চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে টিকতে হলে

এই চ্যালেঞ্জে উতরাতে না পারলে নতুন শিল্পবিপ্লব আমাদের ফেলেই এগিয়ে যাবে।
এই চ্যালেঞ্জে উতরাতে না পারলে নতুন শিল্পবিপ্লব আমাদের ফেলেই এগিয়ে যাবে।

মানবসভ্যতা দীর্ঘ যাত্রার ভেতর দিয়ে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে এসেছে। এই যাত্রায় মানুষ সব সময়ই কারিগরিভাবে উন্নত উপায়ে শিল্প উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাগত রূপান্তর ঘটিয়ে চলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই রূপান্তরের প্রস্তুতিতে ব্যাপকতা এসেছে এবং তা অভাবিত গতিতে একটা প্রযুক্তিগত বিপ্লবের দিকে যাচ্ছে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কী?
এক-একটি শিল্পবিপ্লব পাল্টে দিয়েছে সারা বিশ্বের শিল্প উৎপাদন, বাজার ও ব্যবসার সমুদয় গতিপথ, পাল্টে দিয়েছে মানবসভ্যতার ইতিহাস ও মানুষের জীবনাচরণ। প্রথম শিল্পবিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ। বর্তমানে শুরু হওয়া আরেকটি শিল্পবিপ্লব ছাড়িয়ে যেতে পারে আগের তিনটি বিপ্লবকে। মোটাদাগে বলা চলে, এখন পর্যন্ত মানব জাতি চারটি শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে হেঁটেছে।

প্রথম শিল্পবিপ্লব উৎপাদনের যান্ত্রিকীকরণে পানিপ্রবাহ এবং বাষ্পশক্তি ব্যবহার করে। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবে বৃহত্তর উৎপাদনে বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহৃত হয়। তৃতীয়টি শিল্পবিপ্লবে উৎপাদনকে স্বয়ংক্রিয় করতে ইলেকট্রনিকস এবং তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগায়। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ভিত্তিমূলের সঙ্গে নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়ে এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ঘটে চলছে। এটা অতিবর্ধিত পরিসরের শিল্পবিপ্লব এবং দ্রুত বিকাশমান ডিজিটাল বিপ্লব, যা গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই ঘটে চলেছে। বহু ধারার প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের এই মিশ্রণ বা যোগফল (Fusion Technology) বৈশিষ্ট্যগতভাবে শারীরিক, ডিজিটাল ও জৈবিক ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে সমন্বয় করবে, এদের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনবে কিংবা কিছু ক্ষেত্রে বিদ্যমান সম্পর্কগুলো আরও জটিল ও অনিয়ন্ত্রিত করে তুলবে।

আমরা একটি প্রযুক্তিগত বিপ্লবের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। এর মাধ্যমে আমাদের জীবনযাত্রার, কাজ করার এবং একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সম্পর্কিত হওয়ার পথ ও পদ্ধতিগুলো মৌলিকভাবে বদলে যাব।

বহু উদীয়মান প্রযুক্তির সঙ্গে পঞ্চম প্রজন্মের টেলিকম প্রযুক্তি যুক্ত হয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফিউশন প্রযুক্তির দুয়ার খুলে যাচ্ছে। এ রকম কিছু প্রযুক্তির কথা বলতে গেলে চলে আসবে বহু নাম। যেমন এজাইল বিজনেস প্রসেস, রোবটিকস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন, ত্রি-ডি প্রোডাকশন, পঞ্চম প্রজন্মের টেলিকম, স্মার্টফোনের রিয়েল অ্যাপ্লিকেশন, ইন্টারনেট অব থিংস (IoT), ম্যাসিভ কানেকটিভিটি, ম্যাসিভ ট্র্যাকিং, দূর নিয়ন্ত্রণ, স্যাটেলাইট ইন্টারনেট, ফাইভ-জি ড্রোন, ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, বিগ ডেটা ও মেশিন লার্নিং, ক্লাউড ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের ব্যাপকতা, চালকবিহীন গাড়ি, ফিনটেক ফাইন্যান্স, ব্লকচেইন ও ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি, পেমেন্ট সিস্টেম থেকে জৈবপ্রযুক্তি, রিমোট সার্জারি ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই সবকিছু মিলে নতুন এক শিল্পবিপ্লবের জয়যাত্রা শুরু হয়েছে সারা বিশ্বে। একেই বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।

জনসংখ্যা-সুফলের সুযোগ ও শঙ্কা
বাংলাদেশে এখন জনসংখ্যার একটা বড় অংশ তরুণ ও কর্মক্ষম অর্থাৎ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পর্যায়ে। এর সুবাদে বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই চতুর্থ বিপ্লবের রূপান্তর প্রক্তিয়াগুলোর মধ্যে দিয়ে কিংবা এর প্রভাববলয়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হবে। এ জন্য দরকার বহুমুখী কৌশলগত, কারিগরি ও অবকাঠামোগত প্রস্তুতি। এ নতুন শিল্পবিপ্লব থেকে বাংলাদেশকে উৎপাদনশীলতার সুফল নিতে হবে, বৈদেশিক রপ্তানি আয় বাড়ানোর সুযোগ নিতে হবে, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হবে। এসব দিকে পিছিয়ে পড়া মানে সুফলগুলোর বুমেরাং হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ সুযোগটা নিয়ে যাবে অন্য কোনো দেশ আর আমরাও হারাব আমাদের গতানুগতিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো। সুতরাং সুফল ঘরে নিতে চাইলে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে কৌশলগতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। অর্থাৎ বিদ্যমান স্বল্প দক্ষ শ্রমবাজারকে নতুন দক্ষতার শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থানের উপযোগী করে গড়ে নিতে হবে। এই চ্যালেঞ্জে উতরাতে না পারলে নতুন শিল্পবিপ্লব আমাদের ফেলেই এগিয়ে যাবে।

শ্রম ও শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি তো?
বাংলাদেশ মূলত কৃষিশ্রমিক, তৈরি পোশাক শিল্পশ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিক—প্রধানত এই তিন খাতের স্বল্প দক্ষ শ্রমিকসর্বস্ব মানবসম্পদ দ্বারা চালিত অর্থনীতির দেশ। এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা এখন পর্যন্ত টেকসই ও গুণগত ভিত পায়নি। ১৮ থেকে ১৯ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে জীবনযাত্রা ও কর্মসংস্থান ব্যাপকমাত্রায় প্রতিযোগিতামূলক। ফলে সরকারের শিক্ষা-সংশ্লিষ্টতা যা-ই থাক না কেন, সরকারি-বেসরকারি-ব্যক্তি-আন্তর্জাতিক চতুর্মুখী উদ্যোগের মিশেলে স্বল্প দক্ষ ও মোটামুটি দক্ষ শিল্পশ্রমিক তৈরির প্রক্রিয়া যেনতেনভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের কৃষি অদক্ষ শ্রমিককেন্দ্রিক ও অনেকটাই অযান্ত্রিক থাকা সত্ত্বেও অনেকটাই উৎপাদনমুখী ধারায় উন্নীত হয়েছে। তাহলেও নতুন শিল্পবিপ্লবের নতুন নতুন কারিগরি সক্ষমতা থেকে আমরা দূরে।

দুনিয়ায় ঘটে চলেছে অভাবিত সব অটোমেশন, দূর নিয়ন্ত্রিত কিংবা স্মার্ট ফোন ও স্মার্ট ডিভাইস-কেন্দ্রিক সহজিয়া ব্যবস্থাপনা। এত সব উৎপাদন সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনাগত উন্নতির বিপরীতে আমাদের কৃষি, শিল্প, বিপণন ও পরিবহন ব্যবস্থা, শ্রমবাজার পিছিয়েই আছে।

এ ধরনের অ-টেকসই উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ, ব্যাংকিং, বন্দর ও রপ্তানি ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা এবং সর্বোপরি আমাদের অবিকশিত শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, এখনই তার উপলব্ধি শাণিত করা চাই। পাশাপাশি এই পণ্য ও সেবা ব্যবস্থাপনার খাতগুলোতে কী কী সম্ভাবনার দুয়ার অবারিত হবে, তা আবিষ্কার ও উপলব্ধির মধ্যে আনাও জরুরি। স্বল্প দক্ষ শ্রমবাজারের ভিত্তিতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বনিয়াদ গড়ে উঠেছে বলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারিগরি উৎকর্ষ ও রূপান্তর থেকে আমরা অনেক দূরে। এই বিশাল শ্রমবাজার ঠিক কী কী ঝুঁকি, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার মুখোমুখি হবে, সেসবের নিরন্তর গবেষণা এখন সময়েরই প্রয়োজন।

অর্থাৎ আমাদের স্পষ্ট করতে হবে যে কোথায় কোথায় আমাদের সম্ভাবনা বাড়বে এবং কোথায় কোথায় বর্তমানের অর্জনগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। আমাদের অবকাঠামোগত ও কৌশলগত পরিকল্পনা এবং শিক্ষা, শিল্প উৎপাদন ও বাজার বিকাশের দিক থেকে আমাদের প্রস্তুতিগুলোই বা কেমন হওয়া দরকার, তা জানা।

টিকতে হলে বদলাতে হবে
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের জীবনযাত্রা, কাজ করার এবং একের সঙ্গে অপরের সম্পর্কিত হওয়ার মৌলিক পদ্ধতিগুলো আমূল পরিবর্তন করে দেবে। শিল্প উৎপাদনগত দিক থেকে এটি মানব বিকাশের একটি নতুন অধ্যায়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এটা শারীরিক, ডিজিটাল এবং জৈবিক জগৎকে এমনভাবে একাকার করবে, যা নতুন সম্ভাবনার পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত ভয়াবহ বিপদেরও জন্ম দিতে পারে। ফলে বিপ্লবের গতি, পরিসর এবং গভীরতা ঠিক কীভাবে বিকশিত করা উচিত, তা নিয়ে বিশ্বের দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্যাপক অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ জরুরি। নতুন প্রযুক্তিগুলোর কাজ কীভাবে মানবিক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করবে, জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ সমুন্নত রাখবে এবং রাষ্ট্রে, সমাজে ও ব্যবসায়ে মানবিকতা, দেশে দেশে ধর্মীয় মূল্যবোধের সহনশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি নতুন মূল্যবোধ তৈরি করবে, তার পর্যালোচনাও চলছে বিশ্বজুড়ে। এমনকি মানুষ হওয়ার অর্থ ভবিষ্যতে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে; সে বিষয়ে বোঝাপড়াও দরকার। এ অবস্থায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিককেন্দ্রিক ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য বাংলাদেশ সরকার, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের সবাইকে কাজ করতে হবে।

ফাইজ তাইয়েব আহমেদ: সুইডেনের ভোডাফোনে কর্মরত প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।