ভাষার কঠিন বাঁধনে স্কুল পাঠ্যবই

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

এমনিতেই পাঠ্যবই চরম বিরক্তিকর। তার ওপর তা যদি পণ্ডিতের লেখা হয়, তবে তো কথাই নেই। রবীন্দ্রনাথ পণ্ডিতের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে স্কুলই ছেড়েছিলেন। বিলেত পাঠিয়েও তাঁকে ব্যারিস্টারি পড়ানো যায়নি। 'ডাকঘর' লিখে তিনি অমলের মুখে উঠিয়ে দেন পণ্ডিতের প্রতি তাঁর বিরাগের বার্তাটিই, ‘আমি পণ্ডিত হব না।’ তপোবনের আদলে গড়ে তোলা শান্তিনিকেতন আশ্রমে শিশুদের পড়ানোর জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘সহজপাঠ’ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি জড়ো করেছিলেন তেমন শিক্ষকদের, যাঁরা কঠিন বিষয়ও সহজ করে লিখতে, বলতে পারতেন। বার্নার্ড শ তাঁর বই পাঠ্যপুস্তকের তালিকায় দিতেই রাজি হননি। তাঁর কথায়, তিনি শিশু নির্যাতনের নিদান নাকি আয়ত্তই করতে পারেননি; তো তেমন বই লিখবেন কী করে? শৈশব-কৈশোরের সব আনন্দ কেড়ে নেওয়ার জব্বর হাতিয়ার যদি পাঠ্যপুস্তক হয়, তবে পরীক্ষা হলো ফাঁসির দড়ি।

স্বাধীন বাংলাদেশে উল্টোরথের সওয়ারি আমরা। আমাদের শিশুদের মহা বিদ্বান বানানোর কসরতের শুরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় পণ্ডিতদের নামে বই লিখিয়ে। তাতে কার কার কোন কোন স্বার্থ সিদ্ধ হয়, সে তরজায় না গিয়েও বলা যায়, শিশুর দফারফা হয় আঠারো আনাই। মনে করে দেখুন, গত বছর পাঠ্যপুস্তকে দেদার ভুলের তোপ যখন গর্জে ওঠে, তখন সংবাদকর্মীদের প্রশ্নে জেরবার দুজন খ্যাতিমান অধ্যাপক কবুল করলেন, তাঁরা নাকি তাঁদের নামে ছাপা বই দেখারই সময় করে উঠতে পারেননি! বই লেখার কাজ যখন চলছিল, তখন একজন তো মার্কিন মুলুকে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। অথচ বইগুলোতে তাঁদের নাম জ্বল জ্বল করছিল। সে বই প্রকাশ করেছিল দেশে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি তক পাঠ্যবই প্রকাশের একচেটিয়া কারবারি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড তথা এনসিটিবি!

আমাদের শিশুদের পাঠ্যবই লেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডা গন্ডা অধ্যাপক ভাড়া করা যেন দস্তুর এখন। একে তো বিষয়বস্তু এত কঠিন যে তাতে আমাদের স্কুলশিক্ষকদেরই বত্রিশ পাটি দাঁত খসে যাওয়ার জোগাড়, তার ওপর ভাষার বিদ্যাসাগরীয় তাণ্ডব তা ইস্পাতের মতো কঠিন করে ফেলে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, অন্তত দশক তিনেক আগেও যাঁরা গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন তাঁদের বাপেরও সাধ্য নেই স্কুল পাঠ্যবইয়ের কিম্ভূতকিমাকার ভাষার পাথর ভেঙে অর্থ উদ্ধার করে। শিক্ষক, অভিভাবকদেরও অভিযোগ, বইয়ের পৃষ্ঠা যেমন বেশি, সিলেবাসও কঠিন। সে কারণে বাধ্য হয়ে পড়ুয়ারা কোচিংয়ে যাচ্ছে। সবার দাবি সিলেবাস কমানোর, সহজ ভাষায় বই লেখানোর।

কিন্তু গোল বেধেছে এখানেই। স্কুল বইয়ের লেখক, সম্পাদকদের লম্বা তালিকা দেখুন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মহা মহা ডিগ্রিধারীরা তা লিখছেন, তা সম্পাদনাও করছেন। অথচ তাঁদের স্কুলে পড়ুয়াদের ভাষাজ্ঞান, মানসিক পরিপক্বতা সম্পর্কে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয় না। কারণ স্কুল বইগুলো কঠিন কঠিন শব্দে আর পরিভাষায় ঠাসা। পণ্ডিতের কাজ নাকি পণ্ড করা। অন্তত রবি ঠাকুর আমাদের তা-ই শিখিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে পণ্ডিতদের বনিবনা তেমন জমেনি ওই একটি কারণে—পণ্ডিত সহজ করে কিছু বলতে চান না; বরং সহজ জিনিস কঠিন ও জটিল করতে ওস্তাদ। অমলের চিকিৎসা দিতে এসে কবিরাজ মশাই যত সংস্কৃত ঝাড়েন, অমলের নিরাময়ের আশা তত ফিকে হয়ে আসে। আমাদের পণ্ডিতকুল ‘জার্গন’-এ ভরিয়ে কেতাব লেখেন। তাতে সংস্কৃত, ইংরেজি আর লাতিনের ছড়াছড়ি। বেচারা পড়ুয়া শিখবে কী? ‘জার্গন’ আর দাঁতভাঙা শব্দ আর জটিল বাক্যের পাথরে পড়ুয়া মাথা কুটে মরে। জ্ঞান তার মরমে পশে না, মগজে ঠাঁই পায় না। তাই ধন্বন্তরি একটাই ভেবে শিক্ষক না বুঝিয়ে মুখস্থ করান। শিশুরা সেই কুইনাইনের মতো তিতে গেলে। শিশুর আনন্দ-বেদনা, কান্নায় কারও পাষাণ হৃদয়ে সামান্য সহানুভূতি জাগে না।

ভাষা নিয়ে বাঙালির এ ঘোড়ারোগ অবশ্য পৌনে ২০০ বছর পুরোনো। তার ঠিকুজি না নিলে বিদ্যাভিমানীদের ঠিকভাবে চেনা মুশকিল বটে। শুরু যে এ দেশে ব্রিটিশ যুগে, তা বলাই বাহুল্য। পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞানে যখন ভারতবাসীর চোখ ফুটানোর সাহেবি দস্তুর হয়ে উঠল, বিলেতি সাহেবরা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন আঁধারে হাবুডুবু খাওয়া নেটিভদের পথ দেখানোর গুরুভার, তখন ফোর্ট উইলিয়ামে তাঁরা জড়ো করেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের। তাঁদের আসল কাজ দাঁড়ায় দুটো—নেটিভদের তাবৎ জ্ঞানে জল ঢেলে পশ্চিমা জ্ঞানের মুরিদ করা; আর প্রায় ৭০০ বছরে গড়ে ওঠা ‘যবনি ভাষা’ মুছে ফেলা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সে স্টিম জাহাজের কাপ্তেন। জয়গোপাল বানিয়ে দিলেন ‘পারসিক অভিধান’ যাতে ভুল করেও কোনো ‘ভদ্রলোক’ যবনি ভাষায় কথা না বলেন, বই না লেখেন। মানুষ অভিধানের শরণ নেয় জুতসই শব্দ খুঁজে পেতে। জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের ফারসি ভাষার অভিধান তার উল্টো। কোন শব্দ ব্যবহার করলে ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হবে, এটা তার তালিকা। দুনিয়ায় এমন আজব অভিধান বোধ করি এই একটাই রচিত হয়ে থাকবে।

কলকাতায় তখন সাহেব হওয়ার ঘোড়দৌড় চলছে। সাহেব না হলেও ‘বাবু’ আর ‘ভদ্রলোক’ হতেই খুশিতে ডগমগ সাহেবানুগত বাবুরা! সমাজবিজ্ঞানীরা তার ললাটে ‘বাবু কালচার’ তিলক পরিয়ে ধন্য করেছেন। এই নকল সাহেব বা বাবুদের হাতে তৈরি হলো এক নকল ভাষা যার সঙ্গে ভূ-ভারতের আমজনতার মুখের বুলির কোনো মিল রইল না। গতর খাটা মানুষের মুখের বুলি সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার ব্রাহ্মণালয়ে যেদিন ব্রাত্য হলো আম—বাঙালির শিক্ষার দ্বারও গেল চিররুদ্ধ হয়ে। গত পৌনে ২০০ বছরে সে রুদ্ধদ্বার অর্গলবদ্ধ হয়েই রইল। বাকিরা ‘আলালি বাঙলার’ তকমা নিয়ে চিতায় পুড়েছে, নয়তো কবরে শুয়েছে। রবি-নজরুল-জসীম বাংলা নামের আড়ালে সংস্কৃতের পাষাণ কারা ভাঙতে যত শাবল কোদাল চালিয়েছেন, বিষ্ণু-সুধীন-বুদ্ধরা তত কঠিন করে তা বেঁধেছেন। তাই গতর খাটা নেড়ে-চাঁড়ালদের মুক্তির পথ খোলেনি। সহজ করে বলার মানুষ বাঙালির কপালে নেই। লালন ফকিরে দেহতত্ত্ব সুফিবাদ খুঁজতে খুঁজতে নগর বাউলের দল তাঁর সহজিয়া জীবন আর ভাষার হদিস করার সময় পেল না।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু কলকাতার কাছ থেকে ‘অভিজ্ঞানপত্র’ সংগ্রহের দাস্যবৃত্তি গেল না। অথচ দেশ স্বাধীন করতে এই গতর খাটা মানুষই অকাতরে জান কোরবান করেছেন। কিন্তু নতুন দেশে বৈষম্য এমন বেড়েছে যার কোনো নজির অতীতে নেই। সে বৈষম্য ধনে-মানে-জ্ঞানে। এই বেনজির বৈষম্য, বঞ্চনার শুরু ভাষা দিয়েই।

মায়ের ভাষার মান রাখতেই যদি বাংলাদেশ জন্মের আসল কারণ, কবুল করতেই হবে গতর খাটা মানুষের ভাষার হিস্যা সে এক ফোঁটাও পায়নি। বাংলাকে ‘সংস্কৃতের কন্যা’ বলে জাহির করার আর্যামি বাঙালি শিশুর শৈশব-কৈশোর ছিনতাই করেই চলেছে। হালে তাতে ইংরেজির এত দাপট যে বাংলার এখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। পণ্ডিতের কবল থেকে স্কুল পাঠ্যবই যত দিন মুক্তি না পাচ্ছে, বাঙালি শিশুর মুক্তির কোনো আভাসও তত দিন মিলবে না।

কর্তাদের কাছে একটাই আরজি, স্কুল বই সহজ ভাষায় লিখুন, যত দূর পারা যায় সরল বাক্যে লিখুন। জার্গন বা পরিভাষা কমান। দয়া করে আমাদের সন্তানদের হৃদয় আর খুন করবেন না।

আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]