অস্ট্রেলিয়ার নিরোও বাঁশি বাজান

ঝড়, ঝঞ্ঝা, বন্যা, দাবানল দেখে মনে হতে পারে, এ সবই প্রকৃতির খেয়ালি আচরণ। কিন্তু না, প্রকৃতি খুবই হিসাবি। বারংবারই হিসাব নিয়ে প্রকৃতি ফিরে আসে। সব লেনাদেনা কড়ায় গন্ডায় চুকিয়ে তবেই প্রকৃতি শান্ত হয়। প্রকৃতির ওপর যতটা অত্যাচার মানবসভ্যতা করবে, ঠিক ততটুকুই ফিরে আসবে নানাভাবে, নানা ভঙ্গিমায়। কখনো সিডর হয়ে আছড়ে পড়বে। সময়-সময় সুনামি হয়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। অতিবৃষ্টিতে প্লাবিত করবে সবকিছু। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে চরাচর। অনাবৃষ্টির খরায় তপ্ত করে করতে তুলবে এই ধরাদাম। এরই মাঝে দাবানলের রূপ নিয়ে এসে ভস্ম করে দেবে সবকিছু।

কয়েকজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল অস্ট্রেলিয়ার দাবানল নিয়ে। এর কারণ কি জলবায়ু পরিবর্তন? বছরের এই সময়টাতে অস্ট্রেলিয়ায় এমনিতেই ঝোপজঙ্গলে আগুন ধরে যায়। কিন্তু এ বছর দাবানলের তীব্রতা অন্যান্য বছরের থেকে অধিক ধ্বংসাত্মক। ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছিল সিডনির বেলাভূমি। ২৪ জন এই দাবানলে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে উদ্ধারকর্মীও আছেন। এখনো অনেকে নিখোঁজ। কমবেশি ১২ শতাধিক ঘরবাড়ি ভস্মীভূত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৪ মিলিয়ন একর জমির বনজঙ্গল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বেলজিয়াম ও হাইতির সম্মিলিত আয়তনের বেশি পরিমাণ জায়গা অস্ট্রেলিয়ায় পুড়েছে। জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়। ঠিক কতখানি অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তা বলা সম্ভব না। এই ক্ষয়ক্ষতি সংখ্যা দিয়ে নির্ণয় করা সম্ভব না।

প্রকৃতির বেপরোয়া আচরণ কেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাবদাহ, দীর্ঘস্থায়ী খরা ও শুকনো বাতাসের সম্মিলনে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে। প্রচণ্ড দাবদাহে অস্ট্রেলিয়া এবারের গ্রীষ্মে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। বাতাসের গতিবেগও এবার বেশি ছিল। সোমবারও বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬০ মাইল। এই বাতাস অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে ভস্ম ও ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়েছে। গত তিন বছরের মধ্যে এবারের ডিসেম্বর ছিল সব থেকে উষ্ণ। এবার মধ্য ডিসেম্বরের গড় তাপমাত্রা ছিল ৪১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ডিসেম্বরে ইতিহাসের সব থেকে বেশি তাপমাত্রা এবার অস্ট্রেলীয়বাসী ভোগ করেছে। অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া বিভাগের তথ্যানুসারে, ১৯২০ সালে থেকে ক্রমাগত অস্ট্রেলিয়ার তাপমাত্রা বাড়ছে। সব মিলে ১২০ বছরের মধ্যে সব থেকে শুকনো বসন্ত এসেছিল এবার অজিদের জীবনে। ২০১৭ সাল থেকেই ক্রমাগত বৃষ্টির পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে। এই পরিস্থিতে শুকনো গাছ, লতা ও ঘাস আগুনের আদর্শ স্থানে পরিণত হয়েছিল।

তবে জলবায়ুর পরিবর্তনকেই বিশেষজ্ঞরা অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের একমাত্র কারণ বলে মনে করছেন না। কিন্তু অন্যতম কারণ হিসেবে মানছেন। জলবায়ু পরিবর্তনই অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়াকে খেপিয়ে তুলেছে। আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণই দাবানলের সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি করছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

অস্ট্রেলিয়া পুড়ছে স্কট মরিসন ঘুরছে
ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্থান যখন আগুনে জ্বলছে, প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে তখন অবকাশ যাপন করছিলেন। যেন একালের নিরো। রোম পুড়ে যাচ্ছে, তাতে নিরোদের থোড়াই কেয়ার। তাকে তো বাঁশি বাজাতে হবে। বিষয় হচ্ছে, তখন নিরো ছিল একজন। এখন দিকে দিকে নিরো। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাব যখন চাক্ষুষ, জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করা জরুরি তখন এক-এক নিরো এক এক আচরণ করছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। প্রবৃদ্ধি, উন্নতির কথা বলে চীন-ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো গ্যাস নিঃসরণ করেই যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের বৃহৎ কয়লা উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশ। কয়লা ব্যবসায়ীরা অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় রাজনীতিতে আরও প্রভাবশালী হচ্ছেন। স্বেচ্ছা নিঃসরণ হ্রাসের প্যারিস সমঝোতাকে অস্ট্রেলিয়া নেতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনা করে।

জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে যখন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো জরুরি, তখন চলছে তামাশার জলবায়ু সম্মেলন। এই জলবায়ু সম্মেলন কোনো কার্যকর ফল দিতে পারেনি। আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণে বিশ্ববাসী ভুগছে। অস্ট্রেলিয়া একদিকে দাবানলে পুড়ছে, অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া বন্যার পানিতে ভাসছে। বাংলাদেশেও স্বাভাবিকের থেকে কম তাপমাত্রার শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে কয়েকবার। দেশেও শীতের আচরণ বদলে যাচ্ছে। বলতে গেলে গোটা মৌসুমে তেমন শীত থাকে না। কিন্তু মাঝেমধ্যেই শৈত্যপ্রবাহ এসে হানা দেয়। গণমাধ্যমে দেখলাম, কখনো কখনো তাপমাত্রা ৫-৬ ডিগ্রিতে নেমে আসে। শীতের এটা স্বাভাবিক আচরণ না।

ইউরোপের দেশগুলোতে আবার গ্রীষ্মের মেয়াদ বাড়ছে। গ্রীষ্মে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা এখন। ওদিকে শীতে তুষারপাত কম হচ্ছে। আবার যখন হচ্ছে তখন তুষারের স্তূপ জমে যাচ্ছে। আবহাওয়ার এই অস্বাভাবিক আচরণে জলবায়ু কূটনীতি আমাদের জন্য কোনো সমাধান আনতে পারেনি। কিছু কিছু দেশ ও সংস্থার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। ফি বছর বিদেশ সফরের সুযোগ করে দিয়েছে জলবায়ু সম্মেলনের নামে। কিছু সাধারণ মানের গবেষণা হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে। কুমিরের বাচ্চা দেখানোর মতো করে একই গবেষণা বারবার দেখিয়ে বেসরকারি সংস্থা, গবেষণা সংস্থা, এনজিও তহবিল আদায় করে নিচ্ছে। এ ছাড়া আর তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি জলবায়ু সম্মেলন। বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি ও বৃহৎ কূটনৈতিক তৎপরতা হচ্ছে জলবায়ু সম্মেলন। আবার কূটনীতির ইতিহাসে অন্যতম ব্যর্থতার নজিরও হচ্ছে জলবায়ু সম্মেলন।

প্রকৃতির দাপট চিরস্থায়ী
সিডর, আইলা, নার্গিস, ক্যাটরিনা, প্লাবন, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা বারবার ফিরে আসছে। বলা হতে পারে, ঝড়, বন্যা, দাবানল তো প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু প্রকৃতি একই আচরণ যখন ঘন ঘন করতে থাকে, তখন তা চিন্তার বিষয় বৈকি। প্রকৃতির ওপর অতিরিক্ত চাপ দিলে প্রকৃতি তখন অস্বাভাবিক আচরণ করবে, এটাই স্বাভাবিক ও চিরন্তন। লোভী, মুনাফা ও প্রবৃদ্ধিনির্ভর অর্থনীতি ও উন্নয়নের চক্করে পড়ে আমরা প্রকৃতিকে বিনাশ করে দিচ্ছি। সম্প্রতি আমাজনে ও ক্যালিফোর্নিয়াতেও দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল। কোথাও মনুষ্যসৃষ্ট। কোথাও প্রকৃতি আপন প্রতিশোধ নিচ্ছে। মানুষ শুধু প্রকৃতিরই বিনাশ করছে না, মানুষও তার নিজের বিনাশ ডেকে আনছে।

সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা করেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলে জানলাম, সুন্দরবনকে ঘিরে বিশাল এক শিল্প বলয় গড়ে উঠছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা না হয় বাদই দিলাম। উন্নয়নের লোভের ফাঁদে পড়ে সুন্দরবন যদি না থাকে, তবে সিডর-আইলা এলে কী হবে? ওরা তো বারবার আসবেই। সুন্দরবন যত ধ্বংস হবে, ওদের আগমনের পরিমাণও তত বেড়ে যাবে। আর দিন শেষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মানুষের বাড়বে। সুন্দরবন না থাকলে এই শিল্প বলয় এক নিমেষেই ধসে যাবে সিডরের মুখে। সুন্দরবন, আমাজন ধ্বংস করে ক্যালিফোর্নিয়া, সিডনি, রিও ডি জেনিরো, খুলনা কোথাও কেউ নিরাপদে থাকবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে হুঁশ ফেরাবে কে? এখন যে নিরোদের সংখ্যাই বেশি। যতই প্রকৃতি ধ্বংস হোক না কেন, নিরোরা উন্নয়নের বাঁশি বাজিয়েই যাচ্ছে। এই নিরোরা উন্নত, স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল সব দেশেই বিরাজমান।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন