নিরাপদ, মুক্ত এবং সম্মানজনক পরিবেশ দিতে হবে

কাজী মারুফুল ইসলাম, ফাহমিদুল হক, কামরুল হাসান মামুন, সামিনা লুৎফা, মোশাহিদা সুলতানা, মো. আব্দুল মান্নান, মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান ও গীতি আরা নাসরিন

নিরাপদ, মুক্ত এবং সম্মানজনক বিদ্যায়তনিক পরিবেশ শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমরা বারবার লক্ষ করছি, গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ অবস্থার ভয়ংকর অবনতি ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ব্যবস্থা গ্রহণে অপারগতা-অনাগ্রহের কারণে ক্যাম্পাসগুলোতে সরকারি দল সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের দৌরাত্ম্য আইন এবং সভ্যতার সব সীমা অতিক্রম করেছে। এ ধরনের ঘটনার সর্বশেষ শিকার হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন। 

জোবাইদা নাসরীনের বক্তব্য এবং গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী দেখা যায়, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৫ জানুয়ারি রোববার সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শাড়ি বিতরণ নিয়ে হল শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। সহকারী আবাসিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে বিবদমান পক্ষের মারামারি থামাতে এগিয়ে গেলে অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার হন। আপাতভাবে জোবাইদাকে লাঞ্ছনার ঘটনাটি একটি হলের ভেতরে ঘটা ‘স্থানীয়’, বিচ্ছিন্ন সমস্যা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা আছে। কিন্তু ঘটনাটার বিস্তৃত বিবরণ থেকে দেখা যায়, এখানে বেশ কিছু উপাদান আছে, যা বিশ্লেষণ করলে রাজনীতি-ক্ষমতা এবং শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে গড়ে ওঠা এক ভয়ংকর দানবীয় সম্পর্ক-জালের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, প্রভাব কোনো একটি হল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা পেরিয়ে সারা দেশের জন্য এক অশনিসংকেতকে ইঙ্গিত করে। 

লক্ষ করুন (ক) বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ছাত্রলীগের যে সদস্যের নেতৃত্বে জোবাইদা লাঞ্ছনার শিকার হন, সেই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সন্ধ্যাকালীন প্রোগ্রামের ছাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান আইনানুযায়ী তিনি কোনো আবাসিক হলে সিট পেতে পারেন না; (খ) যে শিক্ষার্থী জোবাইদাকে শারীরিক লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে যান, ওই শিক্ষার্থীর দোষ ছিল ‘তিনি কোন সাহসে পলিটিক্যাল ব্লকে গেছেন’। অর্থাৎ ওই হলে ‘পলিটিক্যাল ব্লক’ নামে পরিচিত ছাত্রলীগের নেত্রীদের জন্য একটি বিশেষ সংরক্ষিত ব্লক আছে, যেখানে হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিনা অনুমতিতে যাওয়া নিষেধ। এই পলিটিক্যাল ব্লক মূলত টর্চার সেলের আরেক নাম। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখনো আবরার-পরবর্তী রাজনৈতিক আবহের মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক হলেই এমন কয়েকটা রুম বা ব্লক আছে, যার ওপর হল প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; (গ) ওই ঘটনার সময় জোবাইদা যখন তাঁদের নিষেধ করছিলেন, তখন ওই নেত্রী হলের প্রভোস্টের কাছে বলেন যে তাঁদের সঙ্গে কথা না বলে এমন ‘বাম’ আবাসিক শিক্ষক কেন নিয়োগ করেছেন, তখনই তাঁকে বের করে দিতে হবে বলে দাবি করেন। অর্থাৎ অবৈধভাবে হলে অবস্থানকারী একজন শিক্ষার্থী আবাসিক শিক্ষককে বের করে দিতে বলছেন। এবং প্রভোস্ট মহোদয় তা হজম করছেন। 

এ ঘটনায় অধ্যাপক জোবাইদা সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক সমিতির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদকসহ হলের প্রাধ্যক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। 

অভিযোগের কী সুরাহা হবে বা কবে হবে বা আদৌ হবে কি না, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের এই মুহূর্তে জানা নেই। তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, তা-ও আমাদের জানা নেই। কিন্তু যা আমরা দেখছি এবং জানছি তা হলো, শিক্ষায়তনে সরকারি দল সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের কাছে নতজানু প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি শিকড় গেড়ে বসেছে, যা শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্ক তথা সামগ্রিকভাবে শিক্ষার, জ্ঞানচর্চার স্বাভাবিক পরিবেশ ধ্বংস করছে। আমরা এ ধরনের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু ও ন্যায়সংগত প্রতিকার দাবি করছি। 

প্রসঙ্গক্রমে আমরা উল্লেখ করতে চাই যে ছাত্রলীগের সদস্যদের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিকট অতীতে বেশ কয়েকবার হয়েছে। যেমন ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন হয় এবং নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকেরা নিপীড়িত শিক্ষার্থীদের রক্ষায় এগিয়ে গেলে ছাত্রলীগের সদস্যরা শহীদ মিনারে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কয়েকজন শিক্ষককেও লাঞ্ছিত করেন। 

ঢাকার বাইরেও এই দৌরাত্ম্য সমভাবে চলমান, যেমন গত বছর রাজশাহী পলিটেকনিক কলেজের অধ্যক্ষকে ছাত্রলীগের সদস্যরা ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দেন, গত বছর এপ্রিলে চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের চেয়ারম্যান মুহাম্মাদ শামিমুল হক চৌধুরীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেও এসব ঘটনায় এখনো পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি। বরং অভিযোগকারী শিক্ষককে বিভিন্নভাবে হুমকি, প্রশাসনিক অসহযোগিতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়। বলা বাহুল্য, এমন বিচারহীনতার চূড়ান্ত পরিণতি হলো বুয়েটের আবরার হত্যাকাণ্ড। 

শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জন্য নিরাপদ এবং মুক্ত শিক্ষা-গবেষণা-কাজের পরিসর সৃষ্টি না করতে পারলে যেমন একদিকে পাঠদান, জ্ঞান সৃজন ও প্রকাশ ব্যাহত হয়, তেমনি অপরদিকে মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। এসব ঘটনা থেকে এটা খুবই পরিষ্কার যে শিক্ষায়তনে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় উপাচার্য-প্রক্টর-প্রভোস্ট-শিক্ষক সমিতিকেন্দ্রিক যে পরিচালনা কাঠামো বিদ্যমান, তা সরকারি দল সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের দলের অধস্তন কাঠামোতে পরিণত হয়েছে, যা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী বা শিক্ষকদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন, নিপীড়ন প্রতিকারে কোনো ন্যায়সংগত ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম কি না, সেই প্রশ্ন প্রকট হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা স্পষ্টভাবে দাবি জানাতে চাই: 

১। জোবাইদা নাসরীনসহ অন্য আক্রান্ত শিক্ষকদের অভিযোগ আমলে নিয়ে দ্রুত বস্তুনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। 

২। সব আবাসিক হল থেকে শিক্ষার্থী টর্চার সেল/পলিটিক্যাল ব্লক নির্মূল করতে হবে। 

৩। গণরুম, গেস্টরুম সংস্কৃতি বন্ধ করে ক্যাম্পাসে এবং হলগুলোতে ভিন্নমত চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। 

৪। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়ে, মেধার ভিত্তিতে সিট বণ্টন করতে হবে। 

৫। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেকোনো ধরনের শিক্ষার্থী-শিক্ষক নির্যাতনের অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত ও প্রতিকারের ব্যবস্থা সুপারিশের জন্য প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কহীন গ্রহণযোগ্য শিক্ষকদের নিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদে সরাসরি আচার্যের অধীনে ক্যাম্পাস ন্যায়পাল গঠন করতে হবে। 

কাজী মারুফুল ইসলাম, ফাহমিদুল হক, কামরুল হাসান মামুন, সামিনা লুৎফা, মোশাহিদা সুলতানা, মো. আব্দুল মান্নান, মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান ও গীতি আরা নাসরিন। লেখকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক।