নতুন বছরের শপথ

২০১৯ বছরটি বিদায় নিয়ে চলে গেল মহাকালের আদি অন্তহীন সময়ের অতল গহ্বরে। বিগত বছরের সাফল্য–ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে নতুন বছরটি সুখের হোক, শান্তিপূর্ণ হোক—সেটাই নববর্ষে মানুষের প্রত্যাশা।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বছরটি ছিল স্থিতিশীল। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারও যে পূর্ববর্তী সরকারের চেয়ে ভালো হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। তা সত্ত্বেও মানুষ চায় অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন। সেই আশা পূরণে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। তবে ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন যেমনই হোক, যে সরকার গঠিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, তা তাঁর আগের সরকারেরই ধারাবাহিকতা। ফলে সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলো নির্বিঘ্নে বাস্তবায়নে কোনো বাধা ছিল না।

বিগত বছরে রাজনীতি ছিল স্থবির। জনগণের সঙ্গে সরকারি দলের নেতাদের সম্পর্ক যেমন শিথিল, বিরোধী দলগুলোর নেতাদেরও তা–ই। বিরোধী দল দেশবাসীর সামনে বর্তমান সরকারের ভালো বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের সময় যে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয় বিভিন্ন বিরোধী দলের সমন্বয়ে, তাদের মধ্যে কোনো ঐক্য ছিল না। এমনকি ফ্রন্টের প্রধান দল বিএনপির মধ্যেও খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয়। বিরোধী শিবিরের দুর্বলতার সুযোগে উপকৃত হয়েছে সরকারি দল; কিন্তু সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। বিরোধী দলের দুর্বলতায় জনগণের মন জয় করা সহজ ছিল, কিন্তু সরকারি দলের নেতারা জনগণের ওপর নির্ভর না করে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করাই শ্রেয় মনে করেন।

গণতন্ত্রে জনগণের ক্ষমতায়নই মূল কথা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের ওপরই আস্থা রাখতে হবে। আমলাতন্ত্র গণতন্ত্রের বিকল্প নয়। বর্তমান রাজনীতিহীন অবস্থার জন্য শুধু সরকারি দলকে দায়ী করা যাবে না, বিরোধী দলের শোচনীয় ব্যর্থতাও দায়ী। সংসদীয় গণতন্ত্রে পাতানো বিরোধী দল বলে কিছু নেই।

বর্তমান বছরটি গুরুত্বপূর্ণ একাধিক কারণে। সরকার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন করতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপনেরও এটি প্রস্তুতির বছর। উপলক্ষ দুটি উদ্‌যাপনের কৃতিত্ব যদি শুধু সরকার ও আওয়ামী লীগ নিতে চায়, তাহলে উপলক্ষ দুটির মাহাত্ম্য কমে যাবে। মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বাড়ছে, দেশ উন্নত হচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে মানুষের প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা দ্রুততম সময়ে পূরণ না হলে অসন্তোষ বাড়বে। মধ্যশ্রেণি শুধু নয়, নিম্নমধ্যবিত্তরা আশা করবে ভালো শিক্ষা, শ্রমিক চাইবেন বাঁচার মতো মজুরি, কৃষক চাইবেন তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য, শিক্ষিত তরুণ চাইবেন উপযুক্ত কর্মসংস্থান, মানুষ চাইবে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা চাইবেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। এসব প্রত্যাশা পূরণ না হলে সমাজে অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। সব সময় অসন্তোষের ধরন এবং তার বহিঃপ্রকাশ একরকম হবে না। এবং তা দমনের প্রথাগত পদ্ধতিও ফলপ্রসূ হবে না।

জনকল্যাণকর রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে হলে কয়েক দশক আগের ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। আগে অতিদরিদ্রের অবস্থার বিষয়টি অগ্রাধিকার পেত, এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন প্রাধান্য পাচ্ছে। প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা ছাড়া তা অর্জন অসম্ভব।

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। সেটা যেমন সুখের বিষয়, তেমনি তার চ্যালেঞ্জও কম নয়। তখন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে রপ্তানিতে যে বাজার অগ্রাধিকার পায়, তা পাবে না। বাংলাদেশ এখন নমনীয় শর্তে ও কম সুদে যে বৈদেশিক ঋণসুবিধা পায়, তা কমবে। উন্নয়ন–সহযোগীদের থেকে অনুদানপ্রবাহ হ্রাস পাবে। রাজস্ব আয় না বাড়ালে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হবে।

গত ১৮ বছরের মধ্যে গত বছর রপ্তানি আয় সবচেয়ে কম। তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি। রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাত। এ খাতে বড় শিল্পগুলোরই প্রাধান্য, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো বিপন্ন। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে।

দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের দ্বারা অর্জিত অর্থবিত্তের অধিকারী মানুষেরা সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশার জন্ম দিচ্ছে। শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে তা বাধা। বিশ–পঞ্চাশ জন মানুষকে জেলে ঢুকিয়ে বা সাজা দিয়ে দুর্নীতির মতো কালব্যাধি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে শুদ্ধ করা সম্ভব নয়। দুর্নীতির দরজাগুলো বন্ধ করতে হবে। সে জন্য দরকার সামগ্রিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা।

অর্থনীতি বড় হচ্ছে, কিন্তু পুঁজি জোগানোর জন্য ব্যবসায়ীদের পুঁজিবাজারমুখী করা যায়নি। পুঁজিবাজার যথেষ্ট সম্প্রসারিত হয়নি। ইকুইটি বা স্থায়ী পুঁজি আসে পুঁজিবাজার বা ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যের পুঁজির অর্থ আসছে ব্যাংক থেকে। চরম অব্যবস্থাপনায় আমাদের ব্যাংকগুলো বর্ধিত পুঁজি জোগানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। কোনো কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। খেলাপি ঋণের বর্তমান অপসংস্কৃতি থেকে বেরোতে না পারলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের বিশৃঙ্খলা দূর হবে না। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতার অভাবে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বিচলিত। জনগণের অর্থ চুরি হচ্ছে, কোনো প্রতিকার নেই। ব্যাংকগুলোর সত্য ও তথ্য গোপন করার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ জন্য দরকার সামগ্রিক সংস্কার।

বাংলাদেশ আজ বহু রকম বিপদের মুখোমুখি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ একটি ‘মানবিক রাষ্ট্র’ হিসেবে বহির্বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু এই মারাত্মক সমস্যা সমাধানে শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বলতা চোখে পড়ার মতো। আমাদের সমস্যা অন্যদের বোঝানোর সক্ষমতা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনীতিকদের বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মোটের ওপর ভালো। তেমন পররাষ্ট্রনীতি অবশ্যই ভালো যে আমরা কারও পক্ষে নই, কারও বিরুদ্ধে নই। সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু তার অর্থ যদি হয় আমাদের বিপদে কাউকে পাশে পাব না, তা কূটনৈতিক ব্যর্থতা। রোহিঙ্গা সংকট থেকে আমরা সেই শিক্ষা পেয়েছি।

ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ্য মানুষ তৈরি হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আজ বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার অবস্থা শোচনীয়। মেধাবী শিক্ষার্থীর অভাব নেই। তাঁদের যুগের উপযোগী শিক্ষা দেওয়ার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত অভাব। ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮টিতে উপাচার্য নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের প্রতাপ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চেয়ে বেশি। এ অবস্থার ইতিবাচক উন্নতি না হলে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ যুবশক্তি। তাঁদের একটি বড় অংশ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। তাঁদের অনেকেই আজ হতাশায় ভুগছেন। কর্মসংস্থানের অভাব। চাকরিবাকরি নেই। স্বাধীন ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন, সে পরিবেশ অনুকূল নয়। শুধু সে জন্য নয়, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে তাঁরা হতাশ।

বৈদেশিক মুদ্রার ২২ শতাংশ আসে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ থেকে। সেই শ্রমবাজারও বাংলাদেশিদের জন্য সংকুচিত হয়ে আসছে। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে বর্তমান সরকার। প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু বন্ধ করতে হবে তাঁদের বিমানবন্দরে হয়রানি। প্রতারক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সাতটি দেশের একটি বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে অর্থায়নের জন্য দক্ষতার সঙ্গে দেনদরবার জরুরি। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে যোগ দিতে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের আগ্রহ যতটা, তাতে গিয়ে দক্ষতার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রয়োজন তুলে ধরতে ততটা দেখা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা বাংলাদেশ একা মোকাবিলা করতে পারবে না।

অবৈধ দখল-দূষণে পরিবেশ বিপর্যস্ত। নদ-নদী ভরাট করছেন প্রভাবশালীরা। দখলমুক্ত করতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে প্রভাবশালীদের কাছে যদি প্রশাসন আত্মসমর্পণ করে, তাহলে এ উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলা সত্ত্বেও ফসলি জমিতে ইটভাটা হচ্ছে। তাদের কিছুটা জরিমানা করাই যথেষ্ট নয়। নিতে হবে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ধুলায় ধূসরিত ঢাকা নগরীকেও বসবাসযোগ্য করার শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি সরকারের আচরণ সংযত ছিল না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত প্রচুর। সমাজের সব স্তরে ক্ষমতাশীলদের ক্ষমতার প্রকাশ সংবিধানসম্মত ও সংযত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

সরকার জঙ্গিবাদ দমন করেছে। এখন দরকার হিংসা ও সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে দলমত–নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা। সেটাই হোক নতুন বছরে জাতির শপথ।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক