শিশু-কিশোরেরা কি প্রতিপক্ষ?

সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় এক ডেপুটি কমিশনারের মনে হয়েছিল, তাঁর জেলা শহরের কিশোরেরা কেমন যেন বেয়াড়া বেয়াড়া। বড় বড় চুল রাখে, বেলবটম প্যান্ট পরে। লালনভক্তের সেই শহরে বাবরি চুলের চল বহুদিনের। হারেজ পাগলা নামে সমধিক পরিচিত খ্যাপা হারেজ তো ছিলই, আরও ছিলেন মানুষের আঘাতে ভবঘুরে হয়ে যাওয়া ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার রিচি—প্রায় সবার প্রথম পছন্দ ছিল বাবরি। মজার কথা, সেই জেলা প্রশাসকের নিজেরও চুল ছিল লম্বা। তিনি ঠিক করলেন শহরের সব কিশোরের চুল কেটে তিনি তাদের সাইজ করার চেষ্টা করবেন। একদিন এক খেলার মাঠের কাছে গাড়ি থামিয়ে তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব কিশোরের চুল ছেঁটে সভ্য–ভব্য হওয়ার পরামর্শ দেন। কিশোর দলের একজন নেতা সাহস করে এগিয়ে এসে বলল, ‘স্যার, আপনার চুলও তো বড় বড়।’ এক অর্বাচীন নাবালকের কাছ থেকে এমন চ্যালেঞ্জিং প্রশ্ন আশা করেননি ডিসি। উপস্থিত বুদ্ধির পরীক্ষায় পাস করে দেশের মানুষের দণ্ডমুণ্ডের মালিক হওয়া আমলা জবাব দিলেন, ‘আগে ডিসি হও তারপর চুল রেখো।’ তারপর তিনি মাঠ ছেড়ে চলে গেলেও পুলিশ রেখে গেলেন মাঠে। লম্বা চুলের কিশোরদের মাঠে খেলাধুলা বন্ধ হয়ে গেল। 

গত বছর (ফেব্রুয়ারি ২০১৯) সারা দেশে পুলিশের চুলবিরোধী অভিযান শুরু করেছিলেন টাঙ্গাইলের সখীপুরের ওসি। তিনি তরুণদের চুলে রং করার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। উপজেলা শীল সমিতির নেতাদেরও থানায় ডেকে এনে ছাত্র-যুবকদের ‘বখাটে’ স্টাইলে চুল কাটা এবং চুলে রং করায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পরের মাসে (মার্চ ২০১৯) টাঙ্গাইলের আরেক উপজেলা ভূঞাপুরের ওসি ঘোষণা করেন, কোনো তরুণ মাথার চুলে বাহারি কোনো ছাঁট দিতে পারবে না। ঝালকাঠির ওসিসহ আরও কয়েকজন ওসি নিজ নিজ এলাকায় একই ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু করেন। আগস্ট ২০১৯–এ নাটোরের গুরুদাসপুরের ওসি যাদের চুলের ছাঁট তাঁর পছন্দ নয়, তাদের রাস্তা থেকে ধরে ধরে সেলুনে নিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ‘মার্জিত’ ঢঙে চুল কাটানোর ব্যবস্থা করেন। মাগুরার পুলিশ কারও চুল বা দাড়ি ‘বখাটে’ স্টাইলে না কাটার ব্যাপারে সেলুনে সেলুনে বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দেয়।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে চুনকাম করে পরিষ্কার দেখানোর চেষ্টায় চুল কাটা একটা জনপ্রিয় হাতিয়ার। যাঁরা ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের পাকিস্তানি মার্শাল ল দেখেছেন, তাঁরা যে চুল কাটার বয়ান দেবেন বাংলাদেশি ‘মার্শাল ল’য়ের চুলচর্চার বয়ানও সেরকমই। কিশোর–তরুণদের একটু ভড়কে দাও। তারা যেন সমঝে চলে। এ ধরনের চুনকাম মার্কা কাজে একশ্রেণির মানুষেরও সমর্থন জুটে যায়। যেমন জোটে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বেলাতেও। মানুষের মধ্যে ‘ভালো’ কিশোরের একটা ধারণা তৈরি করে দেওয়া—ছোট করে ছাঁটা চুল তার একটা অনুষঙ্গ। যে কিশোর প্রশ্ন করবে না, মাথা নিচু করে চলবে, সেই ভালো কিশোর, ভালো তরুণ। 

ঢাকার এক আবাসিক এলাকায় বিকেলে হাঁটছিলেন অবসরপ্রাপ্তরা। আলাপ করছিলেন নিজেদের জীবনের সাফল্য নিয়ে। চিরজীবন অপার ‘সততার’ সঙ্গে চাকরি করে কে কীভাবে তাঁদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠিয়েছেন, তাঁরা কে কত উঁচুতে উঠেছেন—সেসবের সোনালি আলোচনা। হঠাৎ একজন বলে উঠলেন, বিদেশে না পাঠালে ছেলেমেয়েরা মানুষ হতো না। যা দিনকাল পড়েছে, সব বখাটে হয়ে যেত। পেপার খুললেই দেখবেন সব কিশোর গ্যাংয়ের কথা। লেখাপড়া বাদ দিয়ে সারা দিন গ্যাংবাজি করে বেড়ায় দলে দলে। লেকের পাড় ঘেঁষে নতুন করা ওয়াকওয়ে দিয়ে তখন হেঁটে যাচ্ছিল পাঁচ তরুণ। তাঁদের দেখিয়ে একজন বললেন, ওই যে চলেছে একটা গ্যাং। কালকেও দেখেছি কালো একটা জিনস পরা মেয়েও ছিল ওদের দলে। কী হাসাহাসি! বেলেল্লাপনার একশেষ। 

আবাসিকের পরিচালনা পর্ষদের সদ্য নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন অবসরপ্রাপ্তদের দলে। অনেক অসাধারণ কাজ করে তিনি এখন সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। তিনি আরেকটি অসাধারণ কাজ করলেন। থামতে নির্দেশ দিলেন তরুণদের। একে একে জেনে নিলেন কে কোন সেক্টরে কার বাড়িতে থাকে, গ্রামের বাড়ি কই, বাপের নাম ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই ছাত্র, কেউ মাধ্যমিক, কেউ উচ্চমাধ্যমিক। একজন বাদে বাকিরা ভাড়া থাকে। ভাড়াটেদের সম্পর্কে একজন মুরব্বি বাজে মন্তব্য করে বসলেন। তরুণদের তা ভালো লাগল না। একজন জানতে চায়, ‘কী বললেন আঙ্কেল?’ ব্যস, তাতেই প্রমাণিত হয়ে গেল তরুণেরা বেয়াদপের হাড্ডি, পড়াশোনা বাদ দিয়ে গ্যাংবাজি করে বেড়াচ্ছে, মুরব্বিদের সম্মান দিতে জানে না। তরুণেরা যে নাদান ফাঁকিবাজ, সেটা হাতেনাতে প্রমাণের জন্য একজন তাদের জ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেন—আর্কিমিডিসের বাড়ি কোথায়, থিওরি অব রেলাটিভিটি কারে কয়, নিউটন, গ্রাহাম বেল কেউ বাকি থাকে না। একজন মুরব্বি অ্যানড্রয়েড ফোনে ছবি তুলতে থাকেন। একজন এগিয়ে এসে দেখিয়ে দেন কীভাবে লাইভ করতে হয় সামনের দৃশ্য। কোনো মুরব্বিরই মনে হলো না তাঁরা অন্যায় কিছু করছেন, তরুণদের ছবি তাঁরা তাদের অনুমতি না নিয়ে ক্যামেরাবন্দী করছেন, আবার লাইভও করছেন।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম পার্লামেন্ট শিশু–কিশোরদের সুরক্ষার জন্য যে আইন করেছিল, সেখানে খুব স্পষ্ট করেই বলা আছে, শিশুদের হেয়প্রতিপন্ন করে কোনো ছবি তোলা বা প্রচার করা যাবে না। এমনকি ‘অপরাধে’জড়িয়ে পড়া শিশুদের নাম, পরিচয়, ছবি প্রকাশে বাধা আছে৷

আইন অমান্য করে ওই আবাসিকের মুরব্বিরাই যে শুধু শিশু–কিশোরদের ছবি প্রচার করেছেন—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। পুলিশের হাতে বিভিন্ন কারণে আটক শিশুদের ছবিসহ নাম–পরিচয় হরহামেশাই ছেপে দিচ্ছে বা প্রচার করছে একশ্রেণির সংবাদমাধ্যম। প্রকাশের আগে কি তারা একবারও চিন্তা করে, কী ভুল করছে তারা? কী জুলুমের হাতিয়ার হয়ে যাচ্ছে নিজেদের অজান্তে! আবার কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেল শিশু-কিশোর অপরাধের প্রতিবেদন দেখাতে গিয়ে শিশুকে দিয়েই অপরাধের অভিনয় করিয়ে নেয়৷ এই শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা ভাবে না৷ বুঝতে পারেন না যে এ ধরনের প্রতিবেদন শিশুদের মনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে! সমাজে তাদের চলতে অসুবিধা হবে। কারও কারও হয়তো আরও ‘বড় অপরাধী’ হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না৷ ঠিক যেমন শিশু–কিশোরদের জেলে পাঠিয়ে আরও ‘বড় অপরাধী’ বানানোর রাস্তা খুলে দেওয়া হয়৷ 

বড়দের মধ্যে কিশোরদের বিরুদ্ধে একটা অসহিষ্ণুতার মনোভাব ক্রমেই প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সঙ্গে এ ধরনের মনোভাব তৈরির কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সেটা বলা কঠিন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে কয়বার কায়েমি স্বার্থের ঘুম হারাম হয়েছে, তা তরুণেরাই করেছে। তাই কি কিশোর–তরুণদের সব নষ্টের গোড়া প্রমাণের কোনো চেষ্টা চলছে? জনসাধারণের মনে যদি এই ধারণা তৈরি করে দেওয়া যায় যে তরুণেরা বেসামাল, তাদের শাসন করা ছাড়া দেশ, সমাজ রক্ষা করা যাবে না; তাহলে কিশোর–তরুণেরা আর দাঁড়ানোর জায়গা পাবে না। প্রশ্ন করবে না, জানতে চাইবে না যে ‘কী বললেন আঙ্কেল?’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিগত নব্বইয়ের দশকে তরুণবিরোধী প্রচারণা হালে পানি পেয়েছিল। সবাই মেনে নিয়েছিল শিশু–কিশোরদের বিরুদ্ধে আইন কঠোর করার যুক্তি। বলা হয়েছিল কিশোর-অপরাধ কমাতে আইনে কিশোর অপরাধীদের বয়ঃসীমা কমিয়ে এনে কড়া সাজার ব্যবস্থা না নিলে দেশ রসাতলে যাবে। ‘কড়া’ আইন হলে কমবয়স্ক অপরাধীরা অপরাধ করার আগে দুবার ভাবে। কিন্তু বাস্তবে তা যে হয়নি, তা সে দেশের গত দুই দশকের কিশোর অপরাধের পরিসংখ্যান থেকেই পরিষ্কার। ফলে তাদের এখন ফিরে যেতে হচ্ছে কিশোরদের জন্য কিশোর উপযুক্ত পৃথক আইন রচনায়। 

এটা ভুললে চলবে না কিশোরেরা পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতার দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হয়। শিশুদের মানসিক বিকাশের ধারা বিশ্লেষণ করে শিশু মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, অনেক ক্ষেত্রে কম বয়সের মানুষেরা পরিণাম না বুঝে কোনো পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের দ্বারা চালিত হয়। আচরণের সম্ভাব্য ফলাফল ও পরিণতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না থাকলে কেউ কেউ গর্হিত কাজেও জড়িত হয়। সেদিক থেকে দেখলে তাদের মানসিক বিকাশ ও দায়িত্ব নিতে শেখার পেছনে, তাদের চেয়ে বরং সমাজের দায়দায়িত্বই থাকে বেশি। সেখানে যদি কোনো ফাঁক থেকে যায়, ভবিষ্যতে তার ফল হতে পারে মারাত্মক। 

কোনো গবেষণালব্ধ তথ্যভিত্তির সমর্থন ছাড়া অনেকে বলার চেষ্টা করছেন, ইদানীং নাকি ছেলেমেয়েরা কম বয়সেই ‘অত্যন্ত পরিণত’ হয়ে যায়, ফলে কৈশোরের বয়স নির্ধারণে ১৮-এর সীমা নির্ধারণ ঠিক হয়নি। গবেষণা বা সমীক্ষা ছাড়া এসব বাণীর প্রচার ক্ষতিকর।

 গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
[email protected]