোনো মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে পেরেছেন। গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়ার মামলার ওপর প্রায় ৯ বছর ধরে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ ছিল। হাইকোর্ট তা তুলে নিয়ে ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বলেছেন। ৩ মাস কেটে গেছে। দুদক বলছে, খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণে বিচার এগোচ্ছে না।

পঞ্চমত, বলা যায় বাংলাদেশ থেকে গত ১১ বছরে ৮ হাজার ১৭৫ কোটি ডলারপাচার হয়েছে। কিন্তু এই অর্থের কোনো অংশের হদিস জানা এবং তা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে দুদক অব্যাহতভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। হংকংয়ের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে থাকা টাকার খোঁজ এক-এগারোর সরকারের সময়ে মিলেছিল। এবার দুদক ‘বিশাল অগ্রগতি’ অর্জন করেছে। ২০১৬ সালে আমরা জেনেছিলাম, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান, তাঁর স্ত্রী নাসরিন খান ও ছেলে ফয়সাল মোরশেদ খানের হংকংয়ের হিসাব ১০ দিন জব্দ রাখার (ফ্রিজ) নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তিন বছর পরে হাইকোর্ট সম্প্রতি ৩৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার এবং ১৮ হাজার ৭০০ শেয়ার জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন। গত সেপ্টেম্বরে মোরশেদ খান ও তাঁর ছেলে ফয়সাল মোরশেদের ওই অর্থ ও শেয়ার আর রাখা সম্ভব নয় বলে হংকং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক জানিয়েছিল।

গত সেপ্টেম্বরে ভিয়েনায় গিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেছিলেন, কমিশন বহুমুখী কর্মপ্রয়াসের অংশ হিসেবে নতুন সাংগঠনিক কাঠামো গ্রহণ করেছে, যা আগের সাংগঠনিক কাঠামোর প্রায় দ্বিগুণ। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, আগের চেয়ে দুদক সক্রিয়। কিন্তু আগে তারা সন্তোষজনক অবস্থা থেকে অনেক দূরেই ছিল। তাই আগের থেকে সক্রিয় হওয়াটা প্রত্যাশিত অগ্রগতি নয়। জনগণকে তা যথেষ্ট সন্তুষ্ট করে না। তদুপরি এর মূল কারণ অবশ্যই রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক কাউন্সিল করল। এর আগে আমরা শুনলাম, অনুপ্রবেশকারী ও বহিরাগতদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেই তালিকার কী প্রভাব পড়ল, তা মোটেই স্পষ্ট নয়। বরং ক্যাসিনো–সম্রাটের পক্ষে পোস্টার পড়েছে। এ ছাড়া ক্যাসিনো ও নানা অনিয়মের দায়ে যুবলীগের চেয়ারম্যান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ইতিহাস সৃষ্টি করে ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে বিদায় দেওয়া হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারেও কিছু হয়নি। তাই স্ববিরোধিতা একটা আছে। এক সম্রাটের পতন ঘটেছে, কিন্তু বিভিন্ন খাতে এ রকম বহু সম্রাট টিকে আছেন। যুবলীগের চেয়ারম্যান বা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদককে প্রধানত দুর্নীতির কারণেই বিদায় নিতে হয়েছিল, এ রকম একটা ঝোড়ো বার্তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। এটা কাটিয়ে ওঠাই ২০২০ সালের জন্য চ্যালেঞ্জ।

দুদক বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আমরা অনেক ছিদ্রান্বেষণ করি। কিন্তু রাজনৈতিক বার্তাটা পরিষ্কার থাকলে শত ছিদ্র নিয়েও এসব সংস্থাই যে কার্যকরভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তার খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য এবং আশাজাগানিয়া উপাখ্যান তৈরি হলো বিদায়ী বছরে। কিন্তু সরকারি চাকরিজীবীদের আইনটি বৈষম্যমূলকভাবেই পাস করল সংসদ। তাই তাঁদের দুর্নীতি রোধ করতে গিয়ে দুদককে হিমশিম খেতে হবে।

দুদকের হটলাইনে এ বছরও ১৮ লাখ অভিযোগ এসেছে। প্রতিটি কার্যদিবসে ফোনকল আসে ছয় হাজারের বেশি। এটা সমাজে দুর্নীতির ব্যাপকতার নির্দেশক। কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্তদের বিচার পর্ব যাতে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মধ্যে না আসে, তাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। দেশের ৬৭ ভাগ মানুষ বিচার বিভাগের ওপর আস্থা রাখলেও ৫ ভাগের ১ ভাগ আদালতে আসে। বাকি ৪ ভাগই বিরোধ নিষ্পত্তির বিকল্প উপায়ে প্রতিকার খুঁজে নেয়। তাই প্রথম কাজ হলো দুর্নীতির উৎসে আঘাত হানা। দুদক ৩৩ হাজারের বেশি সততা সংঘ, সততা স্টোর ও দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি করেছে। এসব উদ্যোগকে অবশ্যই স্বাগত। কিন্তু এর অধিকাংশই কাগুজে। তার কারণ, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় অঙ্গসংগঠনের কমিটিগুলোর সঙ্গে এর সম্পর্ক আলগা। সুতরাং দুর্নীতি দমন করতে চাইলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কাছে বার্তা স্পষ্ট থাকতে হবে।

দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান। তিনি জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমাদের কাছে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা চাওয়া হয়েছিল কেন্দ্র থেকে। আমরা তা পাঠিয়ে দিয়েছি আর দুর্নীতিবাজ কারা, তা সবাই জানে। তাদের তালিকা করছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আমরা এবার এদের কাউকেই আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের কোনো কমিটিতে ঠাঁই দেব না।’ যত মন্দ কাজ তা সব বহিরাগতরা করে, এটা একটা অগ্রহণযোগ্য যুক্তি। তবে দুর্নীতিবাজদের তালিকা করাই হোক দলের কাজ। নিয়ন্ত্রিত আমলা ও দলতন্ত্র ব্যবস্থার বিপদ স্মরণ করিয়ে দিলে কেউ কেউ চীনকে দেখান। কিন্তু যা বলা হয় না সেটা হলো প্রেসিডেন্ট শি বছরে গড়ে দুই লাখের বেশি দলনেতাকে শাস্তি দেন। এখানে বাছবিচার থাকে না। ১৯৪৯ সালের পর চীনের ইয়াংঝু প্রদেশের রূপকার হিসেবে বিবেচিত জনপ্রিয় নেতাও বাদ যাননি। এমন নেতার বিদায়ের পর মানুষ তাঁর ঘুষখোর পরিচয়টাই মনে রেখেছে।

নতুন বছরে আমরা দলের প্রণয়ন করা দুর্নীতিবাজদের একটি শুদ্ধ তালিকা প্রত্যাশা করি। এটা প্রশাসন পারবে না।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]