তোমরা ভুলেই গেছ সুবর্ণচরের সেই রাতের কথা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই আজ ৩৬৫ দিন আগের ২৯ ডিসেম্বর রাত এবং ৩০ ডিসেম্বর দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছেন নানাভাবে। কিন্তু সুবর্ণচরের সেই নারী ভাবছেন পরের রাতের কথা। তাঁর ছেলে-মেয়েরাও নোয়াখালীর শীতে হিম হয়ে আছে গত দুদিন। পরিবারের নবম শ্রেণির ছাত্রীটিও কেমন অস্থির হয়ে কেবল করুণ চোখে মাকে দেখে। ধর্ষকেরা তার বেলায় ব্যর্থ হয়েই মায়ের ওপর হামলে পড়েছিল। যে মা তাকে বাঁচিয়েছেন, সেই মায়ের বিষণ্নতা ছুঁতে চায় মেয়েটি।

বিপুল বেদনা আর অপমানের ভার বয়ে বেড়ানো পরিবারটিকে বয়ে চলেছেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক এক গৃহকর্তা। তিনি জানেন না, হতবিহ্বল হয়ে থাকা তাঁর খেয়ালই নেই বছরটি কীভাবে চলে গেল। কীভাবে আগামী বছরটি যাবে!

‘সুবর্ণচর’ থমকে দিয়েছিল দিনটাকে
না, সে-ই ডিসেম্বর থেকে এ-ই ডিসেম্বর পর্যন্ত, ‘ভোট’ এবং ‘নির্বাচন’ পরবর্তী এক বছরেও বাংলাদেশ তোলপাড় করা সুবর্ণচর গণধর্ষণের বিচার শেষ হয়নি। চরজব্বর থানায় যে মামলার ফাইলের ঠিকানা ছিল: নম্বর ১২; ৩১-১২-১৮; জিআর ২৬৪৫/১৮।

যত দূর মনে পড়ে, ২০১৯-এর প্রথম সপ্তাহে পুরো বাংলাদেশ ওই ধর্ষণের ঘটনায় লজ্জায় কুঁকড়ে চিৎকার করে উঠেছিল, ‘বিচার চাই’ বলে। মনে হয়েছিল বিচার হবেও। আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমও ভেবেছিল, এত বর্বরতার ভার বাংলাদেশ বইতে পারবে না।

কিন্তু বাস্তবতা যেন এ দেশে সয়ে যায় সব। চার সন্তানের মা, নির্যাতিত সেই নারীকে বছরজুড়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার ব্যবধানে হাসপাতাল, আদালত, বাড়ি মিলে দৌড়াদৌড়ি করে কাটাতে হয়েছে। সঙ্গে পরিবারকেও দৌড়াতে হয়েছে ৩৬৫‍+১ দিন।

হ্যাঁ, আদালতে শুনানি চলেছে। নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের বিচারকের আন্তরিকতারও ঘাটতি ঘটেনি; হাবিবুর রসুল মামুন, রবিউল হাসান পলাশসহ কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ আইনজীবীও রয়েছেন ভিকটিমের পাশে। রাষ্ট্রপক্ষ এবং পিপিও সক্রিয় ছিলেন। ‘ট্রায়াল অবজারভার’ হিসেবে আছেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী গোলাম আকবর। ইতিমধ্যে জেরা হয়েছে বহুজনের; কিন্তু বিচার শেষ হতে আরও অনেক সময় লাগবে। কয়েকজন সাক্ষীর বক্তব্যকে ‘রাষ্ট্রপক্ষ’ প্রত্যাখ্যানও করছে আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত বলে।

অভিযুক্তদের জন্য নিকটজনের সহানুভূতি জারি আছে
এ দেশের নির্যাতিত নারীদের জন্য ‘ন্যায়বিচার’-এর ব্যবস্থাটিই এমন। শারীরিক-মানসিক ক্ষত নিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া নামের এক বিশাল সমুদ্রও পাড়ি দিতে হয় তাঁদের। বাস্তবে এটাই ‘আইনের শাসন’। আইনের মানুষেরা নন, এই বাস্তবতা বদলাতে দরকার রাজনীতির মানুষদের। কিন্তু সেই পরিবর্তনের পথে সুবর্ণচর অধ্যায়ের পরও বাংলাদেশ আদৌ এগিয়েছে বলা যায় না।

এই ৩০ ডিসেম্বর প্রথম আলো লিখেছে, কেবল অক্টোবর পর্যন্ত দেশজুড়ে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অন্তত দেড় হাজার ঘটনা পত্রিকায় এসেছে। মাদ্রাসাশিক্ষক থেকে পুলিশ পর্যন্ত—অভিযুক্তদের তালিকায় আছেন প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এসব ক্ষেত্রেও বিচারপ্রক্রিয়া হবে ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বর রাতের সুবর্ণচর ধর্ষণ-মামলার মতোই। বাংলাদেশের সব উন্নয়ন গল্প এসব ক্ষেত্রে এসে আর এগোয় না। নিপীড়িত মানুষের আহাজারিতে এখানে কোনো বৈচিত্র্য নেই। বৈচিত্র্য আসার লক্ষণও নেই।

এক বছর পার হলেও বহুল আলোচিত সুবর্ণচর মামলায় এখনো অন্তত ৭-৮ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বক্তব্য শোনা বাকি আছে আদালতের। এখনো ডাক্তার, পুলিশসহ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর জেরা হয়নি। নতুন বছরে সেই অধ্যায় শুরু হবে। তারপর জেলা আদালত থেকে হয়তো উচ্চ আদালতেও যাবে বিষয়গুলো।

আওয়ামী ১৭ জনের ১৪ জন এখনো হাজতে। সোহেল, স্বপনসহ তিনজন পলাতক। মাঝখানে একজন উচ্চ আদালত থেকে বিস্ময়করভাবে জামিনও পেয়ে গিয়েছিলেন। সেটা অবশ্য পরে বাতিল হয়েছে। তবে কারাগারে থাকা এবং পলাতকদের হয়ে ধর্ষিতার পরিবারকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার বিরাম নেই। কেবল এসব কারণেই অন্তত ১০টা জিডি হয়েছে চরজব্বর থানায়। কেবল ক্রমবর্ধমান এই জিডির সংখ্যাই বলে দেয়, ধর্ষকদের জন্য নিকটজনদের শক্তি ও সহানুভূতির জায়গা কত সক্রিয়। এটাই বাংলাদেশের ‘সমাজ’। ‘রাজনীতি’ ছাড়া নিশ্চয়ই এই দুর্বৃত্তপনা এত শক্ত জমিন পেত না।

সেই রাজনীতি জাতীয়ভাবে এক বছরের মধ্যে সুবর্ণচর অধ্যায়ের কথা ভুলেই গেছে। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা দলে দলে সুবর্ণচরে এসেছিলেন ২০১৯-এর জানুয়ারিতে। কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁদের মনোজগৎ থেকে জুবলী ইউনিয়নের দরিদ্র সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকের পরিবারটি অনেকটা হারিয়ে গেছে। কিছু টাকাপয়সা, কিছু জমির আশ্বাস পাওয়া গিয়েছিল তখন। কিন্তু যেটা জরুরি ছিল, দ্রুত বিচার পাওয়া এবং রাজনীতির পরিবর্তন, সেটা এখনো অধরাই থাকছে।

তবে কৌতূহলোদ্দীপক দিক হলো, রাজধানী ঢাকার চোখের আড়ালে পড়ে গেলেও সুবর্ণচর গণধর্ষণ মামলাটি আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন আইনি সংস্থার বিশেষ মনোযোগে রয়েছে। তারা ‘চাঞ্চল্যকর’ এই মামলার খবরাখবর জানতে ‘পর্যবেক্ষক’ রেখেছে স্থানীয়ভাবে। নিজেরা করি, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনও এই মোকদ্দমায় আক্রান্ত পক্ষকে আইনি সহায়তা দিচ্ছে।

এসব মিলিত প্রয়াস শেষে হয়তো এই মামলায় একটা রায়ও হবে। নিশ্চয়ই হবে। তারপর, কোনো পক্ষ থেকে আবার আপিলও হতে পারে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে রাজনীতির সঙ্গে লেপটে থাকা সর্বগ্রাসী দুর্বৃত্তপনার সংযোগ কঠোরভাবে বিচ্ছিন্ন করার প্রশ্নটি অমীমাংসিতই হয়তো থেকে যাবে। রাজনৈতিক বিবাদ ও ভিন্নমতের বিরুদ্ধে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার চিরতরে বন্ধ হওয়া জরুরি। সে-ই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ‘মোকদ্দমা’র বিচার করবে কে? সেই জাতীয় ঐকমত্যের ভার অমীমাংসিত অবস্থায় রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকছে। অথচ আবার শুরু হয়েছে বিভিন্ন স্থানে ভোটের তোড়জোড়। আরেক দফা ভোটের আগে সুবর্ণচরের সেই পরিবারটিকে ন্যায়বিচারের অনুভূতি দেওয়া বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য জরুরি ছিল। সেটা হতো একটা ভালো বার্তা।

আলতাফ পারভেজ: লেখক ও গবেষক।