বারুদের স্তূপে মধ্যপ্রাচ্য

কাশেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ড ইরানিদের এক করেছে
কাশেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ড ইরানিদের এক করেছে

প্রায় দুই দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত, যা তুঙ্গে ওঠে ২০০৩-এ ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান ও সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের পর। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছিল, সাদ্দাম ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র মজুত করেছেন। তাঁকে উৎখাত করার পর প্রমাণিত হয় সে রকম কোনো অস্ত্র ইরাকে ছিল না।

 ২০১০ সালে কথিত আরব বসন্তের জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধকে উসকে দেয়। এরই মধ্যে ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামের সন্ত্রাসী গ্রুপের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আইএস দমনের নামেই যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের সাতটি দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ চালায়। সাদ্দামের পতন, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও আইএসের শক্তি সঞ্চারের প্রেক্ষাপটে ইরাকে ইরান-সমর্থিত শিয়া শক্তির উত্থান ঘটে।

 ২০২০ সালের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে ৩ জানুয়ারি এক ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের ‘কুদস মিলিশিয়ার’ প্রধান কাশেম সোলাইমানি ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া ‘পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সের প্রধান আবু মেহদি আল-মোহান্দিসকে হত্যা করা হয়।

পশ্চিমা সমর বিশারদের মতে, মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানি বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম ভূ-রণকৌশল বিশারদ ছিলেন। ট্রাম্প তাঁকে একজন সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করলেও তা হালে পানি পায়নি। বিশ্ব জনমত এ হত্যার নিন্দা করেছে। রাজনৈতিকভাবে ইরান লাভবান হয়েছে।

ইরান এ হত্যার প্রতিশোধ নিতে বেশি সময় নেয়নি। জেনারেল সোলাইমানিকে লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে শহর কিরমানে দাফন করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ইরাকের কুর্দি অঞ্চলের রাজধানী ইরবিলের কাছে দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ৮ জানুয়ারি ভোরে ইরান প্রথমবারের মতো ১২টি ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ করে। এই হামলার মধ্য দিয়ে ইরান তাদের শক্তির জানান দিয়েছে।

ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল যুক্তরাষ্ট্রকে হতবাক না করলেও দুটি বিষয় নতুনভাবে তাদের সামরিক কৌশল নির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলেছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেই ইরানের সামরিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ ও আধুনিক মিসাইল টেকনোলজির প্রয়োগ। দ্বিতীয়ত, পার্লামেন্টের অনুমতি নিয়ে সরাসরি আক্রমণ করার মতো সাহস দেখিয়েছে ইরান। এ জন্য তারা কোনো প্রক্সি ফোর্স (সহায়ক বাহিনী) ব্যবহার করেনি। এর মাধ্যমে ইরান প্রতিশোধ নিয়েছে ও তাদের তাৎক্ষণিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কোনো পাল্টা পদক্ষেপ নেয়নি।

ইরান মিসাইল হামলার পরপরই হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র কথিত ইরানের ৫২ স্থানের কোথাও পাল্টা হামলা চালানো হলে ইরানের পরবর্তী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ও ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শহর ও বন্দর হাইফাতে। ইসরায়েলের হাইফাতে আক্রমণের ছক শুধু ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের হাতেই নয়, লেবাননের হিজবুল্লাহর কাছেও আছে। দুবাইয়ে আক্রমণ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকেই নয়, সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতে দারুণ চাপের সৃষ্টি করবে। তেমনি ইসরায়েলের বন্দর-শহর, সবচেয়ে জনবহুল, হাইফাতে আক্রমণ সে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করতে পারে।

ইরানের মিসাইল আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রকে যে এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র শাহের পতন দেশটিতে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে। এই বিরোধ তুঙ্গে ওঠে ৪ নভেম্বর ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস দখলের পর। এই জিম্মিদশা ৪৪৪ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল। উল্লেখ্য, জিম্মিদের সংখ্যা ছিল ৫২ এবং যাদের স্মরণেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫২ টার্গেটের আক্রমণের কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন।

জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সমরবিদদের ধারণাও ছিল না যে এই একজন মানুষের হত্যা প্রতিক্রিয়া এই মাত্রায় হতে পারে। ইরানে এমন আবেগ তৈরি হবে, তার ধারণা শুধু যুক্তরাষ্ট্র, তথা বিশ্ববাসীকেই নয়, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ইরানের শাসকদের ধারণাও ছিল না। সমগ্র ইরান শোকে শোকাতুর হয়েছিল। শহরের রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য হয়েছিল। সোলাইমানি এবং ইরাকের কমান্ডার আল-মোহদ্দিসের জন্য ইরাকেও সমাবেশ হয়েছে। লেবাননে বিশাল সমাবেশের মধ্যে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদের প্রতিশোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। উল্লেখ্য, হিজবুল্লাহর জন্য প্রয়াত কাশেম সোলাইমানি শুধু প্রশিক্ষকই ছিলেন না, ছিলেন বড় মাপের সমরবিদ।

কাশেম সোলাইমানির হত্যার পর ইরাক থেকে ইরান পর্যন্ত তাঁকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে মানুষের যে আবেগ এবং ঢল নামিয়েছিল, তেমন ইরানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ঘটেনি। কাজেই ইরানিদের আবেগকে সরকারের পক্ষে ধরে রাখতে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে জবাব দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে কাশেম সোলাইমানিকে যেভাবে অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা হয়েছিল, তা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সিংহভাগ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ক্যালিফোর্নিয়ায় সবচেয়ে বড় ইরানি-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর মধ্যে শঙ্কাও তৈরি করেছে। বেশির ভাগ ইরানি-আমেরিকান এ হত্যাকে খামখেয়ালি বলে মনে করে। তাদের শঙ্কা, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তাদের অবস্থানও দুর্বল হতে পারে।

যা-ই হোক, ইরানের নীতিনির্ধারকেরা যেভাবে মিসাইল হামলা পরিচালনা করেছেন, তা মধ্যপ্রাচ্যকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তবে ইরান এই হামলায় ৮০ জন সৈন্যের মৃত্যুর দাবি করলেও যুক্তরাষ্ট্র বলছে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সে কারণেই হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর টুইটে বলেছেন, ‘সো ফার সো গুড’।

দুই পক্ষকেই শান্ত হতে বলেছে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ। কোনো সন্দেহ নেই যে ইরান বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সামরিক দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। মিসাইল আক্রমণ এর সামান্য নমুনা। ইরান খুব অল্প সময়ের মধ্যে পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হতে পারে, যে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলসহ ইউরোপের দেশগুলো ভালো করেই অবহিত হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের এই বিরোধের কারণে সংকটে পড়েছে ইরাক। দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি এবং প্রায় ১০ হাজার সৈনিক মোতায়েন রয়েছে। ইতিমধ্যেই ইরাকের পার্লামেন্ট সে দেশ থেকে সমস্ত বিদেশি সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব নিয়েছে এবং এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারকে দিয়েছে। এ নিয়ে ইরাক ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সংঘাতে ইরাক শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হবে না, অনিচ্ছা সত্ত্বেও জড়িয়ে পড়বে। ইরাক এখনো ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হতে পারেনি। আইএসের উত্থানের পর কাশেম সোলাইমানির নেতৃত্বে ইরাকের মিলিশিয়ারা আইএসকে ইরাকে এবং সিরিয়ায় পরাস্ত করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।

ইরানিদের কাশেম সোলাইমানিকে শ্রদ্ধা করার বড় কারণ হলো তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে ইরান আইএসের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের পরাজয়ে ইরানি কুদস মিলিশিয়া বা রেভল্যুশনারি গার্ডের এই এলিট ফোর্স এবং ইরাকি মিলিশিয়াদের অবদানই সবচেয়ে বেশি বলে বিবেচনা করা হয়।

এমতাবস্থায় ইরাকের পক্ষে ইরানকে সমর্থন না করা ছাড়া কোনো পথ নেই। যদিও ইরানের সুন্নি সংখ্যালঘুরা এ যুদ্ধে জড়াতে চাইছে না। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে স্পষ্টতই জানিয়েছে যে ইরাক ছাড়ার কোনো অভিপ্রায় যুক্তরাষ্ট্রের নেই। এই পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, ইরাক যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিকে দখলদার বাহিনী আখ্যা দেবে কি না। তেমনটা হলে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান সংকট আরও কঠিন হয়ে পড়বে। জেনারেল কাশেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত হতে না দেওয়ার চাবিকাঠি এখন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। বিশ্ব ভূকৌশলগত বিষয়ে সবচেয়ে অনভিজ্ঞ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি আবার ভুল করেন, তবে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির কারণে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতে ধস নামবে। সে চাপ যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়ার ক্ষমতা নেই। এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে তার অবস্থান বজায় রাখার বিষয়টিকে অধিকতর ন্যায্যতা দিতে হলে আইএসের ধুয়া তোলার প্রয়োজন পড়তে পারে। এমন বাস্তবতায় আইএস মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাদের নতুন তৎপরতার খবর প্রকাশ পাচ্ছে। কাশেম সোলাইমানি হত্যা এবং ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতের মধ্যে তৈরি শূন্যস্থান পূরণে তৎপর হবে আইএস এবং এমন পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখার বৈধতা নিতে কুণ্ঠিত হবেন না ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংকটের কূটনৈতিক সমাধান না হলে আইএসের উত্থানের আশঙ্কা থেকেই যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সরাসরি ইরান আক্রমণের মতো ভুল করবে না, কারণ আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পরাজয় খুবই সাম্প্রতিক ঘটনা। ভিয়েতনাম অভিজ্ঞতা রয়েছে পেন্টাগনের সামনে। ইরান অত সহজ বা সামরিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্র নয়। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের মাধ্যমে দীর্ঘ যুদ্ধ চালিয়েও ইরানের সরকারকে কাবু করতে পারেনি বরং আরও শক্তিশালী করেছিল। কাশেম সোলাইমানির হত্যার ঘটনা সাধারণ ইরানিদের শাসকদের পতাকাতলে একত্র করেছে এবং হাতকে শক্তিশালী করেছে।

যা-ই হোক, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি যাতে শান্ত থাকে, সেটাই সবার কাম্য। দুই পক্ষকেই যুদ্ধ পরিহার করে আলোচনার পথ ধরতে হবে, তবে এর সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এ সংকটের মূলে। তিনি যদি সঠিক সিদ্ধান্ত না নেন, তবে বিশ্বব্যাপী নতুন ও বিপজ্জনক সংকটের তৈরি হবে।

. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে এনএসইউর অনারারি ফেলো
[email protected]