ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কোনো দুর্ঘটনা নয়

এএফপি ফাইল ছবি।
এএফপি ফাইল ছবি।

ইরান ইউক্রেনীয় এয়ারলাইনসের ফ্লাইট পিএস-৭৫২ ভূপাতিত করার বিষয়ে মিথ্যা ও ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিমূলক কাহিনি শোনাচ্ছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে একজন নার্ভাস ক্ষেপণাস্ত্র অপারেটরের ভুলে বিমানটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয়েছে। ওই অপারেটর সিদ্ধান্ত নিতে ‘মাত্র ছয় সেকেন্ড’ দেরি করায় ভুল করে যাত্রীবাহী বিমানটিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ভূপাতিত করেছেন। অপারেটর ভেবেছিলেন, তিনি একটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রকে লক্ষ্য করে আঘাত করেছেন।

প্রতিটি আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় কমপক্ষে তিনটি অংশ থাকে: একটি ক্ষেপণাস্ত্র ফায়ারিং ইউনিট, যা বিমানটির প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ধারণ করে, একটি অ্যাকুইজিশন রাডার, যা একটি বিস্তৃত অঞ্চল অনুসন্ধান করে এবং কোনো হুমকি সম্পর্কে আগেভাগেই সতর্কবার্তা পাঠায় এবং একটি এনগেজমেন্ট রাডার, যা লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে এবং ক্ষেপণাস্ত্রকে নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। 

মার্কিন গোয়েন্দারা মনে করেন, ইউক্রেনের বিমান উড়িয়ে দিতে রাশিয়ার তৈরি টর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে রয়েছে একটি আধুনিক ডিজিটাল কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এবং একটি আইএফএফ (বন্ধু ও শত্রুকে শনাক্ত করার যন্ত্র)। পুরো প্যাকেজ টিএলএআর নামে পরিচিত। ইরান ২০০৭ সালে ২১টি টর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনেছিল। 

একজন রাডার অপারেটর কেবল একটি বোতাম টিপে একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে না। নিক্ষেপ করার জন্য ক্ষেপণাস্ত্রটিকে তৈরি করতে কমপক্ষে পুরো এক মিনিট, কখনো কখনো দেড় মিনিট বা তার বেশি সময় লাগে। এ ছাড়া নিক্ষেপ করার আগে লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে তথ্য এক বা একাধিক বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হয় এবং ক্ষেপণাস্ত্রের ঘূর্ণমান অংশকে সচল করতে হয়। এ জন্য অপারেটরের মাত্র ছয় সেকেন্ডের ভুলের গল্পটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। এমনকি পানসির, এস-৩০০ এবং এস-৪০০ (সব রাশিয়ার নির্মিত)-এর মতো আরও আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হতে এক থেকে দুই মিনিট লাগে। 

এ ছাড়া একজন ক্ষেপণাস্ত্র অপারেটরের কোনো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার কর্তৃত্ব নেই, যতক্ষণ না তিনি তাঁর কমান্ডারের কাছ থেকে অনুমতি পাচ্ছেন। ইরান দাবি করেছে যে সদর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায় ছিল না, তাই তারা অনুমোদন ছাড়াই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। 

ইউক্রেনের বিমানটি সকাল ছয়টার পর তেহরানের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে। তিন মিনিট পর এটি আট হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে যায় এবং এর কিছুক্ষণ পরই এটি বিধ্বস্ত হয়। বিমান উড্ডয়নের পরপরই যেকোনো ভালো রাডারের ক্ষমতা আছে বিমানটি শনাক্ত করার। একটি বিমানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে ১০ সেকেন্ড সময় লাগে। তাই আমরা এটা বলতে পারি যে টর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুতি থেকে শুরু করে নিক্ষেপ পর্যন্ত গোটা তিন মিনিটই পেয়েছিল।

টর ক্ষেপণাস্ত্রের অ্যাকুইজিশন রাডারের পাল্লা হচ্ছে ২৫ কিলোমিটার, যার অর্থ হচ্ছে সত্যিই যদি পথে কোনো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র থাকে, তবে এটি কিছুটা দূর থেকে সেটিকে শনাক্ত করতে পারত। তেহরানের পশ্চিম ও দক্ষিণের অঞ্চলটি সমতল এবং পশ্চিমের পার্বত্য অঞ্চল থেকে একটি রাডারের পক্ষে যেকোনো বস্তু শনাক্ত করা খুবই সহজ। তবে ইরান কখনোই সেদিক থেকে মার্কিন হামলা আশা করে না। কাজেই ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র অপারেটরের ভুল করার কোনো সুযোগই ছিল না। 

ইউক্রেনীয় এয়ারলাইনসের বিমানটিতে একটি রাডার ট্রান্সপন্ডার অর্থাৎ রেডিও সংকেত গ্রহণে সক্ষম রিসিভার ছিল, যা একটি রাডার ব্লিপ শনাক্ত করতে পারে এবং বিমানের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণকারীদের কাছে অন্যান্য তথ্য সরবরাহ করে। প্রশ্ন হচ্ছে রাশিয়ান নির্মিত বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কেন বাণিজ্যিক এবং সামরিক বিমানগুলোর মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনি? যদি এটি এই পার্থক্য করতে না পারে, তবে ধরে নিতে হবে টর ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থার আইএফএফ নিম্নমানের এবং বিশ্বাসযোগ্য নয়। 

এখন ইরানে খামেনির পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে প্রতিবাদ চলছে। বিক্ষোভকারীরা মিথ্যা বিবরণ বোঝে এবং অকারণে এতগুলো মানুষের প্রাণহানিতে তারা ক্ষুব্ধ। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এর ১৭৬ জন আরোহীর সবাই নিহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৮২ জন ইরানি এবং ৬৩ জন কানাডীয় নাগরিক ছিলেন। 

অবিশ্বাস্যভাবে, ইরানি কর্তৃপক্ষ তেহরানে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত রব ম্যাকায়ারকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বিক্ষোভগুলোতে কড়া পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় যুক্তরাজ্য ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। তারা ম্যাকায়ারকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানায়। পরে ম্যাকায়ারকে ছেড়ে দেয় ইরানি কর্তৃপক্ষ। তবে খামেনির পদত্যাগের দাবিতে ইরানে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। 

আমি বলতে চাই ইউক্রেনীয় বিমানটির ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। এটি ছিল একটি অপরাধমূলক কাজ, যা অবশ্যই তেহরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সাহায্যে চালানো হয়েছে এবং তাতে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অনুমোদন ছিল। 

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
স্টিফেন ব্রাইয়েন ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকান ফরেন পলিসি কাউন্সিলের ডিফেন্স স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো